মার্কসীয় ধারণা: স্পিনোজা (Spinoza), রুশো (Rousseau), কাণ্ট (Kant) এবং হেগেল (Hegel) প্রমুখ দার্শনিক স্বাধীনতা সম্পর্কিত ঐতিহ্যপূর্ণ ধারণাকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এই শ্রেণীর দার্শনিকদের স্বাধীনতার ধারণাকে মার্কসবাদ ব্যাপকতর ও সমৃদ্ধতর রূপ প্রদান করেছে। সাবেক ধারণা অনুসারে স্বাধীনতা হল আত্মনিয়ন্ত্রণ। মার্কস ও এঙ্গেলস্ স্বাধীনতার প্রথম বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মানুষ এবং ইতিহাসের বিষয়গত নিয়মাবলীর মধ্যে যে সম্পর্ক বর্তমান থাকে মার্কসবাদে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এবং এই ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার বিষয়টিকে বিচার-বিবেচনা করা হয়েছে। মার্কসবাদীদের কাছে স্বাধীনতার সমস্যাটি হল মূলত একটি সামাজিক সমস্যা। তাঁদের কাছে স্বাধীনতা একটি ইতিবাচক ও মানবিক ধারণা। হার্বার্ট আপথেকার তাঁর The Nature of Democracy, Freedom and Revolution শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “In contrast to the bourgeois theory of freedom, the Marxist does not view it negatively, but, rather, positively.” মার্কসবাদীরা স্বাধীনতাকে রাজনীতিক স্বাধীনতা বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হিসাবে বিচার-বিবেচনা করেন না।
স্বাধীনতা নেতিবাচক নয়—নিয়ন্ত্রণবিহীনতা নয়: হার্বার্ট আপথেকার স্বাধীনতা সম্পর্কে বুর্জোয়া ধারণার সঙ্গে পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতা সম্বন্ধে মার্কসীয় ধারণাকে ব্যাখ্যা করেছেন। আপ্থেকারের অভিমত অনুসারে স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া তত্ত্বে ব্যক্তির উপর থেকে নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতি এবং সরকারের উপর নিয়ন্ত্রণের উপস্থিতিকেই স্বাধীনতা হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। এই তত্ত্ব অনুসারে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হল স্বাভাবিক এবং কাম্য ব্যবস্থা। তাছাড়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চিরস্থায়িত্ব অভিপ্রেত এবং অবশ্যম্ভাবী। রাষ্ট্রীয় বা সরকারী ক্ষমতার প্রসার মাত্রই ব্যক্তির জীবনে হস্তক্ষেপ করে। তার ফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার স্বাভাবিকত্ব নষ্ট হয়। এই স্বাভাবিকত্বকে বজায় রাখার জন্য দরকার হল সরকারী ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ। ব্যক্তির উপর নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি কর্তৃক সরকারকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই তা অর্জিত হতে পারে। সুতরাং বুর্জোয়া তত্ত্ব অনুসারে স্বাধীনতার ধারণা নেতিবাচক। আপ্থেকার বলেছেন: “The negative quality of the bourgeois theory springs from its view of capitalism as a natural and altogether salutary system.” কিন্তু মার্কসবাদ পুঁজিবাদের স্বাভাবিকত্ব ও চিরস্থায়িত্বে বিশ্বাসী নয়। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি এক্ষেত্রে পুরোপুরি পৃথক প্রকৃতির। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা স্বাভাবিক ও কল্যাণকর নয়। এ হল কৃত্রিম ও পরগাছা (artificial and parasitic) প্রকৃতির। আপৃথেকার বলেছেন: “The Marxist view is altogether different. It sees capitalism not as natural and beneficient, but as artificial and parasitic.” তাই মার্কসবাদ পুঁজিবাদের রূপান্তরের অবশ্যম্ভাবিতায় বিশ্বাসী। সামন্ততন্ত্রের তুলনায় পুঁজিতন্ত্রে স্বাধীনতা সম্প্রসারিত হয়। কিন্তু এখানে স্বাধীনতাকে সম্প্রসারিত করার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং সরকারী হস্তক্ষেপ একান্তভাবে আবশ্যক। অর্থাৎ ক্ষমতা মাত্রই অশুভ নয়। রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা হল শ্রেণীমুখী। বুর্জোয়া তত্ত্ব অনুসারে আর্থনীতিক বনিয়াদের স্বাভাবিকতার ধারণাকে স্বীকার করে নিলে স্বাধীনতার সমস্ত বিষয়টি হবে নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতি। অপরদিকে মার্কসীয় দর্শন অনুসারে আর্থনীতিক বনিয়াদটির শোষণমূলক প্রকৃতির ধারণাকে স্বীকার করে নিলে, স্বাধীনতা লাভের সমস্ত বিষয়টি হবে সংশ্লিষ্ট আর্থনীতিক বনিয়াদকে পরিবর্তনের উদ্যোগ। আপথেকারের অভিমত হল: “… while the bourgeois theory of freedom focuses upon the absence of restraint upon the individual and the presence of restraint upon the government, the focus of the Marxist theory is opposite.”
