সোভিয়েত রাশিয়ার অভূতপূর্ণ উন্নতির কথা আলোচনা করতে গিয়ে লেখক‌ প্রথমেই ধনবিজ্ঞানের একটি সাধারণ সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করেছেন। সিদ্ধান্তটি হল, বিনিময়ের সঙ্গে আর্থিক উন্নতির সম্পর্কে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বিনিয়োগ বাড়লেই আর্থিক উন্নতি বাড়বেই। বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি বলেই পূর্ব ইউরোপে, চিনে, জাপানে জাতীয় উপার্জন বৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বগতি, আর আমাদের দেশে বিনিয়োগের হার কম হলে আমাদের উপার্জন বৃদ্ধির হারও অত্যন্ত কম। এরপরই তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। আর্থিক উন্নতির ক্ষেত্রে রাশিয়া কয়েকটি সূত্র বা মুক্তি পেতে চলেছিল— প্রথমত, বিনিয়োগ বড়ানো। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগের বৃহৎ অংশ যন্ত্রপাতি নির্মাণে ব্যয় করা। তৃতীয়ত, ভোগ্যপণ্য উৎপাদন নিয়ন্ত্রিত করা। সোভিয়েত ইউনিয়নের আশ্চর্য উন্নতির কারণ হল সেই দেশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলির এক এক করে সূচনা থেকেই বিনিয়োগের হার যথাসম্ভব বাড়িয়ে চলেছিল। সে ঠিক করে নিয়েছিল বিনিয়োগের সাহায্যে যে যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য উৎপাদন উপকরণ তৈরি হবে, তা ধরে সবগুলিকেই ভোগপণ্য উৎপাদনে নিয়োগ না করে, সেই যন্ত্রপাতির একটা বড়ো অংশ আরও যন্ত্রপাতি তৈরি করার জন্য ব্যবহার করবে। তাহলে কয়েক বছরের মধ্যে কল-কারখানা যন্ত্রবিদ্যাতে সারা দেশ ছেয়ে যাবে। এই যন্ত্র কৃচ্ছসাধন করলে অন্তিমে ভালো ফল পাওয়া যাবেই। প্রথম দিকে কিছুটা অভাব ঘটে ঘটুক কিন্তু পরে তা পুষিয়ে যাবে। কিন্তু তা না করে যদি প্রথম থেকেই বিনিয়োগের বৃহদাংশ ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে নিয়োগ করলে একবছর হয়তো ভালো ফল পাওয়া যাবে। কিন্তু তার পরেই আসবে অভাব এবং অনটন। ভবিষ্যতের কথা না ভেবে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য উপকরণ বৃদ্ধির দিকে নজর না দিলে বিপদ ঘনিয়ে আসবে। যন্ত্র এবং অন্যবিধ সরঞ্জাম যদি না বাড়ানো হয় তাহলে উৎপাদন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু লোক সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকবে, স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করে জনসাধারণের মধ্যে আরও স্বাচ্ছন্দ্যের বাসনা জাগবে। সুতরাং দুঃখ নিশ্চিত ভাবেই ঘনিয়ে আসবে। সুতরাং সে স্থির করেছিল ভোগ বাসনার প্রতি আপাত মনোযোগ না দিয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং বিনিয়োগের বড়ো অংশ প্রতিনিয়ত না দিয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং বিনিয়োগের বড়ো অংশ প্রতিনিয়ত আরও বেশি যন্ত্র পরিবহন ও বিদ্যুতের প্রসারে নিয়োগ করতে হবে।

সোভিয়েত রাশিয়া এই সূত্রগুলো মৌনই করেছে। বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত দেশে প্রতিরক্ষার প্রয়োজন ছিল সর্বাধিক। প্রতিরক্ষার প্রয়োজনেই তার ইস্পাত ও কল-কব্জার ওপর জোর দেবার দরকার হয়েছিল। তাছাড়া বিনিয়োগের মাত্রা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ভোগ বিলাসের ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষাকে সে অনেক পরিমাণে কমিয়ে এনেছিল। এরজন্য সে দুটি পথ অনুসরণ করেছিল। প্রথমত, বিদেশ থেকে ভোগপণ্য আমদানি একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল বাহির্বাণিজ্যকে রাষ্ট্রয়ত্ত করার ফলে। দ্বিতীয়ত, দেশের মধ্যে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের নিযুক্ত হতে পারে এমন সব যন্ত্রপাতি নির্মাণ ভীষণভাবে কমিয়ে দিয়েছিল। ভোগ্য পণ্য না থাকার জনসাধারণ তাদের উপার্জিত অর্থ সম্ভোগে ব্যয় করতে পারেনি। ফলে সেই অর্থ সঞ্চিত হয়েছে আবার সেই সজ্জিত অর্থ বিনিয়োগে নিয়োজিত হয়েছে।

