রবীন্দ্রনাথের সাধারণ আলোচনা :
রবীন্দ্রনাথ কবি সার্বভৌম, তাঁকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবি বললে মোটেই অত্যুক্তি হয় না। তাঁর জন্ম সাল ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ এবং তিনি লোকান্তরিত হন ১৯৪১ সালে। দীর্ঘ আশি বৎসর তিনি সাহিত্যসেবা করেছেন। বলা বাহুল্য বাংলা সাহিত্যের তিনিই প্রধান পুরুষ ; তিনিই বাণীমূর্তি স্বরূপ বিরাজমান ছিলেন। তিনি একাই একটি যুগ, বাংলা সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন সর্বপ্রথম পাশ্চাত্ত্য চেতনার উন্মেষ ঘটালেও একমাত্র রবীন্দ্রকাব্যই বিশ্বজয়ে সমর্থ হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথই বোধ হয় সর্বপ্রথম বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে স্রষ্টার আনন্দময় মহাসত্তাকে উপলব্ধি করেছেন। তাই তাঁর প্রকৃতিচেতনা শুধু বাহ্য কোনো সৌন্দর্যের বর্ণনা মাত্র নয়, প্রকৃতির বর্ণনায় তিনি শুধু উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেননি, প্রকৃতির মধ্যে তিনি একাত্ম অনুভব করেছেন একাত্মতা। ‘মানসী’ গ্রন্থের ‘অহল্যার প্রতি এবং ‘সোনার তরী’র ‘সমুদ্রের প্রতি’, ‘বসুন্ধরা’ প্রভৃতি কবিতার কথা স্মরণ করলেই তা স্পষ্ট করে বোঝা যাবে। কবির কাছে শুধু বিচিত্র, সুন্দর এবং কল্যাণকর নয়, প্রকৃতির সঙ্গে কবির জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক, প্রকৃতিলোকের সমগ্র বস্তুর মধ্যেই কবির নিজের সত্তা মিশে আছে।
রবীন্দ্রনাথ মানুষেরও কবি। তাঁর কাব্যে মানবপ্রীতি গভীর ভাবে ধরা পড়েছে । মানুষই তাঁর কাব্যের বিষয়। সুন্দর ভুবনে তিনি মরতে চাননি, ‘মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’ বলে তিনি কবিজীবনের পূর্বাহ্নে ঘোষণা করেন, এবং পরিণত জীবনেও তিনি সেই কথাই বলেছেন—’আমি তোমাদের লোক, এই হোক মোর শেষ পরিচয়। পৃথিবীকে তিনি যত ভালোবেসেছেন, পৃথিবীর মানুষকে তিনি ভালোবেসেছেন তার চেয়ে বেশি। মাটিকে এবং মাটির মানুষকে তিনি সবচেয়ে বেশি করে আঁকড়ে ধরেছেন; মধুময় পৃথিবীর ধূলির তিলক ললাটে এঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে কল্পনার উচ্চ লীলাও দেখা যায়। তাই তাঁকে শুধু প্রত্যক্ষগম্য জগতের কবি বলে চিহ্নিত করা যাবে না। তাঁর কাব্যে অতীত জগৎ নতুন রঙে রসে উজ্জীবিত হয়েছে। তিনি রোমান্টিক কবি, অতীতচারিতায় তাই তিনি সহজেই একটি মায়ালোক সৃষ্টি করতে পেরেছেন।
রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কাব্য সম্পর্কে প্রথমেই যে কথাটি আমাদের মনে আসে সেটা এই যে তিনি দেহবাদী কবি নন। তাঁর কাব্যে ইন্দ্রিয়াতীত চেতনার প্রকাশ, ভোগাতীতবাদই তাঁর প্রতিপাদ্য বিষয়। তাঁর প্রেম দেহজ কামনাজাত নয়, পূজার অর্ঘ্য হিসাবেই গ্রাহ্য। যদিও নারী তাঁর কাব্যে বিশেষ একটা প্রেরণা, কিন্তু সেই নারী কখনই কামনা নিবৃতির উপায়স্বরূপ গণ্য হয়নি। তাই বিশ্বের প্রেয়সী উর্বশী বেদের নির্মল ঊষসীর নিষ্কলঙ্ক চেতনায় উদ্ভাসিত ; মদনও বিজয়িনী, সৌন্দর্যলক্ষ্মীর পায়ের কাছে পতিত। প্রেয়োবোধ অপেক্ষা শ্রেয়বোধই তাঁর কাব্যকে মাহাত্ম্য দান করেছে। এইজন্যেই তাঁর