স্বাধীনতার ধারণা উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত:
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বাধীনতার ধারণা সম্পর্কিত আলোচনা বিরতিবিহীন বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বস্তুতপক্ষে আলোচনার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও সাম্যকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্য কোন বিষয়ের আলোচনাকে নিয়ে এ ধরনের মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়নি। হার্বার্ট আপথেকার পুঁজিবাদী সমাজের বিন্যাসের ভিত্তিতেই স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া তত্ত্বের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন এবং এর মূল্যায়ন করেছেন। পুঁজিবাদী সমাজের উৎপাদন-সম্পর্কের মাধ্যমেই স্বাধীনতা সম্পর্কে বুর্জোয়া ধারণা ব্যাখ্যা করা যায়। পুঁজিবাদী মতাদর্শ হল বুর্জোয়াদের শ্রেণী-স্বার্থের সংরক্ষণ। এই কারণে স্বাধীনতার ধারণাও সংশ্লিষ্ট উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে থাকে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলা দরকার। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা হয় যে যাবতীয় সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি হল উৎপাদন সম্পর্ক। সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক সকল সম্পর্ক উৎপাদন সম্পর্কের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। স্বাধীনতা হল একটি সামাজিক প্রক্রিয়াবিশেষ। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যক্ত হয়। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় উৎপাদন-উপাদানের মালিক শ্রেণীর স্বার্থেই সমগ্র আর্থনীতিক ব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে থাকে। এই কারণে এই ব্যবস্থায় স্বাধীনতার ধারণাও শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের অনুপন্থী হয়ে থাকে।
বুর্জোয়া স্বাধীনতার বৈশিষ্ট্য:
হার্বার্ট আপথেকার স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া ধারণা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর The Nature of Democracy, Freedom and Revolution শীর্ষক গ্রন্থটি একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ রচনা হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। এই গ্রন্থে স্বাধীনতা সম্পর্কে বুর্জোয়া তত্ত্ব প্রসঙ্গে আপ্থেকার যে আলোচনা করেছেন তা নিম্নলিখিতভাবে বিন্যস্ত করা যায়:
(ক) নিয়ন্ত্রণবিহীনতা বা নেতিবাচক স্বাধীনতা: সাবেক বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বাধীনতার ধারণার প্রথম উপাদান হল স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতি হিসাবে দেখা। আপ্থেকার বলেছেন: “The first component, then, of the concept of freedom in the classical bourgeois outlook is to see freedom as absence of restraint.” স্বাধীনতার বুর্জোয়া ধারণা হল একটি নেতিবাচক ধারণা। এখানে স্বাধীনতা বলতে যাবতীয় বাধার অপসারণকে বোঝান হয়। স্বাধীনতাকে বিবেচনা করা হয় সরকার কি করতে পারে না সেই অর্থে। অর্থাৎ শক্তি ও শক্তি প্রয়োগের বিরোধিতার অর্থে। রাষ্ট্রক্ষমতা বা নিয়ন্ত্রণকে স্বাধীনতার বিরোধী বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতির মধ্যেই স্বাধীনতার অস্তিত্ব বর্তমান থাকে। সুতরাং সরকারের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা যত কম হয় স্বাধীনতার পরিমাণ তত বেশী হয়।
(খ) নিয়ন্ত্রিত সরকার: নাগরিকগণ ঠিক সেই মাত্রা পর্যন্ত স্বাধীন যতটা তারা নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতি উপভোগ করে থাকে। এই ধারণার সঙ্গে একটি অনুসিদ্ধান্ত স্বাভাবিকভাবে এসে পড়ে। এই অনুসিদ্ধান্তটি হল সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ সরকারের ক্ষমতাকে সীমিত করা প্রয়োজন। এখানে নিয়ন্ত্রিত সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। বুর্জোয়া তত্ত্বে ক্ষমতাকে স্বাধীনতার শত্রু বলে মনে করা হয়। এই কারণে ক্ষমতা যতটা সংকুচিত হয়, স্বাধীনতাও ততটা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ ক্ষমতা সংকোচনের সঙ্গে স্বাধীনতার পরিমাণের আনুপাতিক সম্পর্ক বর্তমান। এই কারণে বুর্জোয়া তাত্ত্বিকগণ সর্বপ্রকার প্রতিবন্ধকতার অবসানের পক্ষপাতী। তাই তাদের মতানুসারে সরকারী ক্ষমতার উপর বিধি-নিষেধ আরোপিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ সরকারের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করা দরকার। বুর্জোয়া তত্ত্ব অনুসারে সভ্যতার