সোভিয়েত রাশিয়া প্রথম দিকে কৃচ্ছসাধনা করেছে বলে তার ফলও সে পেয়েছে। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে সে ব্যর্থ হয়েছে সেটি হল কৃষিক্ষেত্র। আমরা হয়ে যাই এটা দেখে যে সোভিয়েত রাশিয়ার সামগ্রিক উৎপাদন বিগত ৩৫ বছর সেখানে কুড়ি গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানে কৃষি উৎপাদন দ্বিগুণও হয়নি। কৃষিতে সে উৎপাদন বেড়েছে তার সবটাই নতুন জমি আবাদ করে, জমির গড় উৎপাদন বাড়িয়ে নয়। ফলে সোভিয়েত রাশিয়ার আর্থিক উন্নতির হার দ্রুত কমে গেছে। সোভিয়েত কৃষিসমস্যা শিল্প সমস্যা থেকে পৃথক। বাণিজ্যে নামতে গেলে, বা কারখানা বসাতে উৎসাহী হলে, উদোক্তা সরলরেখায় এগোতে পারেন, কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপারটা এত সহজ নয়। কৃষিকার্য সমস্ত দেশ জুড়ে, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ পল্লিগ্রামে। একই গ্রামে হয়তো দু-তিনশো কৃষিজীবী, তারা প্রত্যেকেই মনের দিক থেকে সার্বভৌম, ইচ্ছের দিক থেকে স্বতন্ত্র। উৎপাদন বৃদ্ধির মন্ত্র এদের মধ্যে বিদ্যুৎ চালনার মতো চালিত করতে হবে। সকলকে সমসঙ্গে দীক্ষিত করতে হবে। একই চেতনার বিদ্যুৎ সকলের মনে এক সঙ্গে প্রবাহিত হলে তবেই ফসল উৎপাদন বাড়বে। কিন্তু এই ব্যাপারে অসুবিধের দিকটাও কম নয়। কারণ সব কৃষকই রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যে গদ গদ চিত্তে উৎপাদনে এগিয়ে আসবে না। জমির প্রতি প্রত্যেকের দুর্বলতা স্বতন্ত্র। কোনো কোনো কৃষিজীবীর মনে থাকে “অনেক নিবিড় হয়ে জড়ো হওয়া আবেগের ব্যাপ্তি।” জমি রাষ্ট্রের সম্পত্তি। অথচ সে জমিতে কৃষকের অধিকার আছে। এই ধরনের দুরাগত যুক্তিতে মন সায় দেয় না। চাষিদের মন হয়েছে অহেতু সম্ভব তাতে মনের আদান প্রদান ও অবরুদ্ধ থেকেছে। এই হার্য-বিনিময়ের অভাবে সোভিয়েত দেশের কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়েনি। গ্রামের প্রয়োজনের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার মধ্যে ব্যবধানে এসে গিয়েছে। যে গ্রামে সার পৌঁছানো দরকার, সেগ্রামে হয়তো চকচকে ট্রাক্টর পৌঁছেছে, যেখানে সেচের জল দরকার, সেখানে হয়তো পৌঁছেছে সার। এই গরমিল সোভিয়েত দেশে একটু বেশি পরিমাণে হয়েছে বলে উৎপাদন এত ব্যাহত হয়েছে।

কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সোভিয়েত রাশিয়ার ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে লেখক দুটি মারাত্মক ভুল লক্ষ্য করেছেন। প্রথম ভুলটি হল যে পরিমাণ অর্থ কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা উচিত ছিল, তা করা হয়নি। প্রতিরক্ষা ও শিল্প সারে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল সে তুলনায় কৃষিখাতের বরাদ্দ ছিল কম। আবার যে অর্থ বরাদ্দ করা হল কৃষি উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার সুষম ও বণ্টনও হয়নি। ফসলের উৎপাদন বাড়াতে হলে যেমন বিদ্যুৎ ও ট্রাক্টর দরকার তেমনি রাসায়নিক সার, উন্নত বীজ-কীটনাশক ঔষধের, ও একান্ত প্রয়োজন। এই সমস্ত উপকরণগুলির সুষ্ঠু সমন্বয়ের দ্বারা কৃষি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। রাশিয়ার তৎকালীন শাসনকর্তারা এই সহজ সত্যটি বুঝতে পারেননি। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ট্রাক্টর উৎপাদনের জন্য যা ব্যয় করা হয়েছিল তার সামান্য অংশও সার উৎপাদনের জন্য ব্যয় হয়নি। কীটনাশক ঔষধ তৈরির ক্ষেত্রে ও চূড়ান্ত উদাসীনতা দেখানো হয়েছিল। উন্নত ধরনের বীজের ব্যাপারেও অবহেলা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। অথচ রাসায়নিক সার, উন্নত বীজ, কীটনাশক ঔষধ প্রয়োগের দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও পশ্চিম ইউরোপে কৃষির‌ গড় উৎপাদনগত ৫০ বছরে ছয় সাত গুণ বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ১৯৫৩-৫৪ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন এ ব্যাপারে সচেতন ছিল না। ক্রুশ্চভ ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত কৃষির ব্যাপার সেই দেশের চিন্তা-ভাবনা ছিল একপেশে সামঞ্জস্যহীন। কম অর্থ বিনিয়োগ এবং সেই অর্থের অসমবণ্টন কৃষিক্ষেত্রে একটা বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।

