রবীন্দ্রনাথ কেবল মানবপ্রেমিকই ছিলেন না, ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিকও। এই প্রকৃতি তাঁর আনন্দের অথবা নিছক অবসর বিনোদনের সঙ্গী নয়, তাঁর আলস্যের নিষ্ফলা ক্রীড়াসহচরী নয়। এই প্রকৃতি তাঁর জীবনদায়িনী, তাঁর ব্যক্তি আর ভাবসত্তার মূলাধাররূপী জননী। বিশ্বের কবিদের কাছে প্রকৃতি নানার রূপে আর বর্ণে নিজেকে ধরা দিয়েছে ; কাউকে আনন্দ দিয়েছে, কাউকে করেছে বিষণ্ণ। ইংরাজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাছে প্রকৃতি হচ্ছেন শিক্ষাদায়িনী মাতা। নিছক শিক্ষাদায়িনী বললে ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রকৃতিপ্রেমের স্বরূপ উদ্‌ঘাটিত হয়’না। প্রকৃতির আবেদন তাঁর রক্তের মধ্যে দোলা দিয়েছে, অথবা, প্রকৃতিচেতনাই তাঁর কাছে মানুষের সত্যিকার চেতনা; মানুষের এত দুঃখ আর যাতনার আসল কারণটা তাই তাঁর কাছে এই যে মানুষ প্রকৃতির সৎ-সাহচর্যকে পরিত্যাগ করে আধুনিক বস্তুতান্ত্রিক যুগের আগুনে আত্মবিসর্জন দিয়াছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অনুভূতি আরও তীব্র, আরও সুদূরপ্রসারী। প্রকৃতি তাঁর কাছে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব নিয়ে আবির্ভূতা হয়নি; প্রকৃতি তার জননীস্বরূপ ; প্রকৃতির সঙ্গে তিনি একান্ত। তাই তিনি বলেছেন, একদিন এই প্রকৃতির জলে স্থলে, আলো-বাতাসে, বৃক্ষ-পল্লবে, মাটি-পাথরে তিনি মিশেছিলেন, সে কত দিন আগে তা তিনি জানেন না। তারপরে সৃষ্টির রহস্যময় বিবর্তনে তিনি প্রকৃতির কাছ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছেন, কিন্তু প্রকৃতি তাঁকে ভুলে যায়নি; ঋতুতে প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্তে প্রকৃতি তাঁকে ডাকছে ; হারিয়ে যাওয়া শিশুর মতো কবি তাঁর সেই মাকেই অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছেন।

‘বসুন্ধরা’ কবিতাটিতে কবির সেই ব্যাকুল আর্তনাদ উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠেছে। মাতৃহারা শিশুর মতো কবি বসুন্ধরাকে তাই সম্বোধন করে বলেছেন— 

আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে,

কোলের সস্তানে তব কোলের ভিতরে

বিপুল অঞ্চলতলে।

কবি প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসেছেন। কিন্তু তাঁর তো স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব নেই। এই অসংখ্য পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, নদী-নালা, বন-উপবন, পাহাড়-পর্বত, আকাশ-বাতাস এরাও বিচ্ছিন্ন নয়; মহাপ্রকৃতির অঙ্গ। তাই কবির সঙ্গে তারাও একান্ত ; কবির প্রাণসত্তার সঙ্গে তাদের প্রাণসত্তার মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই; যেটুকু পার্থক্য দেখা যায় তা কেবল বাহ্যিক। এবং বাহ্যিক বলেই, প্রকৃতির সেই আনন্দের ভোজ থেকে নিজেকে তিনি দূরে সরিয়ে রাখতে চান না ; এই বিশ্বজোড়া অসংখ্য বৈচিত্র্যের মধ্যে কত আনন্দই না পরিবেশিত হচ্ছে কৰি দুচোখ দিয়ে সেই আনন্দ দেখছেন; কিন্তু সেই আনন্দযজ্ঞে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারছেন না ; রবাহূতের মতো একপাশে তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কবি তা চান না। তিনি চান সেই আনন্দে অন্য সকলের সঙ্গে সমান অংশীদার হতে। পৃথিবীর আনন্দে কি শেষ রয়েছে! প্রকৃতি তাঁকে আনন্দ দেওয়ার জন্যে নিত্য নতুন আনন্দের সমাবেশ করছে। তাই তিনি বলেছেন—‘এই পৃথিবীটা আমার কাছে অনেক দিনকার ও অনেক জন্মের ভালোবাসার লোকের মতো আমার কাছে চিরকাল নতুন ; আমাদের দুজনের মধ্যে একটা খুব গভীর এবং সুদূরব্যাপী চেনাশোনা আছে। নিজে যে তিনি সেই বসুন্ধরারই অঙ্গীভূত তা তিনি অন্তরের মধ্যে উপলব্ধি করেন বলেই তিনি বলেছেন—’সেই বিশ্বের মধ্যে দিয়া প্রবাহিত অস্তিত্বধারায় বৃহৎ স্মৃতি তাঁহাকে অবলম্বন করিয়া আমার অগোচরে আমার মধ্যে রহিয়াছে। সেইজন্য এই জগতের তরুলতা পশুপক্ষীর সঙ্গে এমন একটা পুরাতন ঐক্য অনুভব করিতে পারি—সেইজন্য এত বড়ো রহস্যময় প্রকাণ্ড জগতটাকে অনাত্মীয় ও ভীষণ বলিয়া মনে হয় না।

এইখানেই রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিপ্রীতি একটি আধ্যাত্মিক অনুভূতির শিখরে উঠেছে ; ‘বসুন্ধরা’ কবিতাটি কবিমানসের সেই অনুভূতিরই মূর্তপ্রকাশ। তাঁর কবিসত্তার রহস্যময় নিগূঢ়তম ব্যঞ্জনা। বিশ্বের অজস্র সৌন্দর্যকে অতৃপ্ত নয়নে দেখে দেখে তাঁর মনের মধ্যে নিজেকে সেগুলির সঙ্গে একান্তভাবে মিশিয়ে দেওয়ার জন্যে কবির যে অতৃপ্ত বাসনা জেগেছে তারই দলিল এই ‘বসুন্ধরা’—মাতৃরূপিণী প্রকৃতির কাছে কবির আত্মনিবেদন।

তোমার বিপুল প্রাণ বিচিত্র সুখের 

উৎস উঠিতেছে যেথা, সে গোপন পুরে

আমাকে লইয়া যাও–রাখিও না দূরে।

যেদিন তিনি আর এ জগতে থাকবেন না সেদিনও তাঁরই আনন্দ বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়বে : কারণ, এই বসুন্ধরার তিনিও যে একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ; আবার সেদিন তিনি নূতন রূপে ফিরে আসবেন সেদিনও তিনি এই প্রকৃতিরই একটি অবিচ্ছেদ অঙ্গ হয়ে জন্মাবেন এই মাটি-পাথর-কীট-পতঙ্গ-পশু-পাখি-মানুষ— সকলের সঙ্গে একাত্ম, এক পরিবারের অংশীদার হয়ে। এইটি কবির আশা নয়, প্রত্যয়।