কাব্যে মিলন অপেক্ষা বিরহের প্রকাশ এত বেশি৷ মিলনে দু’জন বড়ো কাছাকাছি থেকে, উভয়ের মধ্যে একাকীত্বের বেড়া রচিত হয়, কিন্তু বিরহে জগৎ তন্ময় হয়ে ওঠে, ব্যাপ্ত হয় পরিসর। তাই রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতায় হৃদয়ের আর্তি মানুষকে আকূল করে, উৎকণ্ঠিত মনের করুণা পাঠকচিত্তকে করে ভারাতুর। এইজন্য রবীন্দ্রনাথকে সমালোচকরা ‘প্রেম-সৌন্দর্যের সন্ন্যাসী’ কবি ব’লে চিহ্নিত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ শ্রেষ্ঠ দেশ-প্রেমিক কবি। তার কাব্যে পরাধীন ভারতবর্ষের বেদনা যেমন রূপলাভ করেছে, তেমনি শাশ্বত ভারতের চিরন্তন বাণীও মূর্ত হয়েছে। তাঁকে তাই আর্য ভারতের কবিও বলা যায়। তবে তাঁর সর্বতোমুখী কবিপ্রতিভা লক্ষ্য করে তাঁকে বিশ্বকবি বলা হয়ে থাকে। তাঁর কাব্যের বৈচিত্র্য ও বিশালতা সত্যই অভাবনীয় এবং বিস্ময়কর।
রবীন্দ্রকাব্যে সোনার তরী :
‘সোনার তরী’ রবীন্দ্রনাথের ঠিক প্রস্তুতিপর্বের পরবর্তী কালের কাব্যগ্রন্থ। সন্ধ্যা সঙ্গীত’ থেকে ‘মানসী’ পর্যন্ত যে সময় সীমা তাকে রবীন্দ্রনাথের সাধনা পর্বের প্রথম যুগ বলে বর্ণনা করা হয়। ‘সন্ধ্যা সঙ্গীত’ ১৮৮০ সালে, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের উনিশ বছর বয়সে রচিত হয়েছে। অবশ্য সন্ধ্যা-সঙ্গীতের আগেই ‘বনফুল’, ‘কবি কাহিনী’, ‘ভগ্নহৃদয়’, ‘রুদ্রচণ্ড’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ প্রভৃতি রচনা তাঁর প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু এইসব রচনায় কিশোরসুলভ দুর্বলতার কিছু কিছু ছাপ আছে এবং প্রস্তুতিপর্বের প্রতিশ্রুতি থাকলেও, বিশ্বকবির কবিপ্রতিভার স্বাতন্ত্র্য তেমন ধরা পড়েনি। সেইজন্যে তিনি ‘সন্ধ্যা সঙ্গীতের আগের সমস্ত কবিতা তার কাব্য গ্রন্থাবলী থেকে বাদ দিয়েছেন। ‘সন্ধ্যা সঙ্গীতেই’ তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ ; এ বিষয়ে তিনি নিজে ভূমিকায় লিখেছেন—’কপিবুক-যুগের চৌকাঠ পেরিয়ে প্রথম দেখা দিল ‘সন্ধ্যা সঙ্গীত’। তাকে আমের বোলের সঙ্গে তুলনা করব না। করব কচি আমের গুটির সঙ্গে, অর্থাৎ তাতে আপন চেহারাটা সবে দেখা দিয়েছে শ্যামল রঙে। রস ধরেনি, তার দাম কম। কিন্তু সেই কবিতাই প্রথম স্বকীয় রূপ দেখিয়ে আমাকে আনন্দ দিয়েছিলেন। অতএব ‘সন্ধ্যা সঙ্গীতেই’ আমার কাব্যের প্রথম পরিচয়। সে উৎকৃষ্ট নয়, কিন্তু আমারই বটে।
‘সন্ধ্যা সঙ্গীতে’র পর ‘প্রভাত সঙ্গীত’। বেদনালোকের সংকীর্ণ চেতনা থেকে কবি বৃহত্তর এক আনন্দলোক এসে উপস্থিত হলেন। নিজের অন্তরকে ব্যাপ্ত করলেন, বিরাট বিশ্বের উপলব্ধি ঘটল তাঁর কাব্যে। তিনি লিখলেন—’নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। কবির অন্তর্মুখী সত্তা প্রকাশের উন্মাদনায় সহস্রধারায় উদ্বেল হয়ে সমস্ত বাধাবন্ধ চুরমার করে অভিব্যক্ত হয়ে পড়ল। রবীন্দ্রনাথ নিজেই সেকথা ঘোষণা করে বলেছেন, “প্রভাত সঙ্গীত আমার অন্তর প্রকৃতির প্রথম বহির্মূর্খ উল্লাস।”
