‘সম্মুখে আজ যেন সমস্ত জগতের রথযাত্রা’— কোন প্রসঙ্গে এই মন্তব্য? উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

‘অতিথি’ গল্পে চির দুর্দম, চঞ্চল উন্মনাপ্রাণ তারাপদর উড়ুক্কু মন কোনো জায়গায় স্থায়িত্ব পেত না, তার মন জুড়ে থাকত দূরদূরান্তের হাতছানি। বিভিন্ন যাত্রাদল, কবিগানের দল, জিমন্যাস্টিকের দল ঘুরে অবশেষে কাঁঠালিয়ার জমিদার বাড়িতে ভিড়েছিল, কিন্তু মন তার চিরচঞ্চল তাই যখন কুড়ুলকাটার নাগবাবুদের এলাকায় বিখ্যাত রথযাত্রার মেলায় সারিবদ্ধভাবে নৌকাগুলি বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে পাড়ি দিচ্ছিল তখন সে তার বিবাগি মনকে স্থির রাখতে পারেনি—বিশ্বব্যাপী যে আনন্দ-সৌন্দর্যের রথযাত্রার আহ্বান। তার ডাকে সাড়া দিয়েছে তারাপদ।

আত্মভোলা, চিরচঙ্খল বিশ্বপ্রাণের অধিকারী তারাপদ চরিত্রটি। প্রকৃতিপ্রিয় উদাসীন চিত্তের এই কিশোরটি মানুষের সঙ্গে মেলামেশায় কোনো অন্তরাল রাখত না। সহজ সরলতায় সে সকলকে আপন করে নিত। দক্ষতার সঙ্গে সঙ্গীতশিক্ষা, বংশীশিক্ষা, জিমন্যাস্টিক শিক্ষা, হাল ধরা, দাঁড় টানা, ভিয়ান প্রস্তুত করা সবই শিখে নিয়েছিল। তার মন ছিল সুদূরের পিয়াসী। নির্দিষ্ট স্থানে সাধারণ মানুষের মতো একটানা বাস তার চরিত্রবিরোধী কাঁঠালিয়ার জমিদার বাড়ির জামাই হবার আহবানও সে তার মুক্ত নিষ্কাম চেতনায় দূরীভূত করে সেই সুদূরের আহ্বানে, সৌন্দর্যের পিপাসায় বিশ্ব আনন্দের জোয়ারে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল। তারাপদর যাযাবর অনিকেত মন অনির্দেশ্য পথের দুর্নিবার টানে বেরিয়ে পড়ে রথযাত্রার মেলা অভিমুখে, নদীবক্ষে চলমান অসংখ্য নৌকার শোভাযাত্রায় মুক্তপ্রাণের স্বাধীন চলা অনুভব করেছে চলাতেই। রথযাত্রা গতিময়তার প্রতীক, নদীও তাই ফলতঃ এই দুই অনুষঙ্গ ব্যবহারে স্বাধীন প্রাণের অবাধ চলাকেই প্রতীকায়িত করেছেন লেখক।

‘স্নেহ-প্রেম-বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্রবন্ধন তাহাকে চারিদিক হইতে সম্পূর্ণরূপে ঘিরিবার পূর্বেই সমস্ত গ্রামের হৃদয়খানি চুরি করিয়া একদা বর্ষার মেঘান্ধকার রাত্রে এই ব্রাহ্মণবালক আসক্তিবিহীন উদাসীন জননী বিশ্বপৃথিবীর নিকট চলিয়া গিয়াছে।’— তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

‘অতিথি’ গল্পটি রবীন্দ্রনাথের চিরন্তন বিশ্বসত্তার প্রতীকে চিত্রায়িত। গল্পটির প্রধান চরিত্র তারাপদ প্রকৃতিপ্রিয়, আনমনা, দূরযানী মনের অভিসারী। ছোটবেলা থেকেই সে বিশুদ্ধ প্রকৃতির আকর্ষণে মুগ্ধ। যাত্রাদল, কবিগান, সংগীতশিক্ষা, জিমন্যাস্টিক, বংশীশিক্ষা সবই প্রকৃতির সান্নিধ্যে সহজেই সে করায়ত্ত করেছে। কিন্তু স্নেহ-প্রেম-প্রীতির বন্ধন তাকে আটকাতে পারেনি। কাঁঠালিয়ার জমিদার মতিলালবাবু তাকে আশ্রয় দিয়েছিল পুত্রস্নেহে। সযত্নে লালনপালনও করেছে কিন্তু তাকে বাঁধতে পারেনি। সুদুরের প্রতি টান তাকে বারবার ঘরছাড়া করেছে।

