অথবা, ‘চাঁদের অমাবস্যা” উপন্যাসটি বস্তুত কেন্দ্রীয় চরিত্র আরেফের সদ্য জাগ্রত বিবেকের উজ্জীবিত চেতনার স্বাক্ষর।”- উক্তিটির যথার্থতা বিচার কর।
অথবা, “চাঁদের অমাবস্যা” উপন্যাসটি বাংলদেশের সমাজ পটভূমিতে ব্যক্তির সংকট, সংশয়, আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মজাগরণের আধুনিক জীবনভাষ্য।”-এ সম্পর্কে তােমার মতামত দাও।
উত্তরঃ ‘চাঁদের অমাবস্যা’ [১৯৬৪] সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর [১৯২২-১৯৭১] দ্বিতীয় উপন্যাস। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। অর্থাৎ ‘লালসালু’ উপন্যাসে প্রকাশের চৌদ্দ বছর পর। এই উপন্যাসটির ভূমিকায় জানা যায়, “এই উপন্যাসটির বেশিরভাগ ফ্রান্সের আল্পস পর্বত, অঞ্চলের পাইন-ফার, এলম গাছ পরিবেষ্টিত ইউরিয়াজু নামক ক্ষুদ্র একটি গ্রামে লেখা।” এ সময়ে তিনি যে শুধু বিদেশ অবস্থান করেছিলেন তা-ই নয়, ইউরােপীয় পরিবেশ অভিজ্ঞতা, রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি ও শিল্প-চিন্তা ইত্যাদির ক্ষেত্রে তার, মানস পরিবর্তন ঘটেছিল এবং দেশ-বিদেশের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি, দার্শনিক ও পণ্ডিতের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল। তার এই বিশ্বগ্রাহী চেতনা ও আধুনিক মননের ফসল- চাঁদের অমাবস্যা।
‘লালসালু’র পাশে ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাস হিসেবে পুরােপুরি নিরীক্ষাধর্মী। ‘লালসালু, সমাজমনস্ক উপন্যাস। এতে ব্যক্তি ও জনজীবনের চিত্র প্রচুর ও বিপুলভাবে আকীর্ণ। কিন্তু চাঁদের অমাবস্যা ভিন্নধর্মী উপদানে সমৃদ্ধ। এ উপন্যাসের যে কাহিনি তা জীবনের একটি সাধারণ বৃত্তান্ত বা চিত্র মাত্র নয়, এবং পরিস্থিতির অভিনবত্ব ব্যক্তিমানুষের চিত্তে মনােজাগতিক যে সংকট ও আলােড়ন সৃষ্টি করে তার জটিল বুননিকে ফুটিয়ে তােলাই এ উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লক্ষ্য।
অতি সংক্ষিপ্ত কাহিনিসূত্র এ উপন্যাসের- কোপন নদীর তীরবর্তী চাঁদপাড়া গ্রামের জনৈক যুবক শিক্ষিত আরেফ আলী শীতের এক উজ্জ্বল জ্যোৎস্না রাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল প্রকৃতির প্রয়ােজনে। প্রয়ােজন মিটিয়ে ঘরে ফিরে না গিয়ে সে চন্দ্রালােকিত রজনীর রূপরাশিতে মােহাবিষ্ট হয়। হঠাৎ ছায়া শরীরের আকর্ষণে সে গ্রামের পথে বেরিয়ে পড়ে। বাঁশঝাড়ে নিহত এক রমণীর লাশ দেখে সে ঘটনাটি আরেফ, আলীর মনােলােকে আলােড়ন তােলে। প্রকৃত ব্যাপরটি ছিল আরেফ আলী গ্রামের যে বড়বাড়িতে আশ্রিত গৃহশিক্ষক সেই বড়বাড়িরই অন্যতম কর্তাপুরুষ কাদের আলী নিম্ন শ্রেণির এক রমণীকে সম্ভোগের উদ্দেশ্যে বাঁশঝাড়ে যায়; আরেফ সেই কাদেরকেই অনুসরণ করেছিল। আরেফের পদশব্দে ভয় পেয়ে কাদের