এরপর ‘ছবি ও গান’। বহির্জগতের ছবি আর অন্তরজীবনের গান নিয়ে এই গ্রন্থটি রচিত তারপর ‘কড়ি ও কোমল’। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে এই গ্রন্থটির একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। এখানে কবি সত্যকার রূপস্রষ্টা হয়ে উঠেছেন। পরিণতির ভাগে এখন তিনি উত্তপ্ত, সত্যিকার শিল্পী। এই গ্রন্থ সম্পর্কে কবির মন্তব্য—’কড়ি ও কোমল’ মানুষের জীবনে নিকেতনের সেই সম্মুখের রাস্তাটায় দাঁড়াইয়া গান, সেই রহস্যসভার মধ্যে প্রবেশ করিয়া আসন পাইবার জন্য দরবার। এই গ্রন্থের প্রেমের ও সৌন্দর্যের কবিতাগুলিতে রবীন্দ্রনাথ এক অভিনব বিন্যাস আনলেন ; বলার ভঙ্গিটি একেবারে অভাবিতপূর্ব, এমনকি রোমান্টিক রসও সম্পূর্ণ কল্পনার …বাইরে ছিল। ‘সোনার তরী’ এবং ‘চিত্রা’য় রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ পরিণত, ‘কড়ি ও কোমল’ তারই সূচনা— মাঝখানে ‘মানসী’ কাব্য। ‘মানসীতেই’ ই রবীন্দ্রনাথের কবিত্ব সম্পূর্ণতা লাভ করেছে। তিনি যে বিশ্বজয়ী প্রতিভার অধিকারী, তার স্বাক্ষর প্রথম রাখলেন ‘মানসী’তে। ভাব কল্পনায় সমৃদ্ধ এমন রসোত্তীর্ণ কবিতা এর আগের কোনো কাব্যগ্রন্থে দেখা যায়নি।
এরপর ‘সোনার তরী’। মানসী’র পর এক বছর তিন মাস সময়ের ব্যবধানে ‘সোনার তরী’ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলি ১২৯৮ সালের ফাল্গুন মাস থেকে ১৩০০ • সালের অগ্রহায়ণ মাসের মধ্যে লেখা। কবির তখন বয়স ৩০-৩২ বছর। ‘মানসী’ গ্রন্থেই দেখা যাবে যে কবির চিত্তে নিরুদ্দেশ সৌন্দর্যের আকর্ষণ অনুভূত হচ্ছিল। ‘অহল্যার প্রতি’ কবিতাতেও দেখা গেল ‘বসুন্ধরার প্রতি’ কবির কেমন এক রোমান্টিক দৃষ্টি। এই সময় তাঁকে জমিদারির কাজকর্মে পদ্মাতীরে বাস করতে হয় ; সেই সময়ই প্রকৃতিকে তিনি নিবিড়ভাবে অনুভব করার সুযোগ পান। পদ্মার বুকের ওপর বসে থাকার সময়ও তিনি প্রকৃতি ও পৃথিবীকে নতুন করে উপলব্ধি করেন। তিনি এই প্রথম উপলব্ধি করলেন যে প্রকৃতি এবং মানুষে মিলে বিশ্বের সৃষ্টি-সৌন্দর্য সম্পূর্ণ করেছে। জমিদারির কাজে এসে তিনি মানুষকে এমন নিবিড় করে উপলব্ধি করার সুযোগ পেলেন, হাসি-সুখে-দুঃখে ভরা সরল সাধা-সিধে মানুষকে দেখলেন পল্লির পটভূমিতে। ‘ছিন্নপত্রের’ পত্রাবলীতে এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত ভাবে বলেছেন।
পদ্মার বুকের উপরে বাস করার সময়ই নিবিড় প্রকৃতিপ্রীতিতে তিনি তন্ময় হয়ে যেতেন ; এই সময়ে প্রকৃতির যে সৌন্দর্য তিনি দেখেছেন, তাকে আরও নিবিড় করে পাবার জন্যে তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে; এই সময়ই নিরুদ্দেশ সৌন্দর্যভাবনায় তিনি ভাবিত হতে শুরু করেন।
“সোনার তরী’তে প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং মানুষের সুখ-দুঃখকে এক সূত্রে কবি গেঁথেছেন। অথবা সৌন্দর্যের হাতছানিতে কবির মুগ্ধতা, অন্যদিকে মানবপ্রীতিতে তিনি উন্মুখর। ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’র তাঁর ব্যাকুল অভিসার, ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় গভীর জীবনাসক্তি। এই দুইটি সুর ‘সোনার তরীতে’ প্রাধান্য লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন—“আমি বুঝতে পারিনে আমার মনে সুখ-দুখ, বিরহ-মিলন-পূর্ণ ভালোবাসা প্রবল, না সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ আকাঙ্ক্ষা প্রবল; আমার বোধ হয় সৌন্দর্যের আকাঙ্ক্ষা আধ্যাত্মিক জাতীয় উদাসী গৃহত্যাগী, নিরাকারের অভিমুখী।”
