স্বাধীনতার গুরুত্ব: বর্তমান শতাব্দীর ইতিহাস হল স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের ইতিহাস। মানবজাতির আধুনিক ইতিহাস শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের কথা ও কাহিনীতে সমৃদ্ধ। স্বাধীনতা হল মানুষের সঙ্গে একান্তভাবে সম্পর্কযুক্ত এক মৌল রাজনীতিক ধারণা। স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী—এই তিনটি রাজনীতিক ধারণা মানুষের মনে গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি অনুরাগের সৃষ্টি করেছে। এই তিনটি রাজনীতিক আদর্শের মধ্যে স্বাধীনতার গুরুত্বই সর্বাধিক। ফরাসী দার্শনিক মনটেস্কু (Montesque)-র মতানুসারে স্বাধীনতার মত অপর কোন ধারণা বিচিত্র তাৎপর্যযুক্ত নয় এবং মানুষের মনে বিচিত্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেনি। আবার স্বাধীনতার স্বরূপ সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের কারণে স্বাধীনতা সর্বাধিক বিতর্কিত রাজনীতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
স্বাধীনতার সংজ্ঞা ও প্রকৃতি
স্বাধীনতা বলতে নিয়ন্ত্রণবিহীনতাকে বোঝায় না: স্বাধীনতার ইংরাজী প্রতিশব্দ ‘Liberty’-র উৎপত্তি হয়েছে একটি ল্যাটিন শব্দ থেকে। ল্যাটিন শব্দটি হল ‘Liber’। এর অর্থ হল ‘স্বাধীনতা’। আবার ব্যুৎপত্তিগত অর্থে স্বাধীনতা বলতে স্ব-অধীনতা বা নিজের অধীনতাকে বোঝায়। অর্থাৎ নিজের ইচ্ছামত আচার-আচরণের সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু এ হল স্বেচ্ছাচারের নামান্তর। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বাধীনতা শব্দটি এই অর্থে ব্যবহৃত হয় না। বিনা বাধায় খুশিমত কাজ করার অধিকার স্বীকৃত হলে উচ্ছৃঙ্খলতা প্রশ্রয় পায়। এতে স্বাধীনতা মুষ্টিমেয় সবল ব্যক্তির করায়ত্ত হয়। দুর্বলের কোন স্বাধীনতা থাকে না। সুতরাং স্বাধীনতা বলতে নিয়ন্ত্রণবিহীনতা বা অবাধ অধিকারকে বোঝায় না। প্রকৃত প্রস্তাবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীনতা শব্দটিকে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। এই কারণে স্বাধীনতার স্বরূপ অনুধাবনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা এককভাবে যথেষ্ট বিবেচিত হয় না।
স্বাধীনতা সম্পর্কে মিলের ধারণা: জে. এস. মিল (John Stuart Mill) স্বাধীনতা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর Essays on Liberty শীর্ষক রচনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মিল ছিলেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মতবাদে বিশ্বাসী। তিনি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্বাধীনতার ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতানুসারে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতার অবসানই হল স্বাধীনতা। ব্যক্তির স্বাধীনতার উপর তিনি রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন। তাঁর মতে নিজের উপর এবং নিজের দেহ ও মনের উপর প্রত্যেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম। মিল মূলত বিধি-নিষেধের অনুপস্থিতিকেই স্বাধীনতা হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। ব্যক্তির দৈহিক বা নৈতিক কল্যাণের স্বার্থেও স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ অনভিপ্রেত। মিলের মতে কেবলমাত্র আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে অপরের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যায়। আবার কোন ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে একমাত্র তখনই ক্ষমতা প্রয়োগ করা যায় যখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অপরের অনিষ্ট সাধনে উদ্যত হয়। মিলের মতে, স্বাধীনতা হল ব্যক্তির চিন্তাধারার অব্যাহত প্রকাশ। মিল মানুষের কাজকে আত্মসম্বন্ধীয় (self-regarding) এবং অপর সম্বন্ধীয় (other-regarding) এই দুভাগে বিভক্ত করেছেন। তাঁর মতে ব্যক্তির আত্মকেন্দ্রিক কাজে (self regarding actions) রাষ্ট্র কোনরকম হস্তক্ষেপ না করলে ব্যক্তির পক্ষে স্বাধীনতা ভোগ সম্ভবপর হয়। কেবলমাত্র অপরের স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত কাজকর্মের ক্ষেত্রে বাধা-নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে। মিলের মতানুসারে ব্যক্তিমাত্রেই আত্ম-সম্পর্কিত কার্যাবলীর ব্যাপারে পুরোপুরি স্বাধীন থাকবে।
