এই আলোচনারও মুখবন্ধ হিসাবে আমরা আমাদের অব্যবহিত পূর্বোক্ত আলোচনার মানুষের সেই পশুসত্তা থেকে মনুষ্যসত্তার উত্তরণের অর্থাৎ তার স্পিনোজা কথিত Social animal হয়ে ওঠার পর্বটির বিষয় স্মরণ করে নিতে চাই। কারণ, একটু নিবিষ্ট দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করলে এ-বিষয়টা কারুরই নজর এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয় যে, সংযম-সৌন্দর্য সত্যও মঙ্গল নামধেয় যে চতুর্মুখ বিশ্বমানব ব্রহ্মার পরিচয় রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই আলোচনায় দিয়েছেন, তা তিনি দিয়েছেন পুরোপুরি ঠিক এই দৃষ্টিকোণ থেকেই। এই প্রবন্ধেই তিনি অদ্বর্থ্য ভাষায় ঘোষণা করেছেন, ‘মঙ্গল মাত্রেরই সমস্ত জগতের সঙ্গে একটা গভীরতম সামঞ্জস্য আছে, সকল মানুষের মনের সঙ্গে তাহার নিগূঢ় মিল আছে।…শতদল পদ্মের মতো, পূর্ণিমার চাঁদের মতো নিজের মধ্যে এবং চারিদিকের জগতের মধ্যে তাহার একটি বিরোধ হীন সুষমা আছে, সে নিখিলের অনুকূল, এবং নিখিল তাহার অনুকূল।” রবীন্দ্রনাথের এই ঘোষণা কি স্পিনোজা কথিত সেই ‘man is a social animal’-এর থেকে ভিন্নতর কোনো কথা ?
একটু নিবিষ্ট দৃষ্টিতে বিচার করলেই বোঝা যাবে গোষ্ঠীকল্যাণের আবশ্যিকতা-বোধ থেকেই যে মানুষের উপলব্ধিতে একসঙ্গে ধরা দিয়েছে মঙ্গলের বোধ, সুন্দরের বোধ, এবং সত্যেরও বোধ—সেকথা রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই উক্তির মধ্যে সরাসরিই স্বীকার করে নিয়েছেন। এবং এই জন্যই বিবিধ যুক্তির মাধ্যমে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে ব্যষ্টির যে কাজ গোষ্ঠী-কল্যাণকে আহত বা বিঘ্নিত না করে সংহত ও সমৃদ্ধ করে সে কাজই শুভ ; ব্যষ্টির নিজের পক্ষেও শুভ, গোষ্ঠীর পক্ষেও শুভ। যা শুভ, তা-ই সুন্দর। নিখিল বা গোষ্ঠী কল্যাণের সঙ্গে সুমিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেই তা সুন্দর। এবং যা সুন্দর, তাই তৃপ্তিদায়ক। সে শুধু অব্যবহিত প্রয়োজন মেটাচ্ছে বলেই না, উপযোগিতার ফল সকলের সঙ্গে ভাগ করে উপভোগ করা যাচ্ছে বলেও তৃপ্তিদায়ক।
এইজন্যেই প্রায় অব্যতিক্রমে দেখা যায় যে, মানব সমাজের এ একটা স্বাভাবিক নিয়ম যে, মাঝে মাঝে কোনো একটি বিশেষ মানবগোষ্ঠীর কোনো একজন বিশেষ মানুষ যখন গোষ্ঠীকল্যাণের জন্য বা সে কল্যাণকে আরও বর্ধিত করার জন্য সহসা একটা অসম সাহসিক কাজ করে বসেছেন বা অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, অথবা প্রকৃতি-জগতের মধ্য থেকেই এমন একটা কিছু বিষয় আবিষ্কার করে বসেছেন গোষ্ঠীজীবনকে এক