রবীন্দ্রনাথের কাব্যে বাস্তব জীবনজিজ্ঞাসা এবং অধরা সৌন্দর্যলোকের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা একীভূত হয়ে আছে। ‘সোনার তরী’ গ্রন্থে এই জীবনতৃষ্ণা ও সৌন্দর্য তৃষ্মার অত্যন্ত সুন্দর মেলবন্ধন দেখা যায়। বাস্তব জীবনের রূঢ় পরিপ্রেক্ষিত থেকে কবি তাঁর কল্পনার যাদুতে আমাদের কোন্ দূর এক স্বপ্নলোকে উত্তীর্ণ করিয়ে দেন। নদীমেঘলা বাংলাদেশের এক অখ্যাত নদীতীরেই তিনি দেখতে পেলেন সোনার তরী বেয়ে অচেনা এক নেয়ে তীরে তরণী ভিড়োয়, কখনও কবি নিজেই বিদেশিনী অপরিচিতার সঙ্গে নিরুদ্দেশে যাত্রা করেন, অর্ধ পরিচিত সত্তার উপস্থিতিতে কবি অনায়াসেই এক রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি করেন। এইভাবে মায়াময় এক অলৌকিক জগৎ তৈরি করে তাতে তিনি আনন্দের অনুসন্ধানে মগ্ন হন। তাই আমরা বলতে পারি যে ‘সোনার তরী’ থেকেই কবিচিত্তের পূর্ণ জাগরণ ঘটেছে।
শুধু অলৌকিক সৌন্দর্যের প্রতি রোমান্টিক সংবেদন নয়, মানবমুখিতাও ‘সোনার তরী’র আর এক পরম বিস্ময়। মানুষের সুখদুঃখ প্রেমবেদনা, মিলন বিরহ কবিকে মুগ্ধ করেছে। মানবজীবনে যে আলো ছায়ার খেলা, আশা-নৈরাশ্যের দ্বন্দ্ব–সেদিকেও কবির বিস্ময়বিমুগ্ধ দৃষ্টিপাত ঘটেছে। জীবনের প্রতি তাই কবির এক গভীর অনুরাগ লক্ষিত হয় ; ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটি মানুষের এই প্রেম ভালোবাসার একটি জীবন্ত দলিল বিশেষ। স্নেহ ভালোবাসা আছে বলেই জীবন এমন মধুর; আর মৃত্যু আছে বলেই জীবনের এই মাধুর্য এমনই তীব্রভাবে আমরা উপলব্ধি করার প্রয়াসী হই। প্রিয়জনকে আমরা চিরকাল কাছে ধরে রাখার চেষ্টা করি ; তবু তাকে ছেড়ে দিতে হয়, ‘তবু যেতে দিতে হয়’—জীবনের এই ট্র্যাজিডিকে একটি মরমিয়া দৃষ্টি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বর্ণনা করেছেন। এই কবিতায় (যেতে নাহি দিব) কবির মর্ত্যপ্রীতি এবং মানবপ্রীতি একেবারে একসঙ্গে মিশে গেছে। বিদেশে যাত্রার সময়ে কবি পৃথিবীর মধ্যেও মানবতার আরোপ ঘটালেন, বসুন্ধরার মধ্যে একটি মাতৃমূর্তি অঙ্কিত করে বললেন যে মাতা বসুমতীও তার বুকে তৃণকে আঁকড়ে ধরে বলছে ‘যেতে নাহি দিব’।
‘সোনার তরী’-র অধিকাংশ রচনা এবং বিখ্যাত কবিতাগুলি রবীন্দ্রনাথ হয় পদ্মার বুকে বোটের ভেতরে, না হয়, পদ্মাতীরের শিলাইদহ গ্রামে বসে লেখেন। পদ্মার তীরবর্তী অঞ্চলের নিসর্গ সৌন্দর্যে কবি বিভোর হয়ে থাকতেন। পদ্মার জললীলা, দিনে দিগন্তবিস্তৃত চরে সূর্যালোকের ঔজ্জ্বল্য, রাত্রে জ্যোৎস্নার মায়াময় কুহেলিকা সন্ধ্যার প্রশান্তি এবং রাত্রির স্তদ্ধতা কবির মনকে আলোড়িত করে তোলে, ভাবিত করে কবিকে। কবি ভেবেছেন এই মাটির পৃথিবী শুধুমাত্র বস্তুরূপ নয়, বাহ্যিক সৌন্দর্যের সমষ্টিমাত্র নয়, এই মাটির পৃথিবীর মধ্যে কোথায় যেন এক জননীসত্তা রয়েছে। তাই কবি গাছপালা তৃণলতাগুল্মে প্রাণের স্পর্শ পান, সহজেই অনুভব করতে পারেন—কোন্ বিস্মৃতিলোকের পরপারে তাঁর যেন আত্মীয়তা ছিল এই পৃথিবীর সঙ্গে, তিনি যেন বসুন্ধরার বুকে মাটি হয়ে ঘাস হয়েছিলেন। ‘ছিন্নপত্রে’র একটি