মৌলিক উপাদান হল উৎপাদনের উপকরণের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা। সুতরাং এর সংরক্ষণই হল সরকার ও রাষ্ট্রের মুখ্য দায়িত্ব। ব্যক্তিগত মালিকানার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ অনাবশ্যক। সরকারের শাসন যত কম হয়, তত ভাল। এ ধরনের একটি ব্যবস্থা যখন আছে তখন নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, সরকারই হল এক অপরিহার্য অমঙ্গল বিশেষ। আপৃথেকারের কথায়, “…since the system has been discovered the less government, the better. Indeed, with such a system, government itself is but a necessary evil.” এক্ষেত্রে বুর্জোয়া স্বাধীনতার অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয় হিসাবে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার উপর থেকে যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ অপসারণের কথাই বলা হয়েছে।
(গ) বুর্জোয়া স্বাধীনতা রাজনীতিক: বুর্জোয়া তত্ত্ব অনুসারে স্বাধীনতার ধারণা হল একটি রাজনীতিক ধারণা। বুর্জোয়া তত্ত্বে অপর সকল স্বাধীনতার উৎস হিসাবে রাজনীতিক স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আর্থনীতিক জীবন ও আর্থনীতিক স্বাধীনতার সঙ্গে এর কোন রকম সম্পর্ক থাকে না। আপথেকারের মতে: “..classically, freedom is purely political; has no relevance to the economic. ” আর্থনীতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতার কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই। বুর্জোয়া তত্ত্বে পুঁজিবাদকেই আর্থনীতিক স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়। পুঁজিবাদ হল অর্থনীতির ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্য। বুর্জোয়া সমাজে আর্থ-সামাজিক স্বাধীনতার স্বীকৃতি অসম্ভব। কারণ সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মালিকানা ও আর্থনীতিক শোষণের অবসান ঘটাতে হবে। এবং তা করতে গেলে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের অবসান ঘটাতে হবে।
(ঘ) অসাম্য ও স্বাধীনতা: ‘অসাম্যের অস্তিত্ব’ স্বাধীনতায় সম্পর্কে বুর্জোয়া ধারণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়। বুর্জোয়া স্বাধীনতায় সাম্যের ধারণা হল নিছক আইনগত। বুর্জোয়া সাম্যের এই ধারণাকে রাজনীতিক ক্ষেত্রেও পুরোপুরি প্রয়োগ করা হয় না। বুর্জোয়া তত্ত্বে বস্তুগত অধিকারের ক্ষেত্রে অসাম্যের অস্তিত্বকে একটি স্বাধীন সরকারের প্রমাণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। স্বাধীনতার এই ধারণা অনুসারে ব্যক্তির দক্ষতা ও সামর্থ্যের উপর সম্পদ অর্জন নির্ভরশীল। যেখানে একটি স্বাধীন সরকার এবং একটি স্বাভাবিক আর্থনীতিক ব্যবস্থা অর্থাৎ পুঁজিবাদ বর্তমান সেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি কোনরকম বাধানিষেধ ছাড়াই তার যাবতীয় যোগ্যতার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করতে পারে। অর্থাৎ একটি স্বাধীন সরকারের আওতায় আর্থনীতিক অসাম্যের অস্তিত্বই স্বাভাবিক। সুতরাং আর্থনীতিক অসাম্য হল রাজনীতিক স্বাধীনতার অস্তিত্বের একটি প্রমাণ। অর্থাৎ স্বাধীনতা হল শুধু রাজনীতিক। অনুরূপভাবে রাজনীতিক স্বাধীনতার ভিত্তি হিসাবে আর্থনীতিক বৈষম্য হল গুরুত্বপূর্ণ। আপৃথেকারের কথায়: “Economic inequality, then, was a hall-mark of the existence of political freedom which is to say freedom, for freedom was only political,” পুঁজিবাদ অনুসারে এই অসাম্য হল সভ্যতার মানদণ্ড। বুর্জোয়া তত্ত্বে এইভাবে আর্থনীতিক অসাম্যকে স্বাধীনতার মাপকাঠি হিসাবে স্বীকার করা হয়েছে। সামাজিক অসাম্যের বৈধকরণই হল এই তত্ত্বের মুখ্য উদ্দেশ্য। বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের মতানুসারে আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের অন্য কোনভাবেই সমাজব্যবস্থাকে দায়ী করা যায় না। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের মূল কারণ হল সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে মানুষের দক্ষতার তারতম্য। এবং এই বিষয়টি হল একটি জন্মগত বিষয়। এ হল প্রকৃতিদত্ত।