আর্থনীতিক স্বাধীনতার প্রাধান্য: বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের মতানুসারে স্বাধীনতার প্রয়োজন শুধুমাত্র রাজনীতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ আর্থনীতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা অপ্রাসঙ্গিক। এর কারণ হল বুর্জোয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে একটি স্বাভাবিক ব্যবস্থা হিসাবে মনে করে এবং তাদের কাছে পুঁজিতন্ত্র হল আর্থনীতিক স্বাধীনতা। কিন্তু মার্কসবাদে পুঁজিতন্ত্রকে কৃত্রিম, পরগাছা ও ইতিহাস নির্দিষ্ট ব্যবস্থা হিসাবে দেখা হয়। মার্কসবাদীদের মতানুসারে পুঁজিতন্ত্রের অর্থনীতিকে বৈশিষ্ট্যযুক্ত করে বলপ্রয়োগ, স্বাধীনতা নয়। মার্কসবাদীদের আরও অভিমত হল যে, যে-কোন সমাজব্যবস্থার প্রকৃতি চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয় তার আর্থনীতিক ভিত্তির দ্বারা। আপৃথেকার বলেছেন: “… in Marxist theory the economic relations fundamentally determine societal characteristics and content and therefore these relations have the closest connection with question of freedom.” এই ধারণা অনুসারে পুঁজিতন্ত্রের রূপান্তর কাম্য এবং তা অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং স্বাধীনতার ধারণাটিকে কেবলমাত্র রাজনীতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। পুঁজিতন্ত্রের কৃত্রিম ও পরগাছা চরিত্রকে অতিক্রম করে সমাজব্যবস্থাকে অধিকতর মানবিক এবং সকলের উপযোগী করে তোলা দরকার এবং তার জন্য রাজনীতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতাকে আর্থনীতিক ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত করা দরকার। এই বক্তব্যের মাধ্যমে স্বাধীনতা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণার অভিব্যক্তি ঘটেছে। তাছাড়া মার্কসবাদীর কাছে স্বাধীনতা বিষয়টি শুধুমাত্র একটি রাজনীতিক বিষয় নয়; এ হল মানবিক এবং কাজে কাজেই সামাজিক। এই প্রসঙ্গে আপথেকারের অভিমত হল: “The problem of freedom to Marxist is human and therefore societal ; it is not simply political.” মার্কসবাদীদের কাছে স্বাধীনতার একটা সামগ্রিকতা রয়েছে। সুতরাং আংশিক ও বিমূর্ত উপভোগের মাধ্যমে তা ফলপ্রসু ও অর্থবহ হয় না। আপ্থেকারের অভিমত অনুসারে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি হল দ্বান্দ্বিক। এই কারণে তা আলাদা আলাদাভাবে খণ্ডিত হয়। আপৃথেকার বলেছেন: “…therefore, in freedom, as in everything else, it sees the question as a unity and as a whole, not as a abstraction and as a part.”
