মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, 

মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।

এই যার অন্তর্লোকের ঐকান্তিক অভিপ্রায় তাঁর সৃষ্টির বিষয় সে মর্ত্যলোকের মানবিক অনুভূতি তথা মমত্ববোধের দিক কিংবা মানবপ্রীতির দিক হবে সে বিষয়ে সংশয়াতীত ধারণালোকে উপনীত হওয়া যায়। রবীন্দ্র সৃষ্টি মানেই মর্ত্যপ্রীতি তথা মানবপ্রীতির মাধ্যমে সম্পূর্ণতার মধ্যে উপনীত হওয়ার ঐকান্তিক অভিশ্বাসের অভিব্যক্তি। মা, মাটি, মানুষের প্রতি রবীন্দ্রনাথের প্রগাঢ় অনুরাগের দিকটি তাঁর বহু সৃষ্টির মধ্যে স্পষ্টরূপে প্রত্যক্ষ করা যায়। মৃত্তিকা সংলগ্ন মানুষের কথা, মানবিক মমত্ববোধের কথা, সত্যপ্রীতির কথা, মাটির মানুষের সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, আনন্দ বিষাদ, জন্মমৃত্যুর কথা ‘সোনার তরী’র বহু কবিতায় স্পষ্টোজ্জ্বল। কাব্যের সূচনাংশে কবির বক্তব্য থেকে রবীন্দ্রনাথের মর্ত্যলোকের প্রতি অনুরাগ তথা মানবপ্রীতির নিদর্শন স্পষ্ট উপলব্ধ। কবিকথায় তার উপস্থাপনা—“আমার বুদ্ধি এবং কল্পনা এবং ইচ্ছাকে উন্মুখ করে তুলেছিল এই সময়কার (সোনার তরী) প্রবর্তনা–বিশ্ব প্রকৃতির এবং মানবলোকের মধ্যে নিত্য সচল অভিজ্ঞতার প্রবর্তনা, এই সময়কার প্রথম কাব্যের ফসল ভরা হয়েছিল সোনার তরীতে।”

প্রকৃতি এবং মানুষ সম্পর্কে কবির নতুন পরিচয় তাঁর কাব্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে অভিনব প্রাণচেতনার সঞ্চার করে। ‘সোনার তরীতে’ মানুষ এবং প্রকৃতি চেতনার ক্ষেত্রে কবির অভিনব প্রাণ সঞ্চারের দিকটি উপলব্ধি করা যায়। হৃদয়াবেগের মুগ্ধতা নয়, প্রকৃতি ও মানুষকে পূর্ণসত্তায় প্রত্যক্ষ করে তিনি নব যুগের আবহনে আত্মনিয়োজিত হলেন । মানুষের মনোজগতের কথা অভিব্যক্ত এ কাব্যের পরতে পরতে। কবির বিশ্ববোধ, বিশ্বের রহস্যময়তা ও সৌন্দর্য ধ্যানমগ্ন মূর্তি এ কাব্যের অনেক কবিতাতে ফুটে উঠেছে। এ আলোকে কবির মর্ত্যপ্রীতি ও মানবপ্রীতির দিক উপলব্ধ হয়, বাস্তব বিশ্বের সত্য ও সুন্দরের পূজারি তিনি। এই সত্য ও সুন্দর চেতনার সঙ্গে যুক্ত মানবমনন। ‘সোনার তরীতে কবির মর্ত্যমানবের প্রতি ভালোবাসার বিচিত্র অনুভূতি ভাষা পেয়েছে। মানুষের মর্ত্যলোকের প্রতি মমত্ববোধ মানুষের স্নেহ, প্রেম, প্রীতির বন্ধন সোনার তরীর অধিকাংশ কবিতাতে প্রকাশিত।

সোনার তরী : ধূলিধূসর ধরণির প্রতি কবিচিত্তের প্রগাঢ় অনুরাগ রঞ্জিত দিকের অভিব্যক্তিতে প্রোজ্জ্বল সোনার তরীর আধার। পদ্মা সান্নিধ্যে এসে কবি ধরিত্রীকে নতুন রূপে আবিষ্কার করলেন। গণ্ডিবদ্ধ জীবন থেকে বেরিয়ে এসে আকাশ বাতাস নদী নির্ঝরিণীর নৈকট্যে তিনি বসুন্ধরা জননীর শাস্ত কোমল রূপ রসে গন্ধে ভরা নূতন স্বরূপ উপলব্ধি করলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন, জন্ম-জন্মান্তর ধরে পৃথিবী জননীর সঙ্গে কবি সন্তানের নাড়ির টান।