মিলের ধারণার বার্কারকৃত সমালোচনা: স্বাধীনতা সম্পর্কে মিলের এই ধারণা গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয় না। স্বাধীনতা সম্পর্কিত মিলের ধারণা সমালোচিত হয়েছে। মিলের সমালোচনা প্রসঙ্গে বার্কার (Ernest Barker)-এর বক্তব্য প্রথমে প্রণিধানযোগ্য। বার্কার তাঁর Political Thought in England from 1848 to 1914 শীর্ষক রচনায় এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে স্বাধীনতাভোগকে সকলের ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হলে ব্যক্তির কাজকর্মের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। তাঁর অভিমত হল: ‘প্রত্যেক ব্যক্তিরই স্বাধীন হওয়া উচিত, …কোন ব্যক্তিই অবাধভাবে স্বাধীন হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেছেন: “The truth that every man ought to be free has for its other side the complementary consequential truth that no man can be absolutely free.” স্বাধীনতা সম্পর্কে মিলের ধারণা প্রসঙ্গে বার্কারের অভিমত এই যে, “মিল ছিলেন শূন্যগর্ভ স্বাধীনতার প্রবক্তা….। অধিকার সম্পর্কে তাঁর আদৌ কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না, যার থেকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতার সৃষ্টি হয়। বার্কার বলেছেন: “Mill was the prophet of an empty liberty….He had no clear philosophy of rights through which alone the conception of liberty attains a concrete meaning.” অধ্যাপক বার্কার মিলকে ‘বিমূর্ত ব্যক্তি’ (abstract individual)-র প্রবক্তা হিসাবে অভিহিত করেছেন। স্বাধীনতার ধারণা বাস্তবে কার্যকর হতে পারে এমন কোন তত্ত্বের অবতারণা মিল করতে পারেননি। আবার ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে বিরোধিতার ধারণার অবসানের সম্ভাবনাযুক্ত কোন সামগ্রিক সমাজব্যবস্থার কথাও বলতে পারেননি।
ব্যক্তির স্বাধীনতা ভোগ অবাধ হতে পারে না: মিলের তত্ত্বে প্রত্যেক ব্যক্তি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন পৃথক ব্যক্তি হিসাবে প্রতিপন্ন হয়েছে। মিলের মতানুসারে একজনের আচরণের প্রভাব অন্য কারও জীবনের উপর পড়ে না। কিন্তু মিলের এই ধারণাও যথার্থ নয়। কারণ ব্যক্তি মানুষের সকল আচরণই হল কার্যত সামাজিক আচরণ। ব্যক্তির যাবতীয় আচরণের ফলাফল সমাজের অন্য সকলের উপর পড়ে এবং চূড়ান্ত বিচারে নিজের উপর পড়ে। কারণ প্রত্যেক ব্যক্তির কাজকর্মের মাধ্যমে সামাজিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “All conduct is social conduct in the sense that whatever I do has results upon me as a member of society.” কোন ব্যক্তি এককভাবে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। তাকে এ ক্ষেত্রে সামাজিক স্বার্থের কথা বিচার-বিবেচনা করতে হয়। অধ্যাপক ল্যাস্কি সামাজিক কল্যাণের স্বার্থে ব্যক্তির আচরণের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। ল্যাস্কিও হলেন একজন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। এতদসত্ত্বেও তিনি বলেছেন: “Liberty…involves in its nature restraints, because the separate freedoms I use are not freedoms to destroy the freedoms of those with whom I