অসাম্য স্বাধীনতার বিরোধী: বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা আর্থনীতিক অসাম্যকে মুক্ত সমাজের একটি লক্ষণ বা গুণ হিসাবে প্রতিপন্ন করে থাকেন। কিন্তু মার্কসবাদীদের কাছে এটা মুক্ত সমাজের নয়, অমুক্ত সমাজেরই লক্ষণ। এর ফলে সমাজের বিত্তহীন দরিদ্র মানবগোষ্ঠীর রাজনীতিক, আইনগত ও আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার স্বীকৃতির কোন বাস্তব উপযোগিতা থাকে না। মার্কসবাদিগণ আর্থনীতিক অসাম্যকে স্বাধীনতার লঙ্ঘন হিসাবে নিন্দা করেছেন। মার্কসবাদীদের মতানুসারে কেবল সমতাবাদী সমাজে (equalitarian society) প্রকৃত স্বাধীনতার বাস্তবায়ন সম্ভব। মার্কসবাদে আর্থনীতিক অসাম্যকে অমুক্ত সমাজেরই একটি প্রলক্ষণ হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়। আপথেকার বলেছেন: “In Marxist theory economic inequality is viewed as an attribute of an unfree society.” মার্কসবাদ হল মূলত সাম্যতন্ত্রী (“Marxism is basically equalitiarian.”)। আয়ের গুরুতর বৈষম্যকে মার্কসবাদে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। আয় বৈষম্যের দূরীকরণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরোধী: হার্বার্ট আপথেকার উল্লেখ করেছেন যে, স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু মার্কসবাদী তত্ত্বে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এর পিছনে দুটি কারণ বর্তমান। (১) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ হল মূলত উৎপাদনের মালিকদের একটি বিলাস। এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে মানুষের সৃজনশীল সম্ভাবনার সত্যকার বিকাশ সাধনের প্রচেষ্টার পরিবর্তে এর মধ্যে অধিকতর দায়িত্বহীনতা ও সুখবাদী মনোভাব (hedonism) বর্তমান। (২) প্রকৃতিগত বিচারে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ হল স্বগোত্রভূজ (Cannibalistic) এবং আধুনিক জীবনের উন্নত সমাজীকৃত প্রকৃতির সঙ্গে, সমাজের যৌথ প্রয়োজনের সঙ্গে বিরোধমূলক। সমাজের সমষ্টিগত প্রয়োজনের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সংঘাত সৃষ্টি হয়। তার ফলে ব্যবহারিকতা অধিকতরভাবে নীতি থেকে বিচ্যুত হয়। এইভাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অপরাধবোধ, মানসিক অবসাদ বা বিশ্বনিন্দাবাদ (Cynicism)-এর জন্ম দেয়। এর ফলে আচার-আচরণের ক্ষেত্রে সমাজবিরোধিতা এবং বিপর্যয়ের পৌনঃপুনিকতার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। মার্কসবাদীদের মতানুসারে মানুষের চরিত্রের উপর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পচনশীল, ক্ষয়কর প্রভাব বর্তমান। শোষক শ্রেণীর দমন-পীড়ন নিঃস্ব ও অত্যাচারিত জনগণকে দুর্বল করে তোলে। মানুষ সম্পর্কে বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গি হল নৈরাশ্যবাদী, কিন্তু মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি আশাবাদী। আপথেকার বলেছেন: “The Marxist view of human beings generally is an optimistic one, the dominant bourgeois outlook is rather gloomy.”
শ্রেষ্ঠতাবাদের বিরোধী: হার্বার্ট আপথেকার উল্লেখ করেছেন যে সকল শ্রেণীবিভক্ত সমাজ এবং পুঁজিবাদী সভ্যতা শ্রেষ্ঠতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। আপথেকার বলেছেন: “All class divided societies and notably capitalism have taken a basically elitist view of civilization.” কিন্তু মার্কসবাদ শ্রেষ্ঠতাবাদ ও শ্রেষ্ঠ জাতিবাদের বিরোধী (“Marxism rejects elitism and racism root and branch.”)। আপৃথেকারের অভিমত অনুসার মার্কসবাদ একই সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত শ্রেষ্ঠতাবাদ (elitism) ও জাতি শ্রেষ্ঠতাবাদকে (racism) স্বাধীনতার বিরোধী ও স্বাধীনতার অস্বীকৃতি বলে মনে করে। শ্রেষ্ঠতাবাদ ও জাতিবিদ্বেষ মানবজাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ আদর্শকে বিশ্বের শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত এবং রাজনীতিক ও বৈষয়িক সম্পদভাণ্ডার থেকে বঞ্চিত রাখে। এবং এর অর্থই হল মানবজাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাধীনতার অস্বীকৃতি।
