‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থেই একটা অনির্বচনীয় সংশয়-বোধ ও আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব সুস্পষ্ট। কবি-হৃদয়ের এই যন্ত্রণাবোধ ও সংশয়ের সূচনা অবশ্য ‘মানসী’ পর্বেই। তবে এই সংশয় ও বেদনা ‘সোনার তরী’তে প্রবল হয়েছে সন্দেহ নেই। কবির ব্যক্তিজীবনের ইতিহাস এবং তাঁর কবি-জীবনের খ্যাতি-অখ্যাতির ঝড় তাঁর এই মানসগঠনের কারণ বলা যেতে পারে। ‘সোনার তরী’র নাম কবিতাটিতে তৎকালীন কবিমানসেরই কিছুটা ছায়াপাত ঘটেছে। কবির সাধনা একক সাধনা। তাঁর সৃষ্টিকর্মে তাঁর আনন্দ-বেদনার বিচিত্র অনুভূতি নিহিত হয়ে থাকে। একাকীত্বের বিচ্ছিন্ন দ্বীপে কবি বাস করেন এবং নিঃসঙ্গতার সকল দুঃখই তাঁকে বহন করতে হয়। কবির শিল্পীকর্ম কিন্তু ব্যক্তিগত নয়, তাঁর সমস্ত সৃষ্টি তিনি বিশ্বজনের উদ্দেশে নিবেদন করে দেন। বিশ্বজনের উপভোগেই কবির সার্থকতা—’একাকী গায়কের নহে তো গান’। ‘সোনার তরী’ কবিতাটির মধ্যে কবির বিচ্ছিন্ন জীবন ও সেই জীবনের কাব্যসাধনা, সাধনার সৃষ্টি সোনার ফসল এবং যাদের জন্য কাব্যসৃষ্টি—এই তিনটি প্রসঙ্গই আভাসিত হয়েছে। বিশ্ববাসী কবির সৃষ্টিকেই সমাদর করে, কবির ব্যক্তিজীবনের যন্ত্রণা ও বেদনা সম্পর্কে তারা উদাসীন। ‘সোনার তরী’র নাবিক সোনার ধান অর্থাৎ কাব্যসম্ভার নিঃশেষে নৌকায় তুলে নিয়ে গেছে। কবি ক্ষণিকের দুর্বলতায় সেই তরীতে নিজের জন্য একটু স্থান চেয়েছিলেন কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তিনি তাঁর একক অস্তিত্বের বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পড়ে থেকেছেন।

বিশ্ববাসীর দরবারে তাঁর কাব্যের সমাদর অবশ্যই কবির কাম্য এবং তিনি জানেন তাঁর সৃষ্টি ব্যর্থ হয়নি। বিশ্ববাসী সেই বেদনার ধনগুলো সমাদরেই গ্রহণ করেছেন। তাই সোনার ধানে তরী বোঝাই হয়ে যায় এবং কবির জীবনের মূল আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ হয়, প্রমাণ হয় কবির নিঃসঙ্গ জীবনের সাধনা বিফল হয়নি। সুতরাং এদিক থেকে নৈরাশ্যের প্রশ্ন ওঠে না। তবুও কবিতার শেষ কয়েকটি পঙ্ক্তিতে যে নৈরাশ্যের একটা সুর ধ্বনিত হয় তার কারণ ঐ দুর্বল মুহূর্তের প্রার্থনা ব্যর্থ হওয়ার বেদনা। এই বেদনার উৎস কবির নিজের কথাতেও জানা যায়। তিনি এক জায়গায় ব’লেছেন, “সংসার সমস্তই নেবে, একটি কণাও ফেলে দেবে না। কিন্তু যখন মানুষ বলে, ঐ সঙ্গে আমাকেও নাও, আমাকেও রাখ, তখন সংসার বলে, তোমার জন্যে জায়গা কোথায়?”

“প্রত্যেক মানুষ জীবনের কর্মের দ্বারা সংসারকে কিছু না কিছু দান করেছে, সংসার তার সমস্তই গ্রহণ করেছে, রক্ষা করেছে, কিছুই নষ্ট হতে দিচ্ছে না—কিন্তু মানুষ যখন সেই সঙ্গে অহংকেই চিরন্তন করে রাখতে চাচ্ছে তখন তার চেষ্টা বৃথা হচ্ছে।” বেদনা তবে এই অহংবুদ্ধির বশে চাওয়া অসঙ্গত প্রার্থনাটুকুর জন্য। এই বেদনা কবিতাটিকে গভীর নৈরাশ্যে আবৃত করেনি, কেবল নৈরাশ্যের একটা মৃদু সুরকে অনুরণিত করে তুলেছে। কবি জানেন, তাঁর কাব্যসাধনা এখনও শেষ হয়নি, একাকী দীর্ঘ সাধনায় আরও বিচিত্র কাব্যসম্ভার তাঁকে সৃষ্টি করে তুলতে হবে। এই উপলব্ধিটাই বড় হয়ে ওঠে।

‘সোনার তরী’ কবিতার মূল সুরে নৈরাশ্যবাদের প্রভাব নেই, আছে শিল্পীজীবনের সাধনা ও সিদ্ধি বিষয়ে ভাবনায় ব্যক্তিজীবনের দিক থেকে একটা বিচ্ছিন্নতার বেদনা বোধ। এই বেদনাটুকু কবিতায় অপূর্ব রসমূর্তি লাভ করেছে। কিন্তু একে নৈরাশ্য বলে স্বীকার করা যায় না। নৈরাশ্য বা দুঃখবাদ রবীন্দ্রকাব্যের মূল সুর কখনই নয়।