রমণীটিকে গলাটিপে হত্য করে। পরদিন কাদের লাশ সরিয়ে ফেলার প্রস্তাব দিলে স্বপ্নের ঘােরে আরেফ আলী তার সঙ্গী হয়। অন্ধকারের দেয়াল বাস্তব জগতের সঙ্গে তার সংযােগ ছিন্ন করে ফেলে। কিন্তু আবার কাদেরের অর্থহীন একটি কথায় সে বুঝতে পারে, অবাস্তব জগতে প্রবেশ করেও বাস্তব জগতের সঙ্গে তার সম্বন্ধ একেবারে ছিন্ন হয়নি। তার মনে হয়, “অবাস্তব জগৎ নেহাৎ স্বাভাবিক। তাতে কিছু অসাধারণত্ব নাই। দুটি যেন একই মুদ্রার এপাশ ওপাশ।” সম্ভবত, লেখক এখানে এটাই দেখাতে চান যে, আচ্ছন্ন অবস্থায় দেখা জগতের একরকম রূপ আর আচ্ছন্নতার ঘোের কেটে যাওয়া অবস্থায় দেখা জগতের রূপ আরেক রকম। এই দুই জগতের মাঝখানে আরেফ আলীর বিচরণ। তার মনের দ্বন্দ্ব এই দুই জগতকে নিয়ে তার কাছে এই দুই জগতের অস্তিত্বই সমান সত্য। লেখক আরাে দেখিয়েছেন যে, যাকে আরেফ আলী অবাস্তবতার জগৎ বলে মনে করেছে তার অবস্থান প্রত্যক্ষ বাস্তবতার বাইরে নয়, তবে সেটার অবস্থান তার মনের ভেতর। লক্ষণীয় যে, এই অবাস্তব জগৎ যেমন আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, তেমনি অতিপ্রাকৃত বা অশরীরী আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত জগৎও নয়। তা আসলে বাস্তবতারই আরেক পিঠ। উপন্যাসের সিংহভাগ ব্যয়িত হয়েছে আরেফ আলীর মনে উক্ত ঘটনার প্রতিক্রিয়া বর্ণনায়। শেষ পর্যন্তই ঘটনাটি সে প্রথমে দাদাসাহেবকে এবং পরে পুলিশকে জানায়। পুলিশ জেনে শুনেই কাদেরের বদলে তাকে খুনী সাব্যস্ত করে।
‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসের কাহিনির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি যুবতী নারীর মৃত্যু এবং জ্যোৎস্না-প্লবিত রাতে, বাঁশঝাড়ের ভেতরে তার মৃতদেহ আবিষ্কার। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সফল ঔপন্যাসিকের শক্তিশালী লেখনী দিয়ে এই ঘটনাকে উপস্থাপিত করেছেন, আরেফ আলীর জীবন-ভাষ্য রচনায়। তার চরিত্রের মানস পরিক্রমা ও বিশ্লেষণের ধারাতেই অগ্রসর হয়েছে উপন্যাসের কাহিনি। তার সূত্রপাত হয়েছে তখনই যখন সে আকস্মিকভাবে একটি অভাবিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। জ্যেৎত্ন-প্লবিত রাত্রে বাঁশঝাড়ের মধ্যে যুবতী নারীর মৃতদেহ দর্শন তার নিরাবেগ জীবনপ্রবাহের আকস্মিক ছন্দপতন ঘটায়। আরেফ আলী ঘটনাকেন্দ্রিক জটিতায় আক্রান্ত হয় এবং তাকে অতিক্রম করতে গিয়ে তার অন্তরে দ্বন্দ্বময় আবেগের সূচনা হয়। শুরু হয় তার আত্ম-দ্বন্দ্ব ও আত্মজিজ্ঞাসা। মূল ঘটনাকেন্দ্রিক সেই আত্মসমীক্ষাকেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আধুনিক কথাশিল্পীর দক্ষতা সহকারে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটি বস্তুত কেন্দ্রীয় চরিত্র আরেফের সদ্য জাগ্রত বিবেকের উজ্জীবিত চেতনার স্বাক্ষর। এই জীবনচেতনার রূপায়ণে ওয়ালীউল্লাহ আমাদের উপন্যাসের ঐতিহ্যগত কাঠামােতে ঘা দিয়েছেন এবং সাহসী শিল্পীর সৃজনশীলতা নিয়ে এ উপন্যাসে ঐতিহ্য এবং উদ্ভাবনকে সমন্বিত করেছেন।