সমুদ্রের প্রতিও প্রকৃতি মানবের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের বিশ্বসৌন্দর্য বোধের, মানসিক চেতনার পারস্পরিক সম্পর্ক সূত্রের নিবিড় বন্ধন রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির মধ্যে পর্যাপ্ত দৃষ্ট, কোথাও ব্যক্ত করেছেন। ‘সমুদ্রের প্রতি’ কবিতার মধ্যে কেবলমাত্র কবির নিসর্গ প্রকৃতিতে দিকই সেই ; এখানে মানবপ্রীতির মর্ত্য মমত্ববোধের, মানুষের নানা অনুভূতি ময়তার দিকও পরিস্ফুট। এখানে কবি আসলে প্রকৃতি ও মানুষকে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিয়েছেন। কবি এই কবিতায় নিজেকে ‘পৃথিবীর শিশু’ বলে উল্লেখ করেছেন। সমুদ্রের বিরাট জঠরে লক্ষকোটি বর্ষব্যাপী অবস্থানরত তিনি, কবির ভাষায় সেই নাড়ির টানের নিবিড় উপলব্ধি—

“সেই জন্ম পূর্বের স্মরণ 

গর্ভস্থ পৃথিবী ‘পরে সেই নিত্যজীবন স্পন্দন

তব মাতৃ হৃদয়ের।”

বসুন্ধরা : ধূলিধূসর ধরণির প্রতি কবির গভীর মমত্ববোধের প্রকাশ আরও সৃষ্টি হয়েছে বসুন্ধরা কবিতার মধ্যে। সেখানে কবি বসুন্ধরা জননীর বক্ষমাঝে, মা মৃন্ময়ী কোলের ভিতরে ব্যপ্ত হয়ে থাকতে চেয়েছেন—

আমাদের ফিরায়ে লহ অয়ি বসুন্ধুরে 

কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে

বিপুল অঞ্চল তলে।

কবির মানব ভাবনা, মর্ত্যপ্রীতির প্রকাশ অত্যন্ত গূঢ় গভীররূপে এখানে প্রত্যক্ষিত হয়। সুন্দরী বসুন্ধরার প্রতি তাঁর মনোভাব যেভাবে ব্যক্ত তার আলোকে কবির মর্ত্যজীবন প্রীতির দিক স্পষ্টরূপে উদ্ভাসিত, “হে সুন্দরী বসুন্ধরে, তোমা পানে চেয়ে কতবার প্রাণ মোর উঠিয়াছে গেয়ে প্রকাণ্ড উল্লাস ভরে।” শুধু তাই নয়, মাটির পৃথিবীতে লীন থাকার বাসনা কবি চিত্তে দুর্বার রূপে ব্যক্ত। “আমার পৃথিবী তুমি বহু বরষের। তোমার মৃত্তিকাসনে আমারে মিশায়ে লয়ে।” রাখার বাসনা পরিব্যপ্ত, বসুন্ধরা কতনা রূপে কবির কাছে প্রকাশিত। কখনও জননী, কখনও রূপসী প্রিয়া। কবি কখনও সমুদ্র মেঘশিত কটিদেশ বক্ষের নিবিড় বাঁধনে বেঁধে সুখ স্পর্শ অনুভূতির অভিপ্রায় অভিলাষ ব্যক্ত।

যেতে নাহি দিব ও মানবিক অনুভূতি ময়তার প্রগাঢ় দিক ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটিতে সমৃদ্ধ করেছে। মরণশীল বিশ্বের বুকে কবি এখানে মানবিক আবেদনে মৃত্যুঞ্জয়ী চেতনার গান শুনিয়েছেন। মানুষের স্নেহ প্রেম বিশ্ববোধ পৃথিবীর চিরন্তন এই বিধানকে অস্বীকার করে। চিরন্তন মানবানুভক্তির দিক জ্বরা-মৃত্যুর অধীন পৃথিবীতে কীভাবে জীবনের ট্র্যাজিক পরিণত আনে তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এখানে কবির কথায়—