live.” হবহাউস (L. T. Hobhouse) -ও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর Liberalism শীর্ষক রচনায় তার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর মতানুসারে প্রত্যেক ব্যক্তির কার্যকলাপ এবং চিন্তা-ভাবনা সমাজের অন্যান্য ব্যক্তির কাজকর্ম ও চিন্তা ভাবনাকে প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে থাকে। সামাজিক দিক থেকে তাৎপর্যহীন এমন কোন বিষয় মানবজীবনে থাকতে পারে না। বস্তুত মিলের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা ঊনবিংশ শতাব্দীর উদারনীতিক মতবাদের দ্বারা সমর্থিত হয়নি।
স্বাধীনতা সম্পর্কে গ্রীণ প্রমুখ ভাববাদীদের ব্যাখ্যা: ভাববাদী রাষ্ট্র-দার্শনিকরা ব্যক্তির বিকাশের স্বার্থে স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তাঁরা সমাজ ও ব্যক্তি এবং ব্যক্তি-মানুষের নৈতিক ব্যক্তিত্বের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার গুরুত্বের কথা বলেছেন। এঁদের মতানুসারে স্বাধীনতা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও নিয়ন্ত্রিত; কিন্তু তা অবশ্যই ব্যক্তি মানুষের নৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। ভাববাদীদের অভিমত অনুসারে মানুষের বিভিন্ন নৈতিক গুণগত বৈশিষ্ট্যের বিকাশের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। অর্থাৎ ভাববাদীরা নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক অর্থে স্বাধীনতার ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। ইংরেজ দার্শনিক গ্রীণ (T. H. Green)-ও ছিলেন একজন ভাববাদী চিন্তাবিদ। তিনিও ইতিবাচক অর্থে স্বাধীনতার কথা বলেছেন। তাঁর মতানুসারে নিছক বাধা-নিষেধের অপসারণকেই স্বাধীনতা বলে না। গ্রীণ স্বাধীনতাকে একটি ক্ষমতা হিসাবে দেখেছেন। মানুষই এই ক্ষমতার মাধ্যমে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু করবে যা সকলের সঙ্গে একত্রে ভোগযোগ্য। এইভাবে স্বাধীনতা প্রকৃত স্বাধীনতা হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথাও বলা হয়েছে। মানুষের কার্যকলাপের মধ্যে যেগুলি সমাজকল্যাণমূলক এবং সদিচ্ছাযুক্ত তার উপর থেকে রাষ্ট্রকে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা অপসারিত করতে হবে।
স্বাধীনতার সঙ্গে বিধি-নিষেধ সম্পর্কযুক্ত: ফরাসী দার্শনিক রুশোর মতানুসারে সাধারণ ইচ্ছার (General Will) অনুবর্তী হয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। জার্মান দার্শনিক হেগেলের মতে রাষ্ট্রীয় আইন মান্য করার মাধ্যমেই ব্যক্তির স্বাধীনতা ভোগ সম্ভব। ল্যাস্কি এই দুই মতকে অস্বীকার করেছেন। স্বাধীনতা সম্পর্কিত ল্যাস্কির বক্তব্য বাস্তবসম্মত এবং ইতিবাচক। ল্যাস্কির মতানুসারে সমগ্র সমাজ হল একটি অখণ্ড সত্তা। এই সত্তার ভিতরে থেকে কোন ব্যক্তির সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যের দাবি অর্থহীন। তাঁর মতে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের দিকে নজর রেখেই স্বাধীনতার অনুশীলন করতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য একই সুযোগ-সুবিধার স্বার্থে বিধি-নিষেধের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য প্রতিপন্ন হয়। অর্থাৎ বিধি-নিষেধের বিষয়টি স্বাধীনতার সঙ্গে অবধারিতভাবে সম্পর্কযুক্ত। তবে আইন ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিপন্থী হলে তা মান্য করার অর্থ ব্যক্তির স্বাধীনতার হানি। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকা দরকার।