এর পর লেখক অন্য একটি সমস্যার উল্লেখ করেছেন যেটি প্রথমটির তুলনায় অনেক বেশি জটিল। এক্ষেত্রে তিনি শিল্প উৎপাদনের সঙ্গে কৃষি উৎপাদনের একটা তুলনা করেছেন। শিল্প-কল-কারখানা স্থাপনের সঙ্গে কৃষি উৎপাদনের বিরাট পার্থক্য আছে। কল -কারখানা স্থাপনের একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। যিনি কারখানা স্থাপন করবেন তাকে – প্রথমে মূলধন জোগান করতে হয়। সেই মূলধনের কিছু অংশ ব্যয় করে তিনি যন্ত্র কেনেন এবং সেই যন্ত্র বসান। তারপর কাঁচামালের ব্যবস্থা করে শ্রমিক নিয়োগ করেন। শ্রমিকেরা পয়সার বিনিময়ে সারে এবং পণ্য উৎপাদন করে। ধনতান্ত্রিক দেশই হোক আর সমাজ তান্ত্রিক দেশই হোক শিল্প উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি একই রকম, বিশেষ কোনো তফাৎ নেই। তফাৎ শুধু এই যে, সমাজতান্ত্রিক দেশে শিল্পমালিকানায় শ্রমিকের অধিকার থাকে, কিন্তু তাতে শিল্প উৎপাদনের চরিত্র খুব বেশি পালটায় না। তাছাড়া শিল্পের ক্ষেত্রে যন্ত্রের ভূমিকা দিনের পর দিন বাড়ছে তাতে শিল্প উৎপাদনের প্রক্রিয়াত সহজ হয় আসছে। দেশের দু’তিন হাজার বড়ো বড়ো কারখানার হিসেব যদি নেওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে শিল্প উৎপাদনের দুই তৃতীয়াংশে বেশি পণ্য এই কারাখানাগুলোতে তৈরি হয়। সুতরাং এই দু-তিন হাজার কারখানা সুষ্ঠু পরিকল্পনার ব্যবস্থা করতে পারলেই পণ্য উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে।

কিন্তু কৃষির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এত সহজ নয়। কারণ কৃষিকাজ ছড়িয়ে আছে সারা দেশজুড়ে, হাজার হাজার গ্রাম জুড়ে। এইসব গ্রামে লক্ষ লক্ষ কৃষিজীবী মানুষ বাস করে উৎপাদন বাড়াতে হলে এদের সবাইকে একই মন্ত্রে দীক্ষিত করতে হবে। এছাড়া একটি গ্রামের চাষির সঙ্গে অন্য একটি গ্রামের চাষির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত না হলে কৃষি উৎপাদনে খুব বেশি এগোনো যাবে না। সোভিয়েত রাশিয়ার প্রধান ভুল হয়েছিল কৃষকদের মানসিকতার উপলব্ধির ক্ষেত্রে। রাশিয়া যখন মনে করেছিল যে জমি যখন রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছে এবং জমিদারদের যখন উচ্ছেদ করা হয়েছে তখন চাষিরা উৎফুল্ল হয়ে রাষ্ট্রের প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য দেখিয়ে ফসল বাড়ানোর দিকে আত্মনিয়োগ করবে। কিন্তু জমির অধিকার সম্পর্কে চাষিদের একটা মোহ বা আকর্ষণ থাকে যে জমি তারা চাষ করে সে জমির সঙ্গে তাদের একটা দুর্বলতা জড়িয়ে থাকে, জমি ব্যক্তিগত হলে চাষি নিজের উদ্যোমে ফসল ফলায় কিন্তু জমি রাষ্ট্রায়ত্ত হওয়ায় চাষির সেই মোহ বা আকর্ষণে আঘাত লাগে। যে জমি রাষ্ট্রের সে জমিতে তারও অধিকার আছে এই যুক্তিতে তার মন সহজে সায় দেয় না। তার ফলে সোভিয়েত রাশিয়াতে উৎপাদন কমে গেছে। তাছাড়া চাষিদের নিজেদের মধ্যে মনের আদান প্রদানও দীর্ঘকাল অবরুদ্ধ থেকেছে। এক্ষেত্রে কমিউনিষ্ট পাটি সদস্যদের একটা ভূমিকা ছিল। কিন্তু তারাও সর্বজ্ঞ নন, কোন গ্রামে কীসের অভাব তা তারা নির্ভুলভাবে জানতে পারতো না। তাছাড়া তাদের পার্টির প্রভাবও সমান ছিল না। ফলে গ্রামের প্রয়োজন এবং কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রায়ই পার্থক্য পরিলক্ষিত হত। দেখা গেছে যে গ্রামে সারের প্রয়োজন সেখানে পৌঁছেছে ট্রাক্টর আবার যে গ্রামে জলের দরকার সেখানে পৌঁছেছে সার। অনিবার্য ভাবেই ফসলের উৎপাদন গেছে বহু পরিমাণে কমে।