চিঠিতেও সেই অনুভূতির কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেছেন—‘এক সময় যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে ছিলুম, যখন আমার ওপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়ত, সূর্য কিরণে আমার সুদূর বিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধ উত্তাপ উত্থিত হতে থাকত, আমি কত দূর-দূরান্তর কত দেশ-দেশান্তর জলস্থল পর্বত ব্যাপ্ত করতে উজ্জ্বল আকাশের নীচে নিস্তদ্ধভাবে শুয়ে পড়ে থাকতুম, তখন শরৎ-সূর্যালোকে আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গে যে একটি জীবনশক্তি, অত্যন্ত অব্যক্ত অর্ধচেতন এবং অত্যন্ত প্রকাণ্ড বৃহৎভাবে সঞ্চারিত হতে থাকত, তাই যেন খানিকটা মনে পড়ে—আমার এই যে মনের ভাব, এ যেন এই প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত মুকুলিত পুলকিত সূর্যসনাথা আদিম পৃথিবীর ভাব।” ‘বসুন্ধরা’ এবং ‘সমুদ্রের প্রতি’ কবিতায় এই বোধের পরিচয় রয়েছে। ‘ছিন্ন পত্রাবলী’র ৭৪ নম্বর চিঠির কথা এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে—“এই পৃথিবীটি আমার অনেক দিনকার এবং অনেক জন্মকার ভালোবাসার লোকের মতো আমার কাছে চিরকাল নতুন ; আমাদের দুজনকার মধ্যে একটা খুব গভীর এবং সুদূরব্যাপী চেনাশোনা আছে। আমি বেশ মনে করতে পারি বহুযুগ পূর্বে তখন তরুণী পৃথিবী সমুদ্রস্থান থেকে সবে মাথা তুলে উঠে তখনকার নবীন সূর্যকে বন্দনা করেছিল, তখন আমি এই পৃথিবীর নূতন মাটিতে কোথা থেকে এই জীবনোচ্ছ্বাসে ঘাস হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলুম !…. আমরা দুজনে একলা মুখোমুখি করে বসলেই আমাদের সেই বহুকালের পরিচয় যেন অল্পে অল্পে মনে পড়ে।
‘সোনার তরী’র বহু কবিতার মধ্যেই ব্যাকুলতার পরিচয় রয়েছে, সমগ্রভাবে সৃষ্টির সঙ্গে কবির কেমনধারা এক রহস্যময় সহানুভূতি জড়িয়ে রয়েছে। শুধু ‘বসুন্ধরা’, ‘সমুদ্রের প্রতি’ প্রভৃতি কবিতা নয়, ‘পরশ পাথর’, ‘বৈক্ষ্ণব কবিতা’ প্রভৃতি কবিতাতেও মানবপ্রীতির সঙ্গে কেমন যেন একটা বিশ্বাত্মবোধ এবং অপরিমেয় এক রহস্যময়তা জড়িত হয়ে রয়েছে। লৌকিক সংসার ছেড়ে অলৌকিক আনন্দের সন্ধানের প্রয়োজন নেই, পরশ পাথরের সন্ধানে সংসার ছেড়ে যাবার দরকার নেই। মানবিক সংবেদনেই জীবনের সফলতা, তাই বাস্তব জগৎকে ছেড়ে আদর্শের পিছনে ছুটলে ব্যর্থতা আসতে পারে। ‘বৈব-কবিতা’র মধ্যেও এই জীবনপ্রীতি । পার্থিব সংসারে মানুষের প্রেমের মধ্যেই অসীমের রহস্য গোপনে লুকিয়ে রয়েছে, তাই সম্পূর্ণ আত্মনিবেদনে যে প্রেম সার্থকতা লাভ করে তার মধ্যেই ঐশ্বরিক পূজার উপযোগী প্রেম তৈরি হয়ে যায়। মানুষদেবতাই রূপান্তরিত হয় অধ্যাত্ম জগতের আরাধ্য দেবতায়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ‘সোনার তরী’তে প্রাধান্য লাভ করেছে নিরুদ্দেশ সৌন্দর্যের আকাঙ্ক্ষা বিষয়ক কবিতা আর পৃথিবীর সঙ্গে জন্মান্তরীণ আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কল্পনামূলক কবিতা। আর আছে এই কল্পনা থেকে আগত মর্ত্যানুরাগের কবিতা। এছাড়া বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা কবিতাও আছে, যেমন ‘বর্ষা