সৃষ্টি আর স্রষ্টা এদের মধ্যে কে বড়ো, কার দাম বেশি-কর্মের, না, কর্মীর—এই নিয়ে মানুষের ভাবনাচিন্তার আর শেষ নেই। মানুষ বলে আমিই প্রধান ; আমার কর্ম অপ্রধান কারণ, আমার কর্ম আমার অধীন। আমি না থাকলে কে কাজ করত? অর্থাৎ জগৎসংসার যদি আমার কর্মের ফল গ্রহণ করে তাহলে তাকে প্রথম গ্রহণ করতে হবে আমাকে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলেন, তা নয়। বিশ্বের লক্ষ কোটি কর্মবীরের আজীবন কর্মের সাধনার কত ফসলই না আমরা ভোগ করছি ; কিন্তু ক’জন কর্মবীরকে আমরা মনে রাখি ? তাছাড়া মানুষের কাজই তো কর্ম করা। মানুষ যদি দম্ভের ভরে নিজেকেই বড়ো করে দেখে তাহলে তার দস্ত চূর্ণ হতে বাধ্য। সংসার তার তরণীতে কর্মে ফসলগুলিই তুলে নেয়; মানুষকে প্রত্যাখ্যান করে। তাছাড়া মানুষ তার কর্মের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে বসে থাকতে পারে কি? না, পারে না। কারণ সে তার ‘সৃষ্টির চেয়ে মহৎ’। আর মহৎ বলেই সে নিতান্ত উদাসীনভাবেই বলে, ‘এক হাটে লও বোঝা, শূন্য করে দাও অন্য হাটে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর আজীবন সাধনার সোনার ফসল প্রায় অচেনা সোনার তরীর ওপর তুলে দিয়ে শূন্য নদীর তীরে একলা বসে রইলেন। প্রত্যেক মানুষই তো একা ও নিঃসঙ্গ। আমরা প্রতিটি মানুষই যে পৃথক। কাছের মানুষও আমাদের কাছ থেকে অনেক যোজন দূরে। কথাটা হয়তো সত্য ; কিন্তু আজীবন ধরে সাধনা করে আমরা যে ফসল সঞ্চয় করি তাকে অপরের হাতে তুলে দিতে সত্যিই কি আমাদের মন ব্যথাতুর হয় না? তবে, মহাকাল যে উদাসীন। তার স্রোতে সোনার ফসলই ভেসে যায়; মানুষ আটকে থাকে চড়ায়। মহাকাল তাই সোনার ফসল নিয়ে উধাও হয়ে যায়, পড়ে থাকা মানুষের আর্তিতে শূন্য নদীর চর মর্মরিত হয়ে ওঠে। তার করুণ আবেদনে সাড়া দেয় না কেউ। রবীন্দ্রনাথ অন্য এক জায়গায় তাই বলেছেন—‘…কাজ করিতে করিতে, ফসল জমা হইতে হইতে এমন দিন আসিয়া পড়ে যখন বুঝিতে পারি, এ ফসল আমি কোথাও লইয়া যাইতে পারিব না। এ সমস্তই আমাকে দিয়া যাইতে হইবে। কাহাকে দিয়া যাইব ? যাহাকে চিনি এবং চিনি না, যে আমাকে মুগ্ধ করিয়াছে, কিন্তু ধরা দেয় নাই। তাহাকে আমি বলি—’ওগো, তুমি আমার সব লও এবং আমাকেও লও । সে আমার সব লয়, কিন্তু আমাকে লয় না—। ‘সোনার তরী’ কবিতাটিতে সেই কথাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। আমার যা আছে সবই তুমি নাও, কিন্তু সেই সঙ্গে আমাকেও তুমি করুণা তরে তুলে নাও। কিন্তু সোনার তরণীতে অত স্থান নেই। কবিকে তাই সোনার তরীর মাঝিটি অর্থাৎ মহাকাল উদাসীনভাবেই প্রত্যাখ্যান করে গেল।