সাহিত্যালোচনায় চিত্রকল্প একটি বহুল প্রযুক্ত শব্দ। চিত্রকল্প কথাটির সমপর্যায় ভুক্ত শব্দ রূপকল্প। একটু কম বা অল্পার্থে কিংবা তুল্যার্থে কল্প কথাটির ব্যবহার হয়— ‘ঈষদূণকল্পবৃদেশ্যদেশীয়ঃ চিত্রের থেকে একটু অল্প বা চিত্রের মতো এই অর্থ প্রকাশক শব্দ চিত্রকল্প। সুপটু পটুয়ার দল তাঁদের লীলায়িত তুলিকায় পটে পটে নানা চিত্র আঁকেন, ভাস্করেরা সূক্ষ্ম তক্ষণ যন্ত্রে শিলাফলকে ও দারুখণ্ডে ফুটিয়ে তোলেন নানা রূপ। কবিসাহিত্যিবৃন্দ শব্দ দিয়ে এমন চিত্র ও রূপ আঁকেন যা পাঠকবর্গের মানসক্ষেত্রে প্রকৃতি তথা নিসর্গ এবং হৃদ্‌গতভাবে প্রতিভাসিত করতে থাকে।

এ বিষয়ে স্বভাবোক্তি, সমাসোক্তি, রূপক ধ্বন্যুক্তিজাতীয় অলংকার ও শব্দকলা কবিসাহিত্যিককে সহায়তা করে। বাকপতি ও কাব্যকলাকোবিদ রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কাব্যের চিত্রকলা প্রসঙ্গ আমাদের আলোচনার বিষয়।

এই আলোচনায় সোনার তরী কাব্যের প্রথম কবিতা বা নামভূমিকার কবিতা সোনার তরীকে আমরা প্রথমে গ্রহণ করতে পারি। সোনার তরী কবিতা থেকে চিত্রকল্প ঋদ্ধ উদাহরণ উৎকলনের পূর্বে রবীন্দ্রনাথের একটি পত্রাংশ উদ্ধৃত করে দিই : ছিলাম তখন পদ্মারবোটে। জলভারনত কালোমেঘ আকাশে, এপারে ছায়াঘন তরুশ্রেণির মধ্যে গ্রামগুলি বর্ষার পরিপূর্ণপদ্মা খরবেগে বয়ে চলেছে, মাঝে মাঝে পাক খেয়ে ছুটেছে ফেনা। নদী অকালে কূল ছাপিয়ে চরের ধান দিনে দিনে ডুবিয়ে দিচ্ছে।…ভরা পদ্মার উপরকার ওই বাদল দিনের ছবি সোনার তরী কবিতার অন্তরে প্রচ্ছন্ন ও ছন্দে প্রকাশিত।

রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলে পদ্মাপারের গ্রাম, সে গ্রাম তরুবীথিকার পত্র পুঞ্জে ছায়াবৃত, তার সঙ্গে মিলেছিল শাওনের কালো মেঘের আবরণ ; কবি শব্দে-ছন্দে আঁকলেন ছবি, যেন পটে আঁকা। যৌবনের বেগবতী নদীর ক্ষুরধারা খরপরশা স্রোতারাশির বঙ্কিমরেখা ও জলাবর্তবেষ্টিত খণ্ড এক ভূমিভাগে বসে কবি দৃষ্টি দিয়েছেন পরপারে। চিত্রকল্প স্তবকিত হয়ে উঠেছে কবির নিপুণ লেখনী সম্পাতে

একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা, 

চারিদিকে বাঁকাজল করিছে খেলা। 

পরপারে দেখি আঁকা 

তরুচ্ছায়া মসী মাখা 

গ্রাম খানি মেঘে ঢাকা 

প্রভাতবেলা 

এপারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।

কিংবা

শ্রাবণ গগন ঘিরে

ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে শূন্য নদীর তীরে

রহিনু পড়ি

—ইত্যাদি পক্তির চিত্রকল্পে কম চমৎকারী নয়।

এবার আমরা পরশপাথর থেকে চিত্রকল্পের উদাহরণ তুলি। ক্ষ্যাপার হারানিধি পরশপাথর খুঁজতে যাওয়ার মুহূর্ত। তখন দিনান্ত। দিনান্ত সূর্যে কান্তি ও মালিন্য ; অস্তাচলাবলম্বী দিনমণির কিরণস্পর্শে ঊর্ধ্বে অসীম আকাশ সোনা সোনা, বিশাল জলাধি জল তরলায়িত সুবর্ণের দ্যুতিতে পুরপূর্ণ, পশ্চিমদিক্-রূপিণী বধূ পথিকপ্রিয়ার মতো প্রিয়মিলনের সোনালি স্বপ্নে সমাচ্ছন্ন।