যাপন’, ‘মুক্তি’, ‘মায়াবাদ’। ‘বর্ষাযাপনে’ শুধু বর্ষাপ্রকৃতির চিত্ররূপের উপস্থাপনা নেই, প্রকৃতির বর্ষা কেমন করে কবিচিত্তে রস-বর্ষার উদ্বোধন ঘটায়—সেই পুলকাশ্রিত অনুভবেরও পরিচয় রয়েছে। ‘দুই পাখী’ ‘পরশপাথর’ প্রভৃতি রূপক কবিতা ৷ ‘দুই পাখী’ কবিতার মধ্যে কবির রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ধরা পড়েছে মানুষের মধ্যে যে দুটি সত্তা রয়েছে, সেই মুক্তা সত্তা আর আবদ্ধ সত্তা। এছাড়া ‘ঝুলন’ কবিতায় কবি নিজের অন্তরের আমিত্বের একটি বড়ো পরিচয় দিয়েছেন, আরামে, আলস্যে, বিলাসে আমাদের অস্তরময় প্রাণসত্তা জড় হয়ে পড়ে, তাকে আঘাত জাগাতে হবে।
‘সোনার তরী’তে পার্থিব প্রেম আর প্রকৃতির সৌন্দর্যরস কবিকে উন্মনা করেছে। বিশ্বব্যাপী প্রাণচঞ্চল্য মুগ্ধ করেছে কবিকে। মানবলোক এবং প্রাকৃত জগতে প্রবেশ করে কবি যে মাধুর্য ও সৌন্দর্য আহরণ করেছেন তারই রসভাস্য হচ্ছে ‘সোনার তরী’ কাব্য।
এই কাব্যে রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণরূপে রোমান্টিক মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। বাস্তবকে যখন বাস্তবাতীত করে দেখা যায়, তখনই তো রোমান্টিক চেতনায় উন্নীত হয়। সুন্দর বস্তু অতি সুন্দর হয়, সৌন্দর্যের সঙ্গে এসে যুক্ত হয় কেমন এক রহস্যময়তা। এটা সম্ভব হয় কল্পনার প্রক্ষেপে । বস্তুত যথার্থ সত্তার শিল্পী যখন ‘আপন মনের মাধুরী’ মিশিয়ে দেন কল্পনার মধ্যে, তখনই তাতে বস্তু-অতীত এক রহস্যময় সৌন্দর্যের আভাস দ্যোতিত হয় ; যে কবি বস্তুকে ছাড়িয়ে গিয়ে তার ভেতরের কোনো রহস্যময় দিককে কল্পনার সাহায্যে পাঠকের কাছে উন্মোচন করে দেন, সেই কবিকেই রোমান্টিক কবি বলা চলে। প্রকৃতির বাস্তবরূপ তখনই কবির কল্পনায় এক নতুন রহস্যময় চেহারা ধারণ করে। একেই ইংরাজিতে বলা হয় ‘Strangeness added to beauty.
রোমান্টিক মানুষ সব সময়ই সুদূরের পিয়াসী। যা প্রাপ্ত, যা অধিগত—তাতে এই রোমান্টিক মন পরিতৃপ্ত নয়, যা পাওয়া যায়নি, যাকে সহজে ধরা যায় না, এমনকি আদৌ যা ধরা ছোঁয়ার বাইরে, সেই অপ্রাপনীয় এবং অধরকে ধরার জন্য রোমান্টিক কবির ব্যাকুলতা থাকে। কল্পনায় কবি অতীতে এবং ভবিষ্যতে অবগাহন করে থাকেন, তাঁর মনে বিস্মৃতপ্রায় সুদূর অতীত এবং আগামীকালের অনাগত ভবিষ্যৎ একীভূত হয়ে যায়।
‘সোনার তরী’তে কবির মনে শুধু অজানা স্বপ্নের বেদনা বা অনির্দেশ্য সৌন্দর্য-ব্যাকুলতা নয়, সব কিছুর মধ্যেই রোমান্টিক সংবেদনের সংরাগ সিশ্চিত হয়েছে। বসুন্ধরার সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তার যে বন্ধন তিনি কল্পনায় স্থাপিত করেছেন—তা একেবারেই রোমান্টিক মননের প্রকাশ। অচেনা বিদেশিনী নারীর সান্নিধ্যলাভের বাসনায় সৌন্দর্যপুরীতে পৌছবার যে ব্যাকুল বাসনা কবিকে অধীর করে তুলেছে—তাতেও ধ্বনিত হয়েছে রোমান্টিক সুরই। ‘সোনার তরী’র প্রথম কবিতাটিতে বা সর্বশেষের ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতাতে, কিংবা ‘বসুন্ধরা’, ‘সমুদ্রের প্রতি’ প্রভৃতি কবিতায়—সর্বত্রই কবির এই রোমান্টিক সত্তা প্রকাশ।
সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের নামকরণ :
রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থগুলির নামকরণ বিচার করলে দেখা যাবে যে কবি এবিষয়ে বিশেষ কোনো একটি পদ্ধতি অবলম্বন করেননি। কী তাঁর গল্প উপন্যাসে, কী তাঁর কাব্যগ্রন্থে সহজে তাঁর মনে যখন যে নাম এসেছে—তাই দিয়ে তিনি সেই বই চিহ্নিত করেছেন; ফলে কোনো গ্রন্থের নামে বাড়তি তাৎপর্য এসেছে, রূপক আশ্রিত হয়েছে, কখনও একেবারে সাধাসিধে শীর্ষমান হয়েছে। রূপক নাটকের নামকরণে কবি যে সতর্কতা নিয়েছিলেন, কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রে তেমন কোনো মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় না তাঁর।
‘সোনার তরী’ নামকরণের মধ্যে যথার্থ কিছু কারণ আছে কিনা তা দেখা আমাদের উচিত। মনে হয় তরণী কখনও সোনা দিয়ে তৈরি হয় না; আর তা হলেও, তাকে জলে ভাসানো চলে না, কারণ সোনার তরণী জলে ভাসে না ; অচিরেই তা ডুবে যাবে। সুতরাং সোনার তরীর আক্ষরিক অর্থ বাস্তব সত্যের সঙ্গে কখনও সাযুজ্য রক্ষা করছে না। বস্তুসত্তায় যখন স্বর্ণনিমিত তরী নেই, তখন ‘সোনার তরী’ বলায় একটা ব্যঞ্জিত অর্থের সূচনা হয়েছে। কবির রোমান্টিক মানসপ্রবণতার প্রকাশ ঘটেছে এই নামে। কবিকল্পনায় সৌন্দর্যের অনুসন্ধানে এক মায়াময় অলৌকিক জগতের আভাস ফুটে উঠেছে ; কবির কাছে আধো চেনা, আধো-অচেনা বিদেশিনী এসেছে, সৌন্দর্যের দেশে কবি ছুটেছেন; মাটির সঙ্গে মানুষের সঙ্গে এক রহস্যময় আত্মীয়তা অনুভব করেছেন কবি। সবই তাঁর রোমান্টিক মানসিকতার ফসল। বিদেশিনী নাবিকের তরণীর বর্ণও হিরণ। এই গ্রন্থের প্রথম কবিতার নাম ‘সোনার তরী’ কিংবা ওই ‘সোনার তরী’ নামের কবিতার জন্যেই গ্রন্থের এই নামকরণ হয়েছে কিনা তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন।
কৈশোরে রবীন্দ্রনাথ একদা বিহারীলাল চক্রবর্তীর ভাবকল্পনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে শোনা যায়। প্রেম-সৌন্দর্যের উপাসক কবি ছিলেন বিহারীলাল। তাঁর একটি গানের দুটি পঙ্ক্তির কথা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে; সেই দুটি পংক্তি হল—‘সোনার তরী নয়নে নাচে নাচে /পা না দিতে ডুবে আচম্বিতে….। এই দুই পঙক্তির মধ্যে একটা সৌন্দর্য-কল্পনার কথা রয়েছে। সোনার তরীতে পা দিতে পারা যায় না, পা দিলেই তৎক্ষণাৎ তা ডুবে যায়। অর্থাৎ আদর্শলোকের এই সুন্দর কল্পনা-তরণী—যা হিরণনির্মিত—তাতে পার্থিব বস্তুর কোনো ভার চাপানো যাবে না। এই আদর্শলোকের ব্যাখ্যা হিসেবে আমরা রহস্যময় প্রেম ও সৌন্দর্যের বিষয়কে ধরতে পারি; অন্তত, রবীন্দ্রনাথের মনে এইরকম একটা আদর্শ সোনার তরীর কল্পনা গড়ে তুলতে পারে। স্থূল বাস্তবের সংস্পর্শে এলে সৌন্দর্যের জগৎ নষ্ট হয়, প্রেমের অলৌকিকত্ব যায় হারিয়ে। এই বোধের পরিপোষকতা রয়েছে ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতায়—সেটিকে আমরা ‘সোনার তরী’ কবিতার পরিপূরক হিসাবে গণ্য করতে পারি ৷ সোনার তরী এমনই যে, বাস্তব জগতের আঘাত সে সহ্য করতে পারে না। এই কাব্যে প্রেম ও সৌন্দর্য কল্পনায় রবীন্দ্রনাথ এমনই একটি আদর্শের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত-ও দিয়েছেন যেদিক থেকে এই গ্রন্থের নামকরণে এই ব্যঙ্গার্থ দ্যোতিত হচ্ছে।