(ঙ) স্বতঃস্ফূর্ততা: বুর্জোয়া স্বাধীনতার ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ততাকে স্বাধীনতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। আপথেকারের কথায়: “Spontaneity is viewed as important to freedom in the sense that when action is fortuitous it is devoid of compulsion, restraint and regulation.” বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের মতানুসারে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হল একটি প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক ব্যবস্থা। সমাজের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া এ কোন কৃত্রিম ব্যবস্থা নয়। সুতরাং পুঁজিবাদী শোষণ-পীড়নও আরোপিত নয়। বস্তুত বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের উদ্দেশ্য হল পুঁজিবাদের বৈধতা ও চিরন্তনতা প্রমাণ করা। তাঁরা এই কথা প্রতিষ্ঠিত করতে চান যে পুঁজিবাদ হল একটা প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা মানুষের ইচ্ছার বাইরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছে। স্বতঃস্ফূর্ততাই হল স্বাধীনতার সংক্ষিপ্তসার, এ রকম দাবি করা হল আরেকটি পদক্ষেপবিশেষ। এখানে ক্ষমতাকেই বৈরিতার চোখে দেখা হয়ে থাকে। আপ্থেকার বলেছেন: “…the planned or organised exercise of control of direction the opposite of spontaneity, must be the foe of freedom.” যেহেতু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষের ইচ্ছায় গড়ে উঠেনি, তাই মানুষ একে পরিবর্তন করতে পারে না। বস্তুত বুর্জোয়া চিন্তাবিদ্গণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উৎপত্তির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করেছেন।
(চ) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ: স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া তত্ত্বে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীর ধারণার উপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। পুঁজিবাদের রাজনীতিক আদর্শ হিসাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উপর জোর দেওয়া হয়। আপথেকারের অভিমত হল: “The emphasis upon individualism also follows very logically from all the postulates of the bourgeois theory of freedom.” এই তত্ত্ব অনুসারে প্রত্যেকটি বিষয়ই হল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এর মূল উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিকে নিজের ইচ্ছা ও উদ্যোগ অনুসারে পরিচালিত হওয়ার স্বাধীনতা প্রদান। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদী মতাদর্শের ভিত্তিতেই স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া ধারণা বিকশিত হয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশের উপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু এই ব্যক্তিত্ব নিপীড়িত শোষিত সাধারণ মানুষের ব্যক্তিত্ব নয়। এ হল উৎপাদনের উপাদানের মালিক শ্রেণীর ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া তত্ত্বে পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থের উপরই গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই শ্রেণীর স্বার্থকেই সামাজিক স্বার্থ হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়। এবং যথার্থ সামাজিক কল্যাণ ও সামাজিক স্বার্থকে অবহেলা করা হয়। এই তত্ত্বে যৌথ সামাজিক উদ্যোগের ধারণাকে উপেক্ষা করা হয়।
(ছ) শ্রেষ্ঠতাবাদ: উপরিউক্ত বক্তব্যসমূহের যুক্তিসঙ্গত সম্প্রসারণ থেকেই শ্রেষ্ঠতাবাদের প্রতি এক দৃঢ় প্রত্যয়ের সৃষ্টি হয়। যেখানেই শ্রেণীভিত্তিক স্তরবিন্যাস থাকে সেখানেই শ্রেষ্ঠতাবাদ হল মুখ্য চিন্তাধারার বুনিয়াদবিশেষ। এই মতবাদে বাছাই করা মুষ্টিমেয় ব্যক্তির শাসনকেই শ্রেষ্ঠ শাসন হিসাবে গণ্য করা হয়। আপথেকারের মতানুসারে স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া ধারণা মূলত মুষ্টিমেয় বাছাই করা লোকের শাসন ও জাতিবিদ্বেষের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই তত্ত্বের আসল কথা হল মালিক ও শোষক-শ্রেণীর মুষ্টিমেয় ব্যক্তির আর্থনীতিক স্বার্থ সংরক্ষণ করা দরকার। এবং এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ক্ষমতাসীন মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতেই রাজনীতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকা আবশ্যক। এই কারণে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এক বিশেষ প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এই প্রবণতাটি হল আর্থনীতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এবং তদনুসারে রাজনীতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ। আপথেকারের ভাষায়: “…those who are on top must be on top not because of caste or inheritance or other artificial contrivances but because of superior ability. Hence has been achieved the true aristocracy and the natural elite; all the supposed to be self