স্বতঃস্ফূর্ততার বিরোধী: বুর্জোয়া তত্ত্বে স্বাধীনতার অন্যতম উপাদান হিসাবে স্বতঃস্ফূর্ততার কথা বলা হয়। এই ধারণা অনুসারে সমাজের পরিকল্পিত বিকাশ ব্যক্তিগত উদ্যোগের স্বতঃস্ফুর্ততাকে ক্ষুণ্ণ করে। এই কারণে পরিকল্পনাকে স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে মনে করা হয়। কিন্তু মার্কসবাদীদের অভিমত অনুসারে এই ধারণা ভ্রান্ত। এঙ্গেলস্ উল্লেখ করেছেন যে, মুক্ত ও অনির্ধারিত ইচ্ছার মধ্যে স্বাধীনতা নেই। তিনি তাঁর Anti Duhring গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, ‘প্রাকৃতিক নিয়ম থেকে মুক্ত হওয়ার স্বপ্নে স্বাধীনতা থাকে না; স্বাধীনতা থাকে নিয়ম সম্পর্কে জ্ঞানলাভের মধ্যে, এ-জ্ঞানলব্ধ নিয়মকে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে প্রণালীবদ্ধভাবে প্রয়োগ করার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি করে তার মধ্যে’। তিনি বলেছেন: “Freedom does not consist in the dream of independence of natural laws but in the knowledge of these laws, and in the possibility this gives of systematically making them work towards definite ends.” তাঁর মতানুসারে ইচ্ছার স্বাধীনতার অর্থ হল বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। তিনি বলেছেন: “Freedom of the will means nothing but the capacity to make decisions with real knowledge of the subject.”
আপথেকারের সীমাবদ্ধতা: হার্বার্ট আপথেকার স্বাধীনতা সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণার ইতিবাচক ও দৃষ্টিভঙ্গিগত দিকটির উপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু আপথেকার স্বাধীনতা সম্বন্ধে মার্কসীয় মতবাদকে সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরতে পারেননি। তিনি স্বাধীনতা সম্পর্কিত মৌল মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে যুক্তিসঙ্গতভাবে বিকশিত করেননি। মার্কসবাদীরা স্বাধীনতাকে কেবলমাত্র একটি ইতিবাচক, সামাজিক ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা হিসাবেই দেখেননি। তাঁদের মতানুসারে স্বাধীনতার একটি ঐতিহাসিক বিকাশশীল চরিত্র আছে। এঙ্গেলস স্বাধীনতার মার্কসীয় সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর মতানুসারে, ‘আমাদের নিজেদের উপর এবং বহিঃপ্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ— স্বাভাবিক অবশ্যম্ভাবিতা সম্পর্কে জ্ঞানের ভিত্তিতে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ হল স্বাধীনতা। তিনি বলেছেন: “Freedom…..consists of the control over ourselves and over external nature which is founded on the knowledge of natural necessity.” এই নিয়ন্ত্রণ ও জ্ঞান অর্জিত হয় সমাজের ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের মাধ্যমে।
এঙ্গেলসের মতানুসারে ‘স্বাধীনতা হল অপরিহার্যতার স্বীকৃতি’। অনিবার্যতার ধারণাটি সম্বন্ধে লেনিনের অভিমত উল্লেখ করা দরকার। তাঁর মতানুসারে ‘অনিবার্যতার ধারণার সারকথা হল যে মানুষের কর্ম ইতিহাস নিয়ন্ত্রিত; এ ধারণা মুক্ত ইচ্ছার আজগুবি গল্পকে বাতিল করে দেয়, কিন্তু কোনক্রমে মানুষের যুক্তি ও বিবেককে নস্যাৎ করে না। লেনিন বলেছেন: “The idea of determinism which postulates human acts are necessitated and rejects the absurd tale about free will, in no way destroys man’s reason or appraisal of his actions.”
