উত্তরঃ বাংলাদেশের প্রধান কথাসাহিত্যিকদের অন্যতম সেলিনা হােসেন [জন্ম. ১৯৪৭]। তার সাহিত্যের বিষয় হিসাবে উঠে এসেছে বহমানকাল, রাষ্ট্র ও মানবজগৎ। তার উপন্যাসে রাজনৈতিক সময় বা আন্দোলন অধিকতর পরিপ্রেক্ষিত অর্জন করে। বাঙালির অহঙ্কার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তার লেখায় নতুন মাত্রা অর্জন করে। নারীর শাশ্বত দৃষ্টি, সনাতন আদর্শ বজায় থাকে তার লেখায়। এক্ষেত্রে তিনি স্বদেশ ও স্বজাতির ঐতিহ্যের প্রতি দৃঢ় এবং দায়িত্বশীল। এমন প্রত্যয়ে গৌরবােজ্জ্বল পর্বগুলাে উন্মােচিত হয় কাহিনিগাত্রে; জাতীয় চরিত্র প্রতীকায়িত হয় আদর্শের আশ্রয় থেকে। এভাবে তার রচনাসম্ভার হয়ে উঠেছে অনবদ্য এবং অভিনব।
নামকরণের প্রাথমিক কথাঃ নামের মধ্য দিয়েই কোনকিছুর সাথে আমাদের প্রাথমিক পরিচয় ঘটে। শিরােনাম হলাে শনাক্তকারী প্রতীক। নামের মাধ্যমে ব্যক্তি বস্তু শিল্পকর্ম বা যেকোনাে বিষয়ের মৌল বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণও আর্টের অন্তর্ভুক্ত। উৎকৃষ্ট নামকরণ আয়নার মতাে শিল্পের মূল উপজীব্য প্রতিফলিত করে। এ কারণেই সার্থক সাহিত্যকর্মের অন্যতম শর্ত অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ নামকরণ। কবি সাহিত্যিকগণ মূলভাব, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, কেন্দ্রীয় চরিত্র, রূপক বা প্রতীকধর্মিতা, তার জীবনদৃষ্টি প্রভৃতির আলােকে সাহিত্যকর্মের নামকরণ করেন।
গৌরবােজ্জ্বল পটভূমিতে রচিত সেলিনা হােসেনের ‘কাটাতারে প্রজাপতি’ (১৯৮৯) উপন্যাসে উঠে এসেছে তেভাগা আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি এবং সাঁওতাল, কৃষক সম্প্রদায়ের স্বপ্নসৌধ রচিত হতে দেখা যায় কাঁটাতারের প্রজাপতির প্রতীকে।
এ উপন্যাসের কাহিনি নির্মাণ লেখিকার জন্য ছিল একটি বড়াে ধরনের চ্যালেঞ্জ। কারণ জীবনভিত্তিক উপন্যাসে লেখকের কল্পনাকে হতে হয় বাস্তবের অনুবর্তী, তাতে বাস্তবকে ছাপিয়ে ওঠা চলে না। ইলা মিত্র নিকট ইতিহাসের চরিত্র। তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে তার ঐতিহাসিক ভূমিকাকে শাণিত শিল্পরূপ দেওয়া হয়েছে এই উপন্যাসে। ইতিহাসের কোনাে বিশেষ সময় ও বিশেষ ঘটনার শৈল্পিক রূপায়ণ কীভাবে করা যায় এবং মানুষের স্বপ্ন-সাধ কীভাবে কাঁটাতারের প্রতীকে বিনষ্ট হয় তার বিশিষ্ট আলেখ্য এই উপন্যাস। কাঁটাতারে প্রজাপতি’ উপন্যাসটি লেখার মুখ্য উদ্দেশ্য কী ছিল তা সেলিনা হােসেন তার প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘নির্ভয় কর হে’ বর্ণনা করেছেন-
“নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে ইলা মিত্রকে নিয়ে আমি যে উপন্যাসটি লিখি তার নাম ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’। আমি চেয়েছিলাম আমাদের ছেলে-মেয়েরা গল্পের ভেতর দিয়ে জানুক নিকট অতীতকে। আবিষ্কার করুক সেইসব মানুষকে যারা জীবন দিয়ে ইতিহাসের সড়ক তৈরি করেন।”