এছাড়া ‘সোনার তরী’ গ্রন্থের অনেক কবিতাতেই স্বর্ণবর্ণের কল্পনা রয়েছে।
এই সময়ে কবির মনে সোনার রঙের বর্ণাঢ্যতা অপূর্ব আমেজের সৃষ্টি করেছিল। স্বর্ণবর্ণকে তিনি বিশিষ্ট সৌন্দর্য-কল্পনার দ্যোতক বলে ভেবেছেন কাব্যখানির নাম রেখেছেন ; ‘সোনার তরী’। এমনকি ধানও হয়েছে সোনার (‘আমারই সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’)।
দ্বিতীয় কবিতা ‘বিম্ববর্তীতেও দেখি রানি কোলের ওপর ‘সুবর্ণমুকুর’ রেখেছেন। ‘সোনার বাঁধন’ কবিতাতেও সোনার উল্লেখ। ‘পরশপাথর’ কবিতাতেও ‘নিকষে সোনার রেখা রয়েছে। সন্ধ্যার বর্ণনাতেও স্বর্ণের উপমান—
আকাশ সোনার বর্ণ, সমুদ্র গলিত স্বর্ণ,
পশ্চিমদিগ্ধধু দেখে সোনার স্বপন।
‘দুই পাখি’ কবিতায় সোনার খাঁচায় থাকা পাখিকেও আমরা দেখতে পেয়েছি। ‘আকাশের চাঁদ’ কবিতাতেও রয়েছে ‘সোনার ক্ষেত্রে কৃষাণ বসিয়া কাটিতেছে পাকা ধান। এই কবিতার আরও একটি পঙ্ক্তি হল ‘অস্ত রবির সোনার কিরণে নূতন বরণে লেখা।… ‘সোনার জীবন রহিল পড়িয়া, কোথা সে চলিল ভেসে। ‘মানস সুন্দরী’ কবিতায় মদিরাটুকু পর্যন্ত ‘সুবর্ণমদিরা’ হয়েছে। সন্ধ্যার রং স্বর্ণবর্ণ, ঊষারও তাই—
সন্ধ্যার কনকবর্ণে
রাঙিছ অঞ্চল ; ঊষার গলিত স্বর্ণে
গড়িছ মেখলা ;
প্রভাতের বর্ণনা বা সন্ধ্যার বর্ণনায় সোনার উল্লেখ প্রায় সব কবিতাতেই। স্বর্ণবর্ণ এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের মনকে আপ্লুত করে রেখেছে, যা-কিছু বস্তু তাতে কল্পনার খর কিরণপাত হওয়ায় তা স্বর্ণবর্ণের রোমান্টিক চেতনায় উদ্ভাসিত হয়েছে। তাই প্রেম ও সৌন্দর্যের স্বপ্নকে, কবি স্বর্ণরঙিন ঔজ্জ্বল্যে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। তাই তরী তাঁর সোনার, প্রেমের অভিজ্ঞানও হিরণবর্ণের ঔজ্জ্বল্যে ঝলোমলো। এই জন্যে বলা যায় যে বহিরঙ্গের অর্থে ‘সোনার তরী’র যতটুকু মূল্য থাক, অন্তরঙ্গে ‘সোনার তরী’ একটি ব্যঞ্জিত অর্থ বহন করেছে। এদিক থেকে দেখলে ‘সোনার তরী’ কাব্যের নামকরণ অত্যন্ত সার্থক হয়েছে বলা চলে।
সোনার তরী কবিতার আবেদন :
কবিতাটিতে বর্ষার পটভূমি সর্বাগ্রে আমাদের মনকে নাড়া দেয়। পদ্মাতীরের শ্রাবণ আকাশে ঘিরে যখন নিবিড় মেঘ জমে, ধারাবর্ষণ শুরু হয় নির্জন নদীতীরে, জলে ডুব ডুব খেতের ছোটো ভূমিখণ্ডে ব্যাকুল কৃষকের পরপারে যাওয়ার জন্যে প্রতীক্ষা, দূর পরপারে তরুছায়া বেষ্টিত মসীমাখা গ্রামের ছবি—সব মিলিয়ে কবিতাটিকে অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছে। এর সঙ্গে মিলেছে কবি হৃদয়ের বেদনাময় ব্যাকুলতা, কবি একলা বসে আছেন, কোনো ভরসা নেই তাঁর মনে। চেনা-অচেনার মধ্যবর্তিনী এক স্মৃতির আবির্ভাব কবির এই ব্যাকুল আর্তিকে আরও করুণ করে তুলল। কবির মনে জাগলো মিলন পিপাসা, সৌন্দর্যলোকে যাবার বাসনা। তাই সোনার তরীর নেয়ের কাছে আকুল প্রার্থনা এখন আমাকে লহ করুণা করে। কিন্তু কল্পনায় সৌন্দর্যের যে অধিলক্ষ্মীকে আমরা দেখি তার সঙ্গে মিলন ত’ সম্ভব নয়; তাই বিরহ মর্মান্তিকভাবে উপস্থিত হতে বাধ্য। ফলে কবিকেই ব্যর্থ ও নিরাশ হতে হয়েছে। সুতরাং কবিতাটির মধ্যে চিত্ররস ও গীতিধ্বনির মাধুর্য অপূর্বতা লাভ করছে এর কারুণ্যের মধ্যে।
Leave a comment