made and really the victors in a fair contest.” পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রেষ্ঠতাবাদের দ্বৈত বিকাশ দেখা যায়। (১) উৎপাদনের উপকরণের মালিকরা দেশের ভিতরে জনগণের অবশিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের থেকে অধিকতর বিশিষ্ট গুণের অধিকারী এই মর্মে ধারণা সৃষ্টি করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, অক্ষমতা, নির্লিপ্ততা প্রভৃতিকে বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা বড় করে দেখান। এই সমস্ত কারণের জন্য তাঁরা জনসাধারণকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চান। তাঁরা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের শাসন ক্ষমতা প্রদানের নামে পুঁজিপতিদের হাতেই শাসন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে চান। আবার বাহ্যিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী শাসকগণ কৃষ্ণকায় মানবগোষ্ঠীর তুলনায় নিজেদের বিশিষ্ট ও বিচক্ষণ বলে মনে করে এবং জাহির করে। শ্রেষ্ঠতাবাদ (Elitism) বা বাছাই করা মুষ্টিমেয় মানুষের শাসন এবং জাতিবিদ্বেষ (Racism)-এর উপর স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া ধারণা প্রতিষ্ঠিত। সাম্রাজ্যবাদী জাতি নিজেকে মানবসভ্যতার আলোকবর্তিকাবাহী বলে মনে করেন। তারা জাতিবিদ্বেষ প্রচার করে। আপথেকার বলেছেন: “…..freedom in bourgeois theory and practice has been basically elitist and racist. It always has carried with it something of the wolf’s ‘freedom’ to eat the sheep; the freedom of the former is the death of the latter.” এইভাবে মৌলিক দিক থেকে স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া তত্ত্ব ও তার প্রয়োগের মধ্যে সবসময় মানবতাবিরোধী ধারণার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়।
বুর্জোয়া স্বাধীনতার সমালোচনা:
বর্তমানে স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া ধারণা বিরূপ সমালোচনার হাত এড়িয়ে যেতে পারেনি। এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে সমালোচকরা নানা রকম যুক্তির অবতারণা করে থাকেন। এই সমস্ত যুক্তির মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
(১) নেতিবাচক ধারণা সমর্থনযোগ্য নয়: বুর্জোয়া তত্ত্ব অনুসারে স্বাধীনতা বলতে নিয়ন্ত্রণবিহীনতাকে বোঝায়। স্বাধীনতা সম্পর্কিত এই ধারণা পুরোপুরি নেতিবাচক। কিন্তু এই নেতিবাচক ধারণাকে সমর্থন করা যায় না। ল্যাস্কি, বার্কার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্বাধীনতার এই নেতিবাচক ধারণাকে স্বীকার করেননি। বার্কারের অভিমত অনুসারে আইনসঙ্গত স্বাধীনতা কখনই অবাধ বা অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। সকল মানুষের জন্য স্বাধীনতা হল সব সময়ই নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা।
(২) স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর: স্বাধীনতা যদি নিয়ন্ত্রণবিহীন হয়, তাহলে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর মাত্র। এবং এই স্বাধীনতা সকল মানুষের স্বাধীনতা হতে পারে না। এ হল মুষ্টিমেয় বিত্তবান ও বলবান ব্যক্তির স্বাধীনতা। বুর্জোয়া স্বাধীনতার ধারণা স্বীকার করে নিলে বিত্তবানের দ্বারা বিত্তহীনের এবং সবলের দ্বারা দুর্বলের অত্যাচারকেও স্বীকার করে নিতে হবে। কিন্তু তা স্বীকার করে নেওয়া যায় না। সুতরাং স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া ধারণা অমানবিক।
(৩) বুর্জোয়া ধারণা আংশিক: বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা কেবলমাত্র রাজনীতিক স্বাধীনতাকেই স্বাধীনতার ভিত্তি হিসাবে গুরুত্ব প্রদান করেন। কিন্তু বাস্তবে আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক স্বাধীনতার সমন্বয়ের মাধ্যমে যথার্থ স্বাধীনতার ভিত্তিভূমি রচিত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীনতার ধারণা হল একটি সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ ধারণা। সুতরাং স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া ধারণা হল আংশিক।
(৪) স্বাধীনতা সংরক্ষণের অভাব: স্বাধীনতা সংরক্ষণের ব্যাপারে বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা মোটেই সতর্ক নন। বস্তুত বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় স্বাধীনতা সংরক্ষণের কোন পাকাপাকি ব্যবস্থা নেই। এই ধরনের সমাজে শ্রমজীবী জনতার স্বাধীনতা কার্যত সংরক্ষণহীন হয়ে অর্থহীন প্রতিপন্ন হয়। বুর্জোয়া সমাজের বিচারব্যবস্থা প্রাধান্যকারী পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার্থে পরিচালিত হয়।