তখন যেতেছে অস্তে মলিন তপন 

আকাশ সোনার বর্ণ    সমুদ্র গলিত স্বর্ণ

পশ্চিমদিগ্বধূ দেখে সোনার স্বপন।

এই চিত্রধর্ম একান্ত সুন্দর। চিত্রধর্মশালিনী এই বর্ণনা কেবল বর্ণনার জন্য নয়। সন্ন্যাসীর ব্যর্থ শ্রমের শান্তিকে কবি দিনাবসানের অস্তায়মান সূর্যের মালিন্যের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন, সন্ধ্যার কনককান্তিতে আকাশ-সমুদ্রের রূপকে করেছেন মূর্ত।

ক্ষান্তবর্ষণ শরতের খরবহা ভরাগঙ্গা ও শুভ্র খণ্ডমেঘকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্বভাবোক্তিতে চিত্রকল্পচারু বর্ণনার সামান্য অংশ যেতে নাহি দিব থেকে তুলে দিই—

বহে খরবেগ

শরতের ভরাগঙ্গা শুভ্ৰখণ্ডমেঘ 

মাতৃদুগ্ধ পরিতৃপ্ত সুখনিদ্রারত

সদ্যোজাত সুকুমার  গোবংসের মতো

নীলাম্বরে শুয়ে।

বসুন্ধরা কবিতায় চিত্রকল্পরুচিরা কবিশিল্পসুষমা অপরূপা হয়ে আছে। তাদের একটি গ্রাম সমুদ্র তটবর্তী ও পর্বতসংকটস্থ। গ্রামটি ধীবর লোকালয়ের তীরে জাল শুকানো, জলে ভাসানো তরী, সেখানে পাল ওড়ে, মাছ ধরতে যাবে জেলেরা। সংকীর্ণ এক নদী সেখানে এঁকে বেঁকে বয়ে আছে—

সমুদ্রের তটে ছোটো ছোটো নীলবর্ণ পর্বত-সংকটে

একখানি গ্রাম, তীরে শুকাইছে জাল জলে ভাসিতেছে তরী, উড়িতেছে পাল

জেলে ধরিতেছে মাছ, গিরিমধ্য পথে 

সংকীর্ণ নদীটি চলি আসে কোনো মতে

আঁকিয়া বাঁকিয়া ;

অন্য এক উল্লেখ্য উদাহৃতি। সন্ধ্যাসময় সমাসন্ন; বিশাল প্রান্তরে ম্লানালোকের বিস্তার দূরবর্তী গোষ্ঠ থেকে ক্ষুরে ক্ষুরে ধূলি উড়িয়ে গাভীদের ঘরে ফিরে আসা। গাছে ঘেরা গ্রাম থেকে ধুঁয়ো ওঠে, চন্দ্রলেখা দেখা যায় দূরা আকাশে ; মনে হয় পদ্মাতীরস্থ গ্রামজনপদের এক চিত্র কবিতাপটে কবি আঁকলেন।

হেরি ঘরে সম্মুখেতে সন্ধ্যার কিরণে 

বিশাল প্রান্তর যবে ফিরে গাভীগুলি

দূরে গোষ্ঠে মাঠপথে উড়াইয়া ধূলি 

তরুঘেরা গ্রাম হতে উঠে ধূমলেখা

যবে চন্দ্র দূরে যায় দেখা….

শব্দে-শব্দে রবীন্দ্রনাথের চিত্রায়ণনৈপুণ্য বিষয়ে আমাদের শেষ উদাহরণ নিরুদ্দেশ যাত্রা থেকে। কুলহারা পারাবারের ঘননীলনীরে দ্রুতঘনায়মান রজনি পাখির মতো পাখা মেলে আসছে। সায়ন্তনী আকাশভূমির স্বর্ণালোকদ্যুতি রাত্রির কালো-কালিমায় ঢাকা পড়ে যাবে শীঘ্রই। উপমাগৰ্ভিত সমাসোক্তি চিত্রকল্প নির্মাণে সহায়তা করেছে :

আঁধার রজনি আসিবে এখনি 

মেলিয়া পাখা

সন্ধ্যা আকাশে স্বর্ণ আলোক

পড়িবে ঢাকা।