পদক্ষেপেই অনেক বড়ো কল্যাণ ও আনন্দের দিকে এগিয়ে দিয়েছে, তখনই সেই মানুষটা গোষ্ঠীভুক্ত আর সকল মানুষেরই শ্রদ্ধা ও ভক্তির পাত্র হয়ে উঠেছেন। এবং এইভাবে সামাজিক মানুষের মনে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে বীরত্ব ও নেতৃত্বের আদর্শ, ত্যাগ ও মানব-প্রেমের আদর্শ এবং সেই আদর্শেরই প্রতিনিধি রূপে এক-একজন আদর্শ মানুষের চরিত্র। কোথাও সেই আদর্শ মানুষ বীর, কোথাও ঋষি, কোথাও আবার অপর কোনো নরোত্তম। যুগে যুগে এদেরই মধ্য থেকে কেউ হয়েছেন রাম, কেউ দধীচি, কেউ প্রমিথিউস, কেউ কৃষ্ণ। আর এই সব নরোত্তমদের জীবনকে উপলক্ষ্য করে মানুষের নানান গোষ্ঠীতে গড়ে উঠেছে নানান গান, গাথা, উপকথা, কাব্য, মহাকাব্য ও পুরাণ। এইসব গাথা-পুরাণ বা কাব্য মহাকাব্যগুলি প্রত্যক্ষভাবে গোষ্ঠীকল্যাণের কোনো উপযোগিতা সাধন করে না, ঠিকই; কিন্তু এই সব কাহিনি হচ্ছে অমৃতমান মঙ্গল কথা। এদের শ্রবণে এবং পাঠে আমাদের হৃদয়কে উদ্বোধিত ক’রে সত্যের প্রতি আমাদের চিত্তকে উন্মুখ করে। তাই এই মঙ্গল কাহিনিগুলি তৃপ্তি ও আনন্দদায়ক, আর সেই জন্যই এগুলি সুন্দর। ‘সৌন্দর্যমূর্তিই মঙ্গলের পূর্ণ মূর্তি আর মঙ্গলমূর্তিই সৌন্দর্যের পূর্ণ স্বরূপ’—রবীন্দ্রনাথের এই ঋষি-উত্তির নির্গলিতঅর্থ মোটামুটি হচ্ছে এই।
সুন্দর ও মঙ্গলের এই অচ্ছেদ্য অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধের উপলব্ধি ও সিদ্ধান্ত রবীন্দ্রনাথের যে কত খাঁটি ও অকাট্য ছিল তার সাক্ষ্য প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের নন্দনতত্ত্ব (Aesthetics) ও মঙ্গলতত্ত্বে (Ethics) ভুরি ভুরি মিলবে।
প্রশ্ন হতে পারে, কিন্তু এসবই তো হচ্ছে, নীতি-শাস্ত্রে আপ্তবাক্য মাত্র; এর সঙ্গে সাহিত্য বা ললিতকলার কী সম্পর্ক থাকতে পারে ? তা সম্পর্ক কিছু আছে বৈকি! নতুবা রবীন্দ্রনাথই বা কেন সাহিত্যের আলোচনার মঙ্গলতত্ত্বের প্রসঙ্গ তুলবেন, আর কেনই বা রোমান্টিক ব্যক্তিত্ববাদের একজন প্রধান পুরোহিত শেলী উচ্চকণ্ঠে দাবি করবেন, Poets are the unrecognized legislators of mankind? লেজিলেটারদের কাজ তো সমাজভুক্ত মানুষদের জন্য নীতিসম্মত আচরণবিধি প্রণয়ন করাই। এর কারণ সাহিত্য এবং ললিতকলার সৃষ্টিকর্মটা যত ব্যক্তিগতই হোক আসলে সেটা সমাজের জঠর থেকেই সঞ্জাত হয়, সেটা সমাজেরই গর্ভজাত সন্তান। তাই সমাজ যতদিন থাকবে, সে তার সন্তানের মুখ দিয়ে নিজের মর্মকথাই বলবে। বলবে, যতদিন সে আছে ততদিন তাকে অস্বীকার করে, তার গোষ্ঠীকল্যাণের ঋণ শোধ না করে সাহিত্য বা ললিতকলা তার পূর্ণ অভিব্যক্তি পাবে