স্বাধীনতা সম্পর্কে ল্যাস্কির ধারণা: ল্যাস্কি ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় দিক থেকেই স্বাধীনতার ধারণাটি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে স্বাধীনতা হল সমাজের বিশেষ কিছু অবস্থার উপর থেকে বিধি-নিষেধের অপসারণ। ব্যক্তির সুস্থ, স্বচ্ছন্দ ও কল্যাণময় জীবনযাত্রার পক্ষে এই সমস্ত অবস্থা অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য সামাজিক অবস্থার উপর থেকে বিধি-নিষেধের অপসারণ আবশ্যক। কিন্তু কেবল বিধি-নিষেধের অপসারণই স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতার ধারণা নিছক নেতিবাচক বা সংকীর্ণ নয়। ল্যাস্কির মতে স্বাধীনতার ধারণা ইতিবাচক। তাঁর মন্তব্য অনুসারে, “Liberty is positive thing.” ব্যক্তি মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার প্রকৃষ্টতম বিকাশের জন্য স্বাধীনতা অপরিহার্য। এবং ব্যক্তিবর্গের স্বাধীনতার সঙ্গে সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ সম্পর্কযুক্ত। ল্যাস্কির মতানুসারে স্বাধীনতা বলতে এক বিশেষ পরিবেশকে বোঝায়, যে পরিবেশে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করতে পারে। ল্যাস্কির মতে, ‘স্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি সেই পরিবেশের সযত্ন সংরক্ষণ যেখানে মানুষ তার সত্তাকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করার সুযোগ পায়।’ ল্যাস্কির নিজের কথায়: “By liberty I mean the eager maintenance of that atmosphere in which men have the opportunity to be their best selves.” ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী কতকগুলি বাহ্যিক অবস্থা বা সুযোগ-সুবিধার সংরক্ষণের দ্বারা এই পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সুতরাং স্বাধীনতা বলতে বোঝায় এক বিশেষ সামাজিক পরিবেশকে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য এই সামাজিক পরিবেশ অপরিহার্য। এই পরিবেশের উপর থেকে যাবতীয় বিধি-নিষেধের অপসারণ আবশ্যক। তা হলেই সুস্থ ও সভ্য সমাজজীবনের জন্য অপরিহার্য অবস্থা বা শর্তাদি সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।
স্বাধীনতা ও অধিকার অবিচ্ছিন্ন: ল্যাস্কির মতানুসারে স্বাধীনতা ও অধিকার পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। বস্তুত অধিকার থেকেই স্বাধীনতার সৃষ্টি। ব্যক্তি মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার বৈচিত্র্যপূর্ণ বিকাশের জন্য অধিকার আবশ্যক। কতকগুলি প্রকৃত সুযোগ-সুবিধাকে অধিকার বলা হয়। ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক এই সুযোগ-সুবিধাগুলিকেই অধিকার বলে। সুতরাং অধিকারগুলির সমন্বিত উপস্থিতির ফলে যে পরিবেশের সৃষ্টি হয় তাই হল স্বাধীনতা। অর্থাৎ অধিকারের দ্বারাই স্বাধীনতার পরিবেশ রচিত হয়। ল্যাস্কি বলেছেন, ‘স্বাধীনতা হল অধিকারের ফল’ (“Liberty is the product of rights.”)। অধিকার ব্যতিরেকে স্বাধীনতার অস্তিত্ব অসম্ভব। অধিকারের স্বীকৃতির মাধ্যমে আইনের সুষ্ঠু ও সংযত প্রয়োগ সুনিশ্চিত হয়। স্বাধীনতা ও অধিকার অবিচ্ছিন্ন। অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে স্বাধীনতা ছাড়া অধিকারের বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়ায়।
ল্যাস্কির মতানুসারে স্বাধীনতা সংরক্ষণের স্বার্থে রাষ্ট্রের কাজকর্মের ফলাফল নিরপেক্ষ হওয়া আবশ্যক। তা ছাড়া স্বাধীনতার স্বার্থে বিশেষ সুযোগ-সুবিধার অস্তিত্ব অস্বীকৃত হওয়া দরকার। আবার একজনের অধিকার যদি অন্যজনের মর্জির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তা হলে স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়তে বাধ্য।
স্বাধীনতা ও অধিকার অবিচ্ছিন্ন বলে রাষ্ট্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্র অধিকারের অনুশীলনকে সুনিশ্চিত করে। এবং এই স্বাধীনতার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নিশ্চয়তার সৃষ্টি করে। এই কারণে রাষ্ট্র থেকে স্বাধীনতাকে স্বতন্ত্র করা যায় না। ব্যক্তির স্বাধীনতার উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল তা প্রতিরোধ করা।