উপন্যাসটির শুরুতেই কেন্দ্রীয় চরিত্র আরেফের জীবনের মহা ঘটনাটি ঘটে গেছে। এক চন্দ্রলােকিত রজনীতে আরেফ আলী বেরিয়েছিল ঘর ছেড়ে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে অভিভূত ও কৌতূহলী আরেফ আলী জীবনে প্রথম বারের মতাে এক আশ্চর্য বিস্ময়ের সম্মুখীন হয়। বাঁশঝাড়ে নির্জন রাতে নিঃসঙ্গ নির্মম হত্যাকাণ্ড আর প্রবঞ্চক হত্যাকারীকে দেখে তার আপাত শান্ত জীবন চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। এ থেকে শুরু হয় তার মানস পরিব্রাজনা। বহু দ্বিধা দ্বন্দ্ব ও তরঙ্গ সংক্ষুব্ধ মানস পরিক্রমাকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রচলিত ছক বাধা কাহিনিতে ফুটিয়ে তােলেননি। বরং পাশ্চাত্য দর্শন ও সাহিত্য রীতিকে | তিনি এ ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন।
‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসে কোপন নদীর ধারের ক্ষুদ্র চাঁদপরা গ্রামের জনৈক অর্ধ শিক্ষিত যুবক শিক্ষক আরেফের বিবেক চেতনার কাহিনি লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বক্তব্য ও প্রকরণের দিকে থেকে সর্বজনীন বিশ্ব প্রসারিত ও নিরীক্ষাশীল। তবু বিষয় আবহ নির্মাণে তিনি একান্তভাবে বাংলাদেশের জনজীবন মূল সম্পৃক্ত। তাই এ উপন্যাসটি বাংলদেশের সমাজ পটভূমিতে ব্যক্তির সংকট, সংশয়, আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মজাগরণের আধুনিক জীবনভাষ্য।
পুরাে উপন্যাসে আরেফ আলীর মনের দ্বন্দ্বটি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। দ্বন্দ্ব বাস্তব অবাস্তবের দ্বন্দ্ব- তা উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত তা অব্যাহত থেকেছে। মৃতদেহটি দেখবার এবং সেটিকে লুকিয়ে ফেলার ঘটনাটি এক সময় তার কাছে মনে হয়েছে পুরােপুরি দুঃস্বপ্ন মাত্র। তা বাস্তব জগতে যেন ঘটেনি। কিন্তু ঘটনাটি যে বাস্তব তাকে তা গ্রাহ্য করতে হয়। কারণ, “ঘরের কোণে দড়িতে লুঙ্গি ঝােলে। তার কোণটা একটু ছেড়া। গতকাল লুঙ্গিটি সে ধুয়েছে। কিন্তু ছেড়া অংশটি সেলাই করবার সময় পায় নাই। দ্বিতীয় রাতে বাঁশঝাড়ে অপেক্ষাকৃত নতুন লুঙ্গিটির সে দশা ঘটে।