ম্লান মুখ, অশ্রু আঁখি

দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে টুটিয়াছে গরব

তবু প্রেম কিছুতে না মানে পরাভব

তবু বিদ্রোহের ভারে রুদ্র কণ্ঠে গায়

যেতে নাহি দিব……।

পরশ পাথর : এই কবিতার মধ্যে কবিকে অমর্ত্য জগৎ ভাবনা থেকে মর্ত্য জগৎ ভাবনায় নেমে আসতে দেখা যায় পরশ পাথর খুঁজে বেড়িয়েছে ক্ষ্যাপা। বিরাম বিহীনভাবে চলেছে তার এ প্রয়াস। অভিপ্রেত প্রাপ্তি ঘটল একদিন। অজানা থেকে গেল তবু পরশ পাথর, পেয়েও পেল না সে। আসলে রবীন্দ্রনাথের মর্ত্যপ্রেম ভাবনার জন্যই দেখলো হল এ পরিণত, জীবন দিয়ে মণি অন্বেষণার সাধনায় সিদ্ধি আসেনি তার। “যে সৌন্দর্য অখণ্ড, অবিনশ্বর চিরন্তন, তার প্রকাশ আদর্শ আবেষ্টনের মধ্যে একটা অসাধারণত্বে বিছায় তোরণ পথে কোনো বহু আকাঙ্ক্ষিত শুভ্র অবসরে আত্মপ্রকাশ করবে না। পৃথিবীর শত শত সাধারণ সৌন্দর্যের অভিব্যক্তিতে সেই আকাঙ্ক্ষিত সৌন্দর্যের দর্শন মিলবে এটাই এর মূল বক্তব্য।

বৈষ্ণুবকবিতা : এখানে স্বর্গলোকের প্রসঙ্গ আছে, আছে মর্ত্যলোকের প্রসঙ্গ। বৈকুণ্ঠের গান এবং মানবানুভূতির বিচিত্র সাধনা এখানে মিলে মিশে একাকার। শেষ পর্যন্ত বৈকুণ্ঠের গানকে সুখ দুঃখ হাসিকান্নায় ভরা মানবিক সংগীতে পর্যবসিত করা হয়েছে। স্বর্গলোকের দেবতাকে এখানে ধূলিধূসর ধরণির মানুষের সামনে বসিয়ে কবি মর্ত্য মানবপ্রীতির রসকেই পরিস্ফুট করেছেন— আমাদের কুটির কাননে ফুটে পুষ্প, কেহ দেয় দেবতা চরণে/কেহ রাখে প্রিয়জন তরে তাঁর/নাহি অসন্তোষ ৷৷ আসলে এখানে মানবিক প্রেমেরই জয়গান গাওয়া হয়েছে। মানবীয় প্রেমের পথেই এখানে ভগবৎ প্রেমের তীর্থ পথে উপনীত হওয়ার প্রয়াস প্রত্যক্ষ দৃষ্ট।

মানস সুন্দরী : এ কবিতার মধ্যে নিসর্গপ্রীতি, বিশ্ব রহস্যময়তা এবং মানবপ্রীতির দিক সুন্দরভাবে সমন্বিত রূপের আধার হয়ে গড়ে উঠেছে, বিশ্ব সৌন্দর্যানুভূতির আলোকে কবির মর্ত্য-প্রীতির সুর এখানে ধ্বনিত, বিশ্বের খণ্ড খণ্ড সৌন্দর্যকে কবি এখানে একটি নারীমূর্তির আধারে প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছেন—সমালোচকের ভাষায়—“মানস সুন্দরী বিশ্বের সমস্ত প্রিয়ার প্রতীক—অপূর্ব সৌন্দর্যময়ী প্রণয়িনীর মূলরূপ।” পদ্মাতীরস্থ একখানি গ্রামের চিত্র এখানে মেলে। সূর্যাস্তের ছবি, বালিকা বধূর ঘরে ফেরার ছবি, জীর্ণ কুটিরে সন্ধ্যাদীপের জ্বালা নেভার ছবিতে কবির মর্ত্যপ্রীতির নজির মেলে।

তাই বলতে হয়, সুখ দুঃখ বিরহ মিলনে বিশ্ব পরিপূর্ণ। সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের কিছু কিছু কবিতায় তার ভাব নিহিত যেখানে কবির মানবাকাঙ্ক্ষায় কবি আত্মবিভোর চিত্ত। বাক্যটির বিশিষ্ট কয়েকটি দিকের মধ্যে কবি চিত্রের নিসর্গ প্রেমভাবনা এবং মর্ত্যমানব প্রীতি ধূলিধূসর ধরণির প্রতি প্রগাঢ় মমত্বের দিক বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। মর্ত্যমমত্ববোধ ও মানবপ্রীতি এই কাব্যে বেশ কিছু কবিতাকে পৌঁছে দিয়েছে উৎকর্ষতার চূড়ান্ত লক্ষ্যে।