স্বাধীনতা সম্পর্কিত মার্কসীয় মতবাদের সারকথা: মুক্ত ইচ্ছার মধ্যে অথবা কেবল রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান রূপে স্বাধীনতা থাকে না। তখনই মানুষ প্রকৃত স্বাধীন হয়ে ওঠে যখন সে বিষয়গত অবশ্যম্ভাবিতা সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করে এবং সে যা করছে সে বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে সচেতন হয়ে কাজ করতে পারে। সুতরাং মানুষের স্বাধীনতা আছে তার জীবনের অবস্থাগুলিকে নিয়ন্ত্রণের যোগ্যতা এবং প্রয়োজন ও যাবতীয় আকাঙ্ক্ষা পুরণের সামর্থ্যের মধ্যে। তা সম্ভব হয় যখন তার প্রয়োজন ও যাবতীয় আকাঙ্ক্ষা বিচারবুদ্ধিযুক্ত হয়। এর জন্য প্রয়োজন হল উৎপাদনের শক্তিসমূহের উপর প্রভুত্ব। এবং তার প্রয়োজন হল পর্যাপ্ত প্রযুক্তি এবং সেই রকম উৎপাদনী বা আর্থনীতিক সম্পর্ক যা এই সমস্ত উৎপাদিকা শক্তিসমূহ ব্যবহার করতে এবং তাদের বিকাশ সাধনে সক্ষম। ধনবৈষম্যমূলক সমাজ হল শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। এই শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শ্রেণীশোষণ অব্যাহত থাকে। এবং শ্রেণীশোষণ বর্তমান থাকলে স্বাধীনতা থাকতে পারে না। এই বিশ্বসংসার এবং সমাজের ক্রমবিবর্তনের অপরিহার্য নিয়মগুলিকে মানুষ বদলে দিতে পারে না। কিন্তু এই সমস্ত নিয়মের ব্যাপারে মানুষ যথার্থ ধারণা বা জ্ঞান অর্জন করতে পারে। সমাজ পরিবর্তনের এই সমস্ত আবশ্যিক নিয়ম মানুষ অনুধাবন করতে পারলে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে। এই বস্তুজগৎ ও সমাজ সম্পর্কে মানুষের সুস্পষ্ট জ্ঞান আবশ্যিকতার দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয়। এবং তার ফলে ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণের পথ সুগম হয়। এই কারণে স্বাধীনতা হল ‘আবশ্যিকতার স্বীকৃতি। মনীষী মার্কস (Karl Mark) বলেছেন: “The true realm of freedom…can blossom forth only with this realm of necessity as its basis.” মার্কসবাদে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত জীবনের কথা বলা হয়। মার্কসবাদীরা ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মাধ্যমে স্বাধীনতাকে বিচার-বিশ্লেষণের কথা বলেন। এই কারণে এঙ্গেলস্ (Engels)-এর অভিমত অনুসারে স্বাধীনতা হল ‘ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফল’ (a product of historical development)।
মানুষ ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতার পথে এগোচ্ছে: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানবজাতি ক্রমশ স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে চলেছে। এঙ্গেলসের কথায়: “Each step forward in civilization was a step towards freedom.” পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণাধীনে মানবমুক্তির বিষয়গত বিভিন্ন শর্ত বহুলাংশে তৈরী হয়েছে। মানবসমাজের শ্রেণীবিভক্তি, ব্যক্তিগত বিষয় সম্পত্তির অস্তিত্ব এবং শ্রেণী আধিপত্যের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে তা আনুষ্ঠানিক রূপ ধারণ করে থাকে। যদি এই অবস্থাকে অতিক্রম করতে হয় তা হলে দরকার পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার জায়গায় এক সমিতির স্থানগ্রহণ। এই সমিতির মধ্যে “প্রত্যেকটি লোকেরই স্বাধীন বিকাশ হবে সকলের স্বাধীন বিকাশের শর্ত।” এর প্রকৃতি সম্পর্কে বলা হয়েছে: “It is association of individuals (assuming the advanced stage of modern productive forces of course) which puts the conditions of the free development and movement of individuals under their control.” এই অবস্থাতেই ঐতিহাসিক অপরিহার্যতা ( historical necessity) এবং ব্যক্তির ইচ্ছার মধ্যে বিষয়গত (objective) সহ-সম্পর্কের সৃষ্টি সম্ভবপর। একমাত্র এই রকম সমাজে ব্যক্তি মানুষ তার সহজাত গুণাবলীকে সব দিক থেকে অনুশীলন বা সংস্কৃত (cultivate) করার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয় যে মার্কস ও এঙ্গেলস্ প্রথম স্বাধীনতার বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁরা অর্থনীতি, ইতিহাস ও সমাজ পরিবর্তনের গতিবিজ্ঞান অধ্যয়ন করেছেন এবং দেখিয়েছেন কেন ইতিহাস স্বাধীনতার লক্ষ্যে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। উপরের আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে স্বাধীনতা সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা হল মানবিক, সামাজিক এবং ইতিবাচক।
Leave a comment