সুতরাং আরেফ আলী নতুন দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়। হত্যাকারী কে? এ উত্তর খুঁজতে গিয়ে সে একবার ভাবে, হত্যাকারী কাদের; আবার পরক্ষণেই মন অন্য যুক্তি খাড়া করে কাদেরকে আড়াল করতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বের সমাধান হয় তখন, যখন কাদের জানিয়ে যায় যে, সেই হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। কিন্তু আরেফ আলী তখন আর একটি নতুন প্রশ্নের মুখােমুখি হয়। এটি হত্যাকাণ্ড, না নিছক দুর্ঘটনা? সে ভেবে নেয়, মেয়েটির সঙ্গে কাদেরের হৃদয়ের সম্পর্ক ছিল। হঠাৎ ভয় পেয়ে সে এ ঘটনা ঘটিয়ে বসেছে। তাই আরেফ মনে মনে কামনা করে, কাদের বলুক যে মেয়েটির সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু কাদের তাকে হতাশ করে এবং আরেফের একধরনের কল্পনার জন্য ক্রোধ প্রকাশ করে। ফলে বাস্তবতা ও অবাস্তবতার দ্বন্দ্বের মাঝখানে কাদেরের ঘাতক-চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবু আরেফের প্রশ্ন শেষ হয় না। এবার তার মনে আত্মজিজ্ঞাসা জাগে। কেন সে নিজে কাদেরকে হত্যার দায় থেকে আড়াল করতে চেষ্টা করছে? কেন হত্যাকে দুর্ঘটনা এবং কাদেরকে প্রেমিক-পুরুষ হিসেবে ভাবতে চেয়েছে? সে শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করে, তার মন সুন্দরকে ভালােবাসে, সেই মনটি ভয়বহ হত্যাকাণ্ডে শঙ্কিত ও বিপর্যস্ত হয়েছে। এরপরই সে ভয় পেয়েছে কাদেরকে। কারণ, সে আশ্রিত, সে দুর্বল, সে মেরুদণ্ডহীন।
নিজের সীমাবদ্ধতা আবিষ্কার করার পর থেকেই তার মধ্যে এবার আত্মসচেতনতা জাগতে থাকে। কর্তব্যবােধের পীড়নে সে পীড়িত হতে থাকে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের কঠোর বাস্তবতাকে প্রকাশ করে দেওয়ার মতাে মনােবল সে পায় না। তাই ঈশ্বরের শরণাগত হয়। একাগ্রচিত্তে নামাজ পড়ে। কিন্তু যথেষ্ট শক্তি পায় না। বরং সেই সময় কাদেরের উপস্থিতিতে তার দৃষ্টির সামনে সে আরাে দুর্বল হয়ে পড়ে। মেয়েটির সম্পর্কে যে মিথ্যা ও অলৌকিক গল্প হতে থাকে সেটি সে লক্ষ করে। বিবেকের দংশনে পীড়িত হয়ে সে আত্ম-প্রবঞ্চনা কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট হয়। সে বুঝতে পারে, সকলেই সামাজিকতা ও আত্মরক্ষার খাতিরে প্রচণ্ড ও ভয়াবহ সত্যটিকে গােপন করতে চায়। উপন্যাসের ভাষায়-
“আসলে তারা মৃত, তাদের জীবনও ধার করা জীবন। জীবনের ব্যাপারে তারা এত প্রতারক বলেই তাদের মনে এত ভীতি, সত্য ঘটনাটি লুকাবার জন্যে এত অধীরতা, এত শঠতা।”
আরেফ আলী এক সময় সমস্ত সংশয় কাটিয়ে ওঠে। সে ভাবে, যুবতী নারীর সঙ্গে কাদেরের নিন্দনীয় সম্পর্কে ও তার দ্বারা কৃত অত্যন্ত গুরুতর অপরাধের ঘটনা প্রকাশ না করে সে চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। তাই শেষ পর্যন্ত সে সত্য প্রকাশ করে দেয়। এখানেই আরেফ আলী পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে অস্তিত্বময় হয়ে ওঠে। আপষ, ভয়, দ্বিধা- কোনাে কিছুই আর তাকে কাবু করতে পারে না। সে দায়িত্ববান, কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে নিজেকে দাঁড় করায়। ফলে ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওযার কাহিনি হয়ে ওঠে। সৌন্দর্যপ্রিয়, কোমল-হৃদয়, ভীতু-স্বভাব, লাজুক ও দুর্বলচিত্র একটি তরুণ কীভাবে স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হলাে এবং নিজ ব্যক্তিসত্তা নিয়ে জগতের মুখােমুখি দাঁড়াল আরেফ আলীর চরিত্রে সেই জীবন-সত্যই রচিত হয়েছে। এভাবেই ‘চাঁদের অমাবস্যা’ অস্তিত্ববাদী উপন্যাস হয়ে উঠেছে।