না। মাঝে মাঝে এখানে-ওখানে এক-আধটা মাতৃহন্তারক পরশুরাম নিজেকে জ্বালিয়ে এক-দুটো ক্ষণিক ফুলঝুরি জ্বালাতে পারে বটে ; অপ্রত্যয়ের চোরাবালির উপর এক-আধটা ক্ষণশোভার মরুদ্যানও হয়তো সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু চোরাবালিটা চোরাবালিই—ওটা তলিয়ে যাবার পথ। চিরায়ত সত্তা অর্জন করতে হলে শিল্পীকে মানুষের মর্মে, তার চিত্তের গহন আনন্দলোকে তার সামাজিক সত্তার চিরায়ত সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের হর্ম্যকেই গড়ে তুলতে হবে। কারণ,
“Art is subject to moral criticism, because morality is nothing more nor less than the law which determines the whole order of interests within which art and every other good thing is possible…Art, like all other interests, can flourish only in a sound and whole society, and the law of soundness and wholeness in life is morality.” [E. F. Carrit-Theory of Beauty.]
এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় বিশেষভাবে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে। হৃদ্যতা অর্থাৎ যে মনোভাবটিকে ইংরেজি ভাষার সিন্সিয়ারিটি এবং এম্প্যাথির (empathy) সমন্বিত মনোভাব বলেই ঠিকমতো পরিচিত করা যেতে পারে—এই হৃদ্যতা হচ্ছে মঙ্গলবোধের একটি বিশিষ্ট প্রকাশ ; তার অন্যতম শর্তও। যজ্ঞিবাড়ির আয়োজনে ফুল, পাতা, প্রদীপের মালা, আতর ছিটানো, সোনার থালি নিমন্ত্রিতদের জন্য থাকে তো থাকুক। সেগুলোও অনাবশ্যক নয় ; সেগুলোও সুন্দর। কিন্তু এসবের সঙ্গে যদি নিমন্ত্রণকর্তার হৃদ্যতার সুখস্পর্শটুকু না থাকে তবে এসব সৌন্দর্যের সবটাই নিছক বাহ্যাড়ম্বর বা ধনগর্বীর ধনাস্ফলনে পর্যবসিত হতে পারে। মঙ্গল-বুদ্ধি ব্যতীত এই হৃদ্যতার অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন, এই হৃদ্যতাটাই বা নিমন্ত্রিতদের মধ্য থেকে কজন উপলখি করতে পারে ? অধিকাংশই তো বাইরের আড়ম্বর দেখেই মজে। যে-ব্যক্তি সৌন্দর্যকে এইভাবে সংকীর্ণ করে দেখে, হৃদ্যতার হার্দিক সৌন্দর্যটুকুও তার গণ্ডুষমাত্র উপলব্ধিতে ধরা পড়ার কথা নয়। সংকীর্ণ প্রকাশের তরঙ্গভঙ্গ যখন বিস্তীর্ণ প্রকাশের মধ্যে থিতিয়ে বসেছে তখন সেই বৃহৎ সৌন্দর্যকে উপলবদ্ধির উচ্চভূমি থেকে প্রশান্ত ভাবে দেখা চাই। তেমন ভাবে দেখা শিক্ষাসাপেক্ষ; তার জন্য প্রয়োজন শান্ত অন্তরের সমাহিত গাম্ভীর্য। এ শিক্ষা যার আছে, হৃদ্যতার দুর্লক্ষ্য স্নিগ্ধ রমনীয়তাটুকু একমাত্র তারই সহৃদয় উপলব্ধি কাছে ধরা দেয়।
Leave a comment