স্বাধীনতা একটি আইনগত ধারণা: সুতরাং অধিকার থেকেই স্বাধীনতার সৃষ্টি হয়। আর রাষ্ট্র কর্তৃক আইনের মাধ্যমে স্বীকৃত ও সংরক্ষিত না হলে অধিকারের সৃষ্টি হয় না। সুতরাং অধিকার হল একটি আইনগত ধারণা এবং এ কেবল রাষ্ট্রের মধ্যেই ভোগ করা যায়। অতএব অধিকারের মত স্বাধীনতাও একটি আইনগত ধারণা এবং কেবল রাষ্ট্রের মধ্যেই স্বাধীনতার উপলব্ধি সম্ভবপর। রাষ্ট্রই আইনের দ্বারা স্বাধীনতার পরিবেশ রচনা করে এবং স্বাধীনতাভোগকে সম্ভবপর করে তোলে। এই কারণে স্বাধীনতা অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। বার্কারের মতে ‘রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাধীনতা বা আইনসঙ্গত স্বাধীনতা কখনই প্রত্যেকের অবাধ স্বাধীনতা হতে পারে না; এ হল সবসময় সকলের জন্য শর্তসাপেক্ষ স্বাধীনতা’ (“Liberty in the state or legal liberty is never absolute liberty of each but always the qualified liberty of all.”)।
অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ স্বাধীনতার বিরোধী: কিন্তু অতিরিক্ত ও অবাঞ্ছিত নিয়ন্ত্রণ স্বাধীনতার পরিপন্থী। ল্যাস্কির মতে স্বাধীনতার স্বার্থে স্বৈরাচারী আইনকে প্রতিরোধ করতে হবে এবং এই ক্ষমতা না থাকলে স্বাধীনতা ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী হতে পারে না। মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধনই লক্ষ্য, স্বাধীনতা একটি পন্থা মাত্র। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্বাধীনতার দুটি দিক পরিলক্ষিত হয় – নেতিবাচক (nega tive aspect) এবং ইতিবাচক (positive aspect)। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংরেজ দার্শনিক হস, লক্, অ্যাডাম স্মিথ প্রমুখ স্বাধীনতার নেতিবাচক প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য যখন নিয়ন্ত্রণবিহীনতার কথা বলা হয় তখন স্বাধীনতার নেতিবাচক দিকটি প্রকাশিত হয়। ল্যাস্কি বলেছেন: “By liberty, I mean the absence of restraint upon the existence of those social conditions, which in modern civilisation are the necessary guarantees of indi vidual happiness.” আর ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য যখন নানা রকম সুযোগ-সুবিধা ও কল্যাণমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলা হয় তখন স্বাধীনতার ইতিবাচক দিকটি ব্যক্ত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ স্বাধীনতার এই দ্বিতীয় দিকটির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন।
মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে স্বাধীনতার ধারণা: মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে স্বাধীনতার ধারণা সমাজের আর্থনীতিক কাঠামো ও সম্পত্তি সম্পর্কের সঙ্গে একান্তভাবে যুক্ত। মার্কসবাদ অনুসারে মানুষের পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগই হল স্বাধীনতা। সব রকম আর্থিক শোষণের অবসানের দ্বারা মানুষের সামাজিক মুক্তির পথ প্রশস্ত হলেই স্বাধীনতা সম্ভব। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং সাম্যবাদী সমাজে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। ধনবৈষম্যমূলক বা শ্রেণীবৈষম্যমূলক সমাজে কখনই কোনভাবে সমাজের সকল মানুষ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। সাম্যবাদী সমাজে মানুষের জীবিকার সঙ্গে শ্রমের কোন ওতপ্রোত সম্পর্ক থাকে না। তখন বৈষয়িক সম্পদের প্রাচুর্য সৃষ্টি হয়। তার ফলে প্রত্যেকের স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণ হয়। এ রকম অবস্থায় মানুষের শ্রম হবে স্বাধীন ও প্রীতিপদ। মানবসমাজের ক্রমবিকাশের এই চূড়ান্ত স্তরে প্রত্যেক মানুষ প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে।
Leave a comment