অস্তিত্ববাদের মূল কথা হচ্ছে যা সত্য বলে ব্যক্তির চৈতন্য উপলদ্ধি করে তার দায় অবশ্যই ব্যক্তিকে বহন করতে হবে। আরেফ আলী নিশ্চিত আরামের চাকরি, স্বচ্ছন্দ আশ্রয় এবং জীবনের নিশ্চয়তা সব কিছু পরিত্যাগ করে সত্য প্রকাশের জন্য পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছে। সে আগেই ভেবে রেখেছিল, হয়তাে তার কথা কেউই বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করলেও গ্রহণ করবে না, কিংবা সে চক্রান্তের স্বীকার হতে পারে, এমনকি তার ফাসি পর্যন্ত হতে পারে। তবু সে দায়িত্ব নিয়েই আসল সত্য প্রকাশ করেছে। এভাবেই অস্তিত্ববাদের মূল দিকটি এ উপন্যাসের ঘটনা বিন্যাসের মাধ্যমে পরিস্ফুট হয়েছে।
উল্লেখ্য ‘চাঁদের অমাবস্যা’ রচনাকালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্যারিসে বাস করছিলেন। ফলে, সেখানকার সমকালীন শিল্প-সাহিত্যের আন্দোলন এবং আবহভূমির দর্শন সম্পর্কে বিশেষভাবে পরিচিত হওয়ার সুযােগ তার ঘটেছিল। এ সময়ে ফরাসি শিল্প সাহিত্যের অঙ্গন আধুনিক ইমপ্রেশনিজম, সুররিয়ালিজম, একজিসটেন সিয়ালিজমের সংঘাত-সংঘর্ষে ছিল তরঙ্গিত; কাম্যু (১৯১৩-৬০), কাফফা, (১৮৮৩-১৯২৪), সার্ত্র (১৯০৫-৮০) ও বেকটের সৃষ্টি-বৈচিত্র্যে উজ্জ্বল। কাজেই এসব সৃষ্টি-বৈচিত্র ও শিল্প আন্দোলনের ছাপ ওয়ালীউল্লাহর রচনায় স্বাভাবিকভাবেই পড়েছিল।
ওয়ালীউল্লাহর ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসে সাত্রীয় অস্তিত্ববাদের প্রভাব পড়েছে। সাত্রীয় অস্তিত্ববাদ অনুযায়ী মানুষের নিয়তি ঈশ্বর বা সমাজ কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত নয়। তারও স্বাধীন ইচ্ছার অধিকার রয়েছে এবং সে ইচ্ছার সঙ্গে রয়েছে এক গভীর দায়িত্ববােধ। সাত্রের অস্তিত্ববাদের আলােকে দেখলে দেখা যায়, আরেফ আলী মুখােশধারী সমাজের বাসিন্দা এবং পরান্নভােগী ও পরাশ্রয়ী হয়েও স্বাধীন ইচ্ছার পথে পা বাড়িয়েছে। বাঁশঝাড়ে নির্মম ঘটনার সাক্ষী হয়ে সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে এক গভীর দায়িত্ব।
বাইরের শক্তির কাছে সে নতি স্বীকার করেনি। নিজের নিশ্চিত আশ্রয় নষ্ট হবে জেনেও নিজের সিদ্ধান্তে সে অটল থেকেছে। সাত্রের মতাে সৈও বিশ্বাস করে- “কর্ম-বৃত্তিতেই মুক্তি-স্ব-দায়িত্ব কর্ম-বৃত্তিতে।” এ ভাবে আরেফ আলী, সাক্ৰয় কম-বৃত্তিতেই অস্তিত্বময় হয়ে ওঠে।
Leave a comment