(৫) শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার উপলব্ধি অসম্ভব: স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া তত্ত্বে কেবলমাত্র রাজনীতিক স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিন্তু অধ্যাপক ল্যাস্কি, বার্কার প্রমুখ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং মার্কসীয় ধারণায় বিশ্বাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ এই ধারণার বিরোধিতা করেন। কারণ আর্থনীতিক স্বাধীনতা ব্যতিরেকে রাজনীতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। শুধুমাত্র রাজনীতিক স্বাধীনতার উপলব্ধি এক অসম্ভব বিষয়।
(৬) ধর্মবৈষম্যমূলক সমাজে আইন বৈষম্যমূলক হয়: স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া ধারণা অনুসারে আইনের চোখে আনুষ্ঠানিক সাম্যকে বড় করে দেখা হয়। কিন্তু আর্থিক বৈষম্যের উপর ভিত্তিশীল সমাজে আইন কখনই যথার্থ সাম্য প্রতিষ্ঠার সহায়ক হতে পারে না। ধনবৈষম্যমূলক সমাজে রাষ্ট্র তথা আইন বৈষম্যমূলক হয়। এবং এই আইন বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে থাকে। এই রকম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় আইন কখনই সকল মানুষের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার সহায়ক হতে পারে না।
(৭) অপরের স্বাধীনতাহরণ: স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া ধারণার অর্থ হল সম্পত্তিবান শ্রেণীর দরিদ্র জনতাকে শোষণ করার অধিকার। এ হল নিজের নাম করে অপরের স্বাধীনতাকে হরণ করা।
(৮) স্বতঃস্ফূর্ততা স্বাধীনতা নয়: স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া তত্ত্বে স্বতঃস্ফূর্ততাকে স্বাধীনতা বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু মার্কসবাদীদের অভিমত অনুসারে এই ধারণা অবৈজ্ঞানিক ও ভ্রান্ত। মার্কসীয় ধারণা অনুসারে একমাত্র পরিকল্পিত অর্থব্যবস্থাতে প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
(৯) মাৎস্যান্যায়মূলক: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ হল পুঁজিবাদীদের আদর্শ। স্বাধীনতা সম্পর্কে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণাকেও স্বীকার বা সমর্থন করা যায় না। মার্কসবাদীদের অভিমত অনুসারে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে স্বাধীনতা শ্রেণীগত হয়ে থাকে। স্বাধীনতার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী তত্ত্বকে স্বীকার করার অর্থ হল মাৎস্যন্যায়কে স্বীকার করে নেওয়া। প্রকৃত প্রস্তাবে বুর্জোয়া স্বাধীনতা হল মুষ্টিমেয়ের স্বাধীনতা। সুতরাং স্বাধীনতার এই ধারণাকে স্বীকার করে নেওয়া যায় না।
(১০) মানবতাবিরোধী: স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া তত্ত্বে শ্রেষ্ঠতাবাদের কথা বলা হয়ে থাকে। তা ছাড়া এই তত্ত্বে জাতিগত উৎকর্ষ ও জাতিবিদ্বেষ প্রচার করা হয়। এই কারণে এই মতবাদ হল চূড়ান্তভাবে মানবতাবিরোধী। এই মানবতাবিরোধী মতবাদকে মেনে নেওয়া যায় না।
উপসংহার: স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া ধারণার পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কতকগুলি বিষয় স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়।
-
(ক) প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীনতার ধারণা হল সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ। সঠিক অর্থে স্বাধীনতার সৃষ্টি হয় আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক স্বাধীনতার সমন্বয়ে। কিন্তু বুর্জোয়া দার্শনিকরা স্বাধীনতার ভিত্তি হিসাবে রাজনীতিক স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। অথচ বাস্তবে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে পরাধীন ব্যক্তি রাজনীতিক বা সামাজিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। এই কারণে বুর্জোয়া স্বাধীনতা হল আংশিক স্বাধীনতা; একে প্রকৃত স্বাধীনতা বলা যায় না।
-
(খ) বুর্জোয়া ধারণা অনুসারে স্বাধীনতার অবাধ প্রসারের নামে পররাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও নাগরিক অধিকারকে বিপন্ন করার ঘটনা ঘটে।
-
(গ) প্রকৃত স্বাধীনতা সংরক্ষণের যথাযথ কোন ব্যবস্থা বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় দেখা যায় না। বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থবিরোধী রাজনীতিক বক্তব্য বা আন্দোলনকে বুর্জোয়া সমাজে সহ্য করা হয় না।
-
(ঘ) স্বাধীনতা সম্পর্কিত বুর্জোয়া ধারণার উদ্দেশ্য হল নিজেদের স্বাধীনতার স্বার্থে অপরের স্বাধীনতাকে অগ্রাহ্য করা।
Leave a comment