উপন্যাস শুরু হয় যুবক আমজলকে দিয়েই, তার মামাতাে ভাই এবং বন্ধু আজিজ তেভাগার সক্রিয় কর্মী, আজিজের বাবাও জোতদার, কিন্তু আজিজ বাবার বিরুদ্ধেই বলে। আজমলের অত সাহস নেই। সে গােলহাটের বড় রেশম ব্যবসায়ী ইয়াসিন বসনির প্রথম পক্ষের ছেলে। জমিরুদ্দিনের বিধবা বউ এন্ডির সুতাের ব্যবসায়িনী আছিয়ার সঙ্গেও রয়েছে তার অবৈধ সম্পর্ক। তবু নিজের দাপট ষোল আনা বজায় রেখেই নিজের মেয়ে জোহরার সঙ্গে তার প্রেমিক কুতুবের বিয়ে দেননি। কারণ তার মতে পুরুষের রােজগারই একমাত্র পরিচয়। সম্ভব হলে একটা কেন, একশটা মেয়ে মানুষ সে পালন করতে পারে, সুতরাং বাপের এই মানসিকতার জন্যই আজমল ইয়াসিনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছে। তার প্রজাপতির মন যেন সেই পরিবেশ থেকে অন্য কোথাও উড়ে যেতে চায়-
“যেটা কখনাে শক্ত এবং কালাে হয় মরে যায়, কখনাে সজীব প্রজাপতি হয়। পাকা পলুগুলাে গুটির ভেতর প্রজাপতির আকার ধারণ করে। সময়মতাে গুটির ভেতরের পােকাগুলােকে মেরে না ফেললে ওগুলাে গুটি কেটে উড়ে যায়। যেমন উড়ে যায় মানুষের প্রজাপতি মন। কারাে কি ধরে রাখার সাধ্য আছে? উড়ে যায় বলেই তাে এত দুঃখ-যন্ত্রণা, এত সুখ-আনন্দ।”
আজমলের প্রজাপতি মনের কারণে সে নাচোলে এসে উপস্থিত হয়। নাচোল এসেই আজিজের মুখে শুনতে পায় রমেন মিত্র বিয়ে করেছেন। বউ এর নাম হলাে ইলা সেন, বেথুন কলেজের স্নাতক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশােনা করেছেন এবং খেলাধুলায়ও দারুণ। আজিজ গুণের ফিরিস্তি দিয়ে থামল বটে আজমলের মাথায় চাপল ইলা মিত্র কে? মেয়েদের মধ্যে এত গুণ হয়?
রমেন মিত্রের বউ হয়ে আসার পথে-লঞ্চঘাটে ইলা মিত্র দেখতে পায় অপেক্ষারত কৌতূহলী মানুষের মুখ; কিন্তু সে ঘোমটার আড়ালে বসে চিন্তা করছেন ভবিষ্যৎ জীবনের- তার প্রজাপতির মন সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করার প্রেরণায় রঙিন হয়ে ওঠে। মেয়েদের জন্য এলাকার নির্মাণ করেন বালিকা বিদ্যালয়। প্রথমে যদিও তিনটি ছাত্রী কিন্তু পরে তা পঞ্চাশ জনে দাঁড়াল। জোতদাররা ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে মিলে শরিয়তি আইন ভেঙে যাবার দোহাই দিতে লাগল। কিন্তু এক্ষেত্রে ইলা একা থাকলেন না, বরং যারা এতদিন মুখবুজে মেনে এসেছে, তারাই প্রতিবাদ করতে লাগল। গ্রামের ওয়াজেদ মােড়লের তীক্ষ্ণ যুক্তিতে প্রতিপক্ষ জব্দ হয়ে গেল। তার মতে- “মেয়েদের শিক্ষায় শরিয়ত বেপর্দা হলাে বলে যারা চেঁচাচ্ছে তারা যখন সুদ খায় তখন কেন শরিয়তু বেপর্দা হয় না?” কিন্তু শুধু মেয়েদের স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার কাজ নিয়েই বসে থাকলেন না ইলা বরং স্বামীর সঙ্গে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়লেন তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে। ইলা মিত্রকে সাঁওতাল থেকে শুরু করে বাঙালি কৃষক সকলেই পরম সমাদরে গ্রহণ করে নিয়ে তাদের ভালােবাