সামরিক বাহিনী সম্পর্কে সাবেকী ধারণা:
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেকী আলোচনায় সৈন্যবাহিনী সম্পর্কিত বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্তি অভাবিত। কোন দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থায়ও সাধারণত সৈন্যবাহিনী সম্পর্কে কোন আলোচনা থাকে না। তবে এর কোন ব্যতিক্রম নেই এমন নয়। গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনের শাসনব্যবস্থায় সামরিক বাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনী সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা আছে। যাই হোক সাবেকী ধারণা অনুসারে সামরিক বাহিনীর বিষয় রাজনীতিক বিচার-বিশ্লেষণের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে প্রচলিত ধারণা হল যে সৈন্যবাহিনী হল রাজনীতি-নিরপেক্ষ একটি সংগঠন। এই সংগঠন কোনোভাবেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। সামরিক বাহিনী অসামরিক সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীনে সংগঠিত ও পরিচালিত হয়। সামরিক বাহিনীর একমাত্র উদ্দেশ্য হল দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত দায়িত্ব সম্পাদন করা এবং বিশেষ প্রয়োজনে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পুলিশ বাহিনীকে সাহায্য করা। অর্থাৎ দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ধারণা অনুসারে দেশের সমকালীন রাজনীতির সঙ্গে সামরিক বাহিনীর কোন রকম সম্পর্ক থাকে না।
সামরিক বাহিনী সম্পর্কে আধুনিক অভিজ্ঞতা:
সামরিক বাহিনী সম্পর্কিত উপরিউক্ত সাবেকী ধারণা সাম্প্রতিককালে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হয় না। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায়। সামরিক বাহিনী রাজনীতি-নিরপেক্ষ, এই চিরাচরিত ধারণা আধুনিককালের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হয়। বর্তমানে অনেক দেশেই অসামরিক সরকারের অস্তিত্ব সংশ্লিষ্ট দেশের সৈন্যবাহিনীর সক্রিয় সমর্থনের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। অনেক দেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী এখন প্রত্যক্ষভাবে অথবা পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করে বা প্রভাব কায়েম করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে এবং জাপান ও স্পেনে এ রকম ঘটনা ঘটেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে অবস্থার অভাবিত পরিবর্তন ঘটে। এশিয়া ও আফ্রিকার সদ্য স্বাধীন বিভিন্ন দেশে ও লাতিন আমেরিকার অনেক অঞ্চলে সামরিক বাহিনী রাজনীতিক ক্ষমতা দখল করেছে এবং অসামরিক সরকার অপসারিত হয়েছে। এ বিষয়ে ফাইনার তাঁর Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে এবং পাই তাঁর Aspects of Political Development শীর্ষক গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তা ছাড়া Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে অ্যালান বলের আলোচনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন: “The lengthy list of successful and unsuccessful direct intervention by the military… since 1945 creates the impression that seizure of political control by the armed forces, or the military ensuring the replacement of one civilian government by another, is the norm rather than the exception in modern political systems.” The Politics of the Developing Nations শীর্ষক গ্রন্থে Fred R. von der Mehden-এর অভিমত অনুসরণ করে বল আরও বলেছেন: “Of the states that have achieved independence since World War II, it has been estimated that one-third of these seventy-five states have experienced a successful military coup.” ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সামরিক বাহিনীর সফল হস্তক্ষেপ সংঘটিত হয়েছে লাতিন আমেরিকাতে। হগ্ টমাসের The Spanish Civil War গ্রন্থ থেকে বল দেখিয়েছেন যে, ১৯১৪ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে স্পেনে সফল-অসফল মিলিয়ে সামরিক অভ্যুত্থান ৪৩ বার সংঘটিত হয়েছে। এবং এখানে প্রাইমো ডি রিভেরা (Primo de Rivera) -র নেতৃত্বে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘকাল সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল।
রাজনীতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক জটিল:
অ্যালান বলের অভিমত অনুসারে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে রাজনীতিক প্রক্রিয়ার সম্পর্কের বিষয়টি অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির। শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের পরিপ্রেক্ষিতে পর্যালোচনা করলে রাজনীতিক ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা ও প্রভাব সম্যকভাবে অনুধাবন করা যাবে না। তবে রাজনীতিক প্রক্রিয়ায় সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ থেকে অনেক সময় একটি বিষয় স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়। বিষয়টি হল এই যে, অন্যান্য উপায়ে রাজনীতিক উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী ব্যর্থ হলে একমাত্র বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে সামরিক অভ্যুত্থানের সামিল হয়। তা ছাড়া সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি থেকে অসামরিক সরকারের দুর্বল প্রকৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “The political influence of the military stretches from direct assumption of complete political control to the complete subservience of the military to other political structures. There are intermediate stages between these two extremes…” অনেক সময় সামরিক বাহিনী একটি অসামরিক সরকারকে অপসারিত করে অন্য একটি অসামরিক সরকারকে প্রতিষ্ঠিত করে। কখনও বা সামরিক বাহিনী বিদ্যমান অসামরিক সরকারের প্রধান রাজনীতিক সমর্থক হিসাবে ভূমিকা পালন করে। আবার অনেক সময় বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে সামরিক বাহিনী অন্যতম চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসাবে ভূমিকা পালন করে।
সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয় যে বর্তমানে সামরিক বাহিনীর ভূমিকাকে রাজনীতি-নিরপেক্ষ বলা যায় না। এ ব্যাপারে সাবেকী ধারণা এখন অচল। সামরিক বাহিনী এখন অনেক ক্ষেত্রেই তার ভূমিকার চিরাচরিত পরিধিকে অতিক্রম করে রাজনীতিক প্রক্রিয়ার পরিধিতে প্রবেশ করেছে। কোথাও কোথাও রাজনীতিক জীবনের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক অত্যন্ত ওতপ্রোত। অসামরিক সরকারের কাজকর্মে হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার করা ছাড়াও সামরিক বাহিনী সামগ্রিকভাবে সরকারী ক্ষমতা দখল করার ব্যাপারে প্রত্যক্ষভাবে উদ্যোগী হয়। এই সমস্ত কারণের জন্য আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সামরিক বাহিনীর আলোচনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হয়।
Leave a comment