স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকার নারীশিক্ষার সামগ্রিক উন্নতির জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তার মধ্যে প্রথম হল ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় নারী শিক্ষা কমিটি গঠন, শ্রীমতী দুর্গাবাঈ দেশমুখ এর নেতৃত্বে। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী জাতীয় নারীশিক্ষা সংসদ স্থাপন করা হয়। এই জাতীয় সংসদ ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে শ্রীমতী হংস মেহতার নেতৃত্বে এক কমিটি গঠন করে। এই কমিটির কাজ ছিল ছেলে ও মেয়েদের শিক্ষার জন্য পাঠক্রমের পার্থক্য কী হবে তা নির্ধারণ করা। এর পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী ভক্তবৎসল-এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির কাজ হল সারা দেশে নারী শিক্ষার প্রসার কিভাবে ঘটানো যায় সে সম্পর্কে পর্যালোচনা করা ও সুপারিশ করা।
ভারতীয় শিক্ষা কমিশন বা কোঠারি কমিশন তার সুপারিশগুলো ‘শিক্ষা ও জাতীয় অগ্রগতি‘ এই শিরোনামে প্রকাশ করেছেন। এই কমিশনে যে ৭টি কর্মীদল গঠন করা হয়, সেই তালিকারও প্রথমেই ছিল নারীশিক্ষা বা Women’s Education।
(১) শিক্ষায় নারী পুরুষ অনুপাত: স্ত্রী শিক্ষার প্রসার এমনভাবে করতে হবে যেন আগামী ২০ বছরের মধ্যে এই অনুপাতের মধ্যে সামঞ্জস্যতা আসে।
(২) সংস্থাপন : কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় ক্ষেত্রেই বালিকা ও স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের জন্য বিশেষ সংস্থা স্থাপন করতে হবে।
(৩) পৃথক বিদ্যালয় : মেয়েদের জন্য পৃথক বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। তবে কোন কারণে মেয়েদের পৃথক বিদ্যালয় স্থাপন করা না গেলে, বিদ্যালয়ে কয়েকজন শিক্ষিকা ও কয়েকজন মহিলা শিক্ষাকর্মী রাখতে হবে।
(৪) বাইরে চাকরি : মেয়েরা যাতে বাইরে চাকরি পায়, তার জন্য আয়ােজন করতে হবে।
পূর্ণকালীন চাকরি : বিয়ের বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের জন্য পূর্ণকালীন চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে।
(৫) অংশকালীন কাজ : মেয়েদের অংশে কালীন কাজের পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে।
(৬) ছাত্রীনিবাস : মেয়েদের জন্য হোস্টেল ব্যবস্থা করতে হবে। যে সকল ছাত্র বাড়ি থেকে অনেক দূর বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে তাদের জন্য ছাত্রীনিবাস গঠন করতে হবে যাতে তারা হোস্টেলে বা ছাত্রীনিবাসে থেকে পড়াশোনা করতে পারে।
(৭) ছাত্রী বৃত্তি : মেয়েদের জন্য ছাত্রী বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে মেয়েদের আগ্রহ আরও বাড়ে তার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের আগ্রহ যেন বৃদ্ধি পায়।
(৮) সম পাঠক্রম : ছেলে ও মেয়েদের পাঠক্রমের মধ্যে কোনাে পার্থক্য করা হবে না।
(৯) ঐচ্ছিক বিষয় : মেয়েদের জন্য ঐচ্ছিক বিষয় রূপে গৃহবিজ্ঞানের পাঠক্রম থাকতে পারে। তবে এটা বাধ্যতামূলক হবে না।
(১০) বিজ্ঞান ও গণতন্ত্রে আগ্রহ : বিজ্ঞান ও গণতন্ত্রের শিক্ষায় মেয়েদের উৎসাহ দিতে হবে।
(১১) সংগীত ও চারুকলা : মেয়েদের জন্য সংগীত ও চারুকলা শিক্ষার সুযোগদান করতে হবে।
(১২) বৃত্তিমুখী শিক্ষা : আর্থিক দুরবস্থার জন্য যে সকল মেয়ে পড়াশোনা সম্পূর্ণ করতে পারেনি তাদের জন্য বৃত্তিমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এ ছাড়া বৃত্তি শিক্ষায় আগ্রহী মেয়েদের জন্য বৃত্তি শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা।
কোঠারি কমিশন মনে করে, শিক্ষাকে এমনভাবে কার্যে পরিণত করতে যাতে শিক্ষার্থীরা সামাজিক নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হয় এবং তাদের চরিত্র গঠিত হয়।
(A) সামাজিক বিকাশ : শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক বিকাশ ঘটাতে কমিশন সুপারিশ করে—
- শিক্ষার পাঠ্যসূচি এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়।
- পাঠক্রম এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে।
- ভারতবর্ষের একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন সামাজিক বিকাশ।
(B) নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের বিকাশ :
(১) নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে গেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করতে হবে, যা তাদের ভবিষ্যতে উদারমনা ভাবাপন্ন করে তুলবে, তাদের মনে সাম্প্রদায়িক মনােভাব সৃষ্টি করবে না।
(২) ভারতবর্ষের মতাে বহু ধর্মের দেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহিষ্ণু মনোভাব গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার পাঠক্রমের মধ্যে এমন বিষয় রাখতে হবে, যাতে প্রত্যেকে প্রত্যেকের ধর্ম, মূলনীতি ও আদর্শের প্রতি সম্মান করতে পারে।
(৩) সরকারি ও বেসরকারি এবং সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে।
(৪) নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষাদানের জন্য পৃথকভাবে কোন শিক্ষার্থী নিযুক্ত না করে, উপযুক্ত ব্যক্তিদের উপর এই দায়িত্ব দেওয়া যাবে।
(৫) মহাবিদ্যালয়ে তুলনামূলক ধর্ম ও দর্শন শিক্ষার উপযুক্ত বিষয় রাখতে হবে।
(৬) বিদ্যালয় সপ্তাহে ক-টা ক্লাস হবে অর্থাৎ ক-টা পিরিয়ড থাকবে সেগুলো ঠিক করার দায়িত্ব থাকবে সহ-শিক্ষকগণ।
(৭) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য বিভিন্ন ধর্মের মূলনীতির উপর ভিত্তি করে কার্যকরী শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে পুস্তক রচনা করতে হবে।
Leave a comment