সূচনা: দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, দারিদ্র্য প্রভৃতি সমস্যায় জরাজীর্ণ সদ্য-স্বাধীন ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই করুণ হয়ে ওঠে। দারিদ্র্য, অনাহার, বেকারত্ব, শিক্ষার অভাব, চিকিৎসার অভাব প্রভৃতি ঘটনাগুলি ভারতের অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে প্রকট করে তােলে।

[1] দারিদ্র্য: ভারতবর্ষ প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে ছিল। এই সময় ভারতে ব্রিটিশদের তীব্র অর্থনৈতিক শােষণের ফলে ভারতের অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। ইংরেজরা ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় দেশ প্রায় নিঃস্ব হয়ে যায়। ফলে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করার পর দেশে চরম দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক সংকট নেমে আসে। ফলে দেশের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে চরম সংকট দেখা দেয়।

[2] শিল্পক্ষেত্রে সমস্যা: ভারতের স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে ভারত ভেঙে পৃথক পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। ফলে শিল্পের প্রয়ােজনীয় কাঁচামাল ও খাদ্যের জোগানে সমস্যা দেখা দেয়। পাটকলগুলি ভারতের ভূখণ্ডে (কলকাতার কাছে) পড়লেও পাট উৎপাদক কৃষিজমির অধিকাংশই পড়ে পূর্ব পাকিস্তানে। আবার বস্ত্র কারখানাগুলি ভারতের আমেদাবাদে এবং বােম্বাইয়ে পড়লেও শিল্পের প্রয়ােজনীয় তুলা উৎপাদক অঞ্চলগুলি পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে। ফলে ভারতে শিল্পের প্রয়ােজনীয় কাঁচামালের সমস্যা দেখা দেয়।

[3] বেকারত্ব: কাঁচামালের অভাবে ভারতের বিভিন্ন শিল্পগুলি সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং বেশ কিছু শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এসব কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়ে এবং দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রচুর উদ্বাস্তু ভারতে আশ্রয় নিলে বেকার সমস্যা আরও তীব্রতর হয়।

[4] খাদ্য সংকট: দেশভাগের ফলে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে ভারতের খাদ্য উৎপাদন কমে গিয়ে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পেলে খাদ্য সংকট আরও তীব্র হয়। তা ছাড়া পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু ভারতে আশ্রয় নিলে খাদ্যের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। কিন্তু খাদ্যের জোগান না বাড়ায় সংকট আরও বৃদ্ধি পায়।

[5] উদ্বাস্তু সমস্যা: দেশভাগের ফলে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ প্রভৃতি সম্প্রদায়ের বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। এই উদ্বাস্তুদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করতে গিয়ে ভারত সরকার প্রচণ্ড সমস্যার সম্মুখীন হয়। ফলে ভারতে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, কর্মসংস্থান প্রভৃতির আরও অভাব দেখা দেয়। উদ্বাস্তুদের জীবন-জীবিকা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে গিয়ে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। ফলে অর্থনৈতিক সমস্যা আরও তীব্রতর হয়।

[6] শিক্ষার অভাব: স্বাধীনতা লাভের পর অশিক্ষা ভারতীয় সমাজজীবনকে ব্যাপকভাবে দখল করে নেয়। ভারতীয়দের অর্থনৈতিক দরিদ্রতার ফলে ভারতের সমাজ অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে। আর্থিক সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশে দরিদ্র মানুষদের জন্য বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে দরিদ্র দেশবাসীর পক্ষে আধুনিক শিক্ষাগ্রহণে অর্থব্যয় ছিল বিলাসিতার শামিল।

[7] চিকিৎসার অভাব: সরকারি উদ্যোগে দেশের সাধারণ দরিদ্র মানুষের জন্য বিনা ব্যয়ে চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। ফলে গ্রামপ্রধান ভারতে বিপুল সংখ্যক অশিক্ষিত দরিদ্র মানুষ অচিকিৎসার শিকার হয়।

উপসংহার: স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু (শাসনকাল ১৯৪৭-১৯৬৪ খ্রি.) সক্রিয় উদ্যোগ নেন। তার উদ্যোগে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশন’ বা ‘যােজনা কমিশন’ (Indian Planning Commission) গঠিত হয় এবং ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এর ফলে ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াতে আরম্ভ করে।