ছোটবেলায় পিতৃহীন হলেও মা-ভাই-বোনেরা, পাড়া প্রতিবেশীরা এই সুন্দর চেহারার, হাস্যমুখ ছেলেটিকে আপন সন্তানের মতো ভালোবাসলেও যাত্রাদলের সঙ্গে চলে গেছে এক অনির্দেশ্য টানে। কাঁঠালিয়ার জমিদার মতিলালবাবু এবং তার স্ত্রী অন্নপূর্ণাদেবী সযত্নে সন্তানস্নেহে বশীভূত করার চেষ্টা করলেও তাদের মায়া কাটিয়ে অনির্দেশ্য পথের পথিক হয়েছে তারাপদ। মানুষের গণ্ডীবদ্ধ জীবন তার কাছে অপাঙক্তেয়, সহস্র প্রেমের বন্ধনে তাকে বশ করা যায় না, অর্থ সম্পদ দিয়েও তাকে বেঁধে রাখা যায় না। প্রকৃতি যেমন সদা পরিবর্তনশীল গতিময়, তারাপদও তাই। নৈসর্গিক চিত্রপটের সঙ্গে তারাপদর মিল উদ্ধৃত অংশটিতে তুলে ধরা হয়েছে। নদীপথ থেকে যে উদাসীন কিশোর একদিন ধনী জমিদার গৃহে এসেছিল, তার নিরাসক্ত মন সংসারের সব আকর্ষণ ফেলে শেষপর্যন্ত সেই নদীপথকেই আপন করে নিয়েছে। এই ‘archetypal image’-এর নান্দনিক ব্যঞ্জনা ‘অতিথি’ গল্পের সমাপ্তি অংশটিকে আলোকদীপ্ত করে তুলেছে।

‘পাখি কিছু কিছু গান শিখিল এবং একদিন প্রত্যুষে উড়িয়া চলিয়া গেল।’— কাকে ‘পাখি’ বলা হয়েছে? উদ্ধৃতাংশের সম্প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অতিথি’ ছোটগল্পে যাযাবর অনিকেত মনের অধিকারী তারাপদকে ‘পাখি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পাখি যেমন চঞ্চল, উড়ুক্কু তার পাখা, তারাপদর দূরযানি মনও তেমনি পক্ষ বিস্তার করে উড়ে চলে একস্থান থেকে অন্যস্থানে।

চঞ্চল বিশ্বপ্রাণের প্রতীক তারাপদর মন বশীভূত করতে পারে না কোনো স্থানই। প্রকৃতির অনাবিল শ্রোতরাশির মতো চলাতেই তার আনন্দ। সংসার জীবনের স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসাও তার গতিরোধ করতে পারে না। নিজের মনের আনন্দেই একস্থান থেকে অন্যস্থানে ঘুরে বেড়ায়, যাত্রাদলের সঙ্গে বা কবিগানের দল বা জিমন্যাস্টিকের দল সবেতেই অকৃত্রিম কৌতূহল। গানের সুরেও তার শিরার মধ্যে কম্পন তোলে, শিহরিত হয় তার মন ; ছোটো অবস্থাতেই সংগীতসভায় নিজেকে সুরের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে দুলে দুলে তা অনুভব করত। শুধু সংগীত নয় গাছের ঘন পল্লবের ওপর যখন শ্রাবণের বৃষ্টিধারা নেমে আসত তখন তারাপদর মন চঞ্চল হয়ে উঠত। সংগীতের প্রতি অগাধ আকর্ষণেই সে পাঁচালীর দলে যোগ দিয়েছিল, দলের অধ্যক্ষ তাকে পরম যত্নে সংগীত শিখিয়ে, পাঁচালী মুখস্থ করিয়ে সভার উপযুক্ত করে তুলেছিল। কিন্তু তারাপদ সেখান থেকেও চলে আসে প্রকৃতির আকর্ষণে, এক দূরযানি মনের হাতছানিতে। এখানে পাখির প্রতীকে তারাপদকে চিত্রিত করে তার উদ্বুদ্ধু মনেরই পরিচয় দিয়েছেন লেখক। একদিকে জীবনের গতিশীলতা, অন্যদিকে উদাসীন মানবমনের নিহিত নিরাসক্তির ব্যানা, একদিকে মুক্তমনের স্বাধীন বিচরণ, অন্যদিকে আসক্তি, বন্ধন এই দুয়ের বৈপরীতা বোঝাতেই পাখির তুলনা দিয়েছেন লেখক। পাখি এখানে A tandscape is the state of mind’।