“সাহিত্য ঠিক প্রকৃতির আর্শি নহে। কেবল সাহিত্য কেন, কোনো কলাবিদ্যাই প্রকৃতির যথাযথ অনুকরণ নহে।”
“যেমনটি ঠিক তেমনটি লিপিবদ্ধ করা সাহিত্য নহে।”
“জগতের ওপর মনের কারখানা বসিয়াছে এবং মনের উপরে বিশ্বমনের কারখানা—সেই ওপরের তলা হইতে সাহিত্যের উৎপত্তি।”

দার্শনিক প্লেটো মনে করেন—‘এই পৃথিবী ভগবানের মনের ছায়া এবং কবিগণ এই ছায়াকে কাব্যে অনুকরণ করে থাকেন— “His work therefore is no more than an imitation of an imitation.” কবি যুগের কাছে আবেদন না করে অন্তরের আবেগকে উদ্দীপিত করেন। এর ফলে মানুষের অসংযত প্রবৃত্তি সমূহ উদ্দাম হয়ে ওঠে। বাস্তব থেকে কবি যা গ্রহণ করেন, তার মধ্যে তিনি তাঁর ভাব ও ভাবনাকে সংযুক্ত করেন। বাস্তব সত্যের মৌল বিষয় তিনি প্রকাশ করেন। সুতরাং বাস্তবে যা অসংলগ্ন বিপর্যস্ত ও পারম্পর্য বিচ্যুত তাকে কবি ও শিল্পী কল্পনার গৌরবে সমৃদ্ধ করে ঐক্য ও সংহতি দান করেন। অবশ্য কাব্য ও ললিত কলা থেকে যা উদ্দেশ্যমূলক রচনা তা স্বাভাবিকভাবেই বাদ পড়বেই। কারণ শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে, কোনো কিছু প্রচারের জন্য রচিত নয়। কিন্তু যা খাঁটি কাব্য ও ললিত কলা তা অহৈতুকী আনন্দের সৃষ্টি।

রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধে জানিয়েছেন—আমরা আমাদের আনন্দ বা শোক যখন প্রকাশ করি তখন সংগতির সীমা অতিক্রম করি। যা একান্তরূপে আমাদের নিজস্ব, সেখানে আমাদের প্রকাশ স্বাভাবিক সংযম রক্ষা করে। কিন্তু আমাদের যে অংশ অপরের কাছে ঘোষণা তা আনন্দই হোক আর শোকই হোক, তা কিছুটা অতিকৃত হয়। কিন্তু অতিকৃত হলেও তাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। জননীর পুত্র শোকের দুটি অংশ—একটি তাঁর আপন হৃদয়ের গভীর বেদনা, অপরটি হল অন্যের কাছে পুত্রশোকের গৌরব প্রকাশ। অপরের কাছে শোক প্রকাশ করতে হলে তা প্রমাণের প্রয়োজন হয়। জননী তাঁর শোকের প্রবলতার দ্বারা পুত্র বিচ্ছেদ হেতু ক্ষতির প্রাচুর্য সকলকে জানান, তা পুত্রের মৃত্যুকে গৌরবান্বিত করায় এক স্বাভাবিক প্রয়াস। যে প্রচণ্ড বিচ্ছেদে জননীহৃদয় ক্ষতবিক্ষত সেই দুঃখ পৃথিবী গ্রহণ করবে না, স্বাভাবিক নিয়মে প্রাত্যহিকের বৃত্তে সে আবর্তিত হবে, শোকাতুরা জননী এই অতিত্তাকে গ্রহণ করতে পারেন না, সুতরাং তাঁর বিলাপ হৃদয়ের মর্মান্তিক দুঃখকে ঘোষণা করে।

বাস্তব জীবনে এই পুত্রহারা জননীর বিলাপ শোক পরিবেশে প্রত্যক্ষগোচর। কিন্তু সেই সত্যকে সাহিত্যে পরিস্ফুট করতে হলে পরিবেশ রচনা করে, বর্ণনার সাহায্যে, ভাষার ব্যঞ্জনায়, অর্থবহ নানা ইঙ্গিতে শোকের ব্যপারকে সত্য করে তুলতে হয়। বাইরের দিক থেকে দেখলে একে কৃত্রিম বলে মনে হয়, কিন্তু অন্তর এই সত্যতাকে পরম শ্রদ্ধায় গ্রহণ করে থাকে। তাই অ্যারিস্টটল সাহিত্যের সত্যকে সেরা সত্য বলেছেন। ইতিহাসের সত্য সাধারণ সত্য, খণ্ডিত ও অকৃতার্থ, কিন্তু সাহিত্যের সত্য সার্থক সত্য।

সাহিত্য মানব জীবন থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে, এবং তা গ্রহণ করে সাহিত্য স্রষ্টার মন। কিন্তু এই মনের ওপর একটি সত্তা হল, বিশ্বমানব মন তা থেকে গ্রহণ বর্জন করে কল্পনায় ও অনুভূতিতে তা পরিপূর্ণ করে প্রকাশ করে। মন সাধারণত প্রকৃতির মধ্য হতে সংগ্রহ। সাহিত্য মনের মধ্যে থেকে সঞ্চয় করে। এই মনের জিনিসকে সৃজনী প্রতিভায় নতুন রূপে গড়ে তোলা হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বাস্তব জগৎ ও সাহিত্য সৃষ্টি, এর মধ্যে মন ও বিশ্বমানবমন রূপী দুটি স্তর আছে। এই দুয়ের দুর্ভেদ্য ব্যবধান রচনা করা হলে তবে আত্মার পক্ষে মহতী বিনষ্টী স্বরূপ। লেখক তাঁর কল্পনার মাধ্যমে এ দুয়ের মধ্যে যোগ সাধন করে থাকেন। এর নাম জগতের ওপর মনের কারখানা বসা। সুতরাং সেই উপরের তলা হইতে সাহিত্যের উৎপত্তি।

কোনো শিল্প সৃষ্টি বাস্তবের অনুকরণে হয় না। সর্বক্ষেত্রে বাস্তবের উপরে শিল্পী মনের ভাব ও ভাবনা প্রতিফলিত হয়ে তার রূপান্তর সাধন করে থাকে। বাস্তবের একান্ত অনুরূপ সৃষ্টি হলে শিল্পীসত্তা তাতে তৃপ্ত হবে না। পাঠক গ্রহণ করবে না। কাজেই জীবনের প্রতিলিপি গড়ে তোলা শিল্পীর আদর্শ নয়। বর্তমানকালে যাকে বাস্তব সাহিত্য বলে আখ্যা দেওয়া হয় তাও বাস্তবের প্রতিভাস মাত্র। এই বাস্তবের অর্থ হল জীবনের যে ঘটনাগুলি ঘটেছে তাদের সম্ভাব্য পরিণতি দান করা। সুতরাং এক্ষেত্রেও অনুকরণের কোনো প্রশ্ন আসে না।

চিত্র, ভাস্কর্য, অভিনয়, সংগীত, নৃত্যকলা সবই কলাবিদ্যা, কিন্তু কোনো কলাবিদ্যাই প্রকৃতির অনুকরণ নয়। জীবনকে মহত্তর করে নতুন সৃষ্টির প্রয়াস সর্বযুগেই তা পরিলক্ষিত হয়। কাব্যই হোক বা চিত্রই হোক উভয় ক্ষেত্রে শিল্পী আপন মনের ভাবকে বাইরে পরিস্ফুট করতে চান, অতএব কাব্য ও চিত্র হল মাধ্যম মাত্র। সাহিত্যের মাধ্যমে আমরা জীবনের রসরূপকে আস্বাদন করি, বাস্তব জীবনের ভাব, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে সাহিত্য স্রষ্টা—চিরকালের ভাষায় লিপিবদ্ধ করেন। এই বাস্তবের উপর তাঁর মানসলোকের আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে তার রূপান্তর সাধন করে। এই রূপান্তরকে কখনও অনুকরণ বলা যাবে না। এ বিধাতার সৃষ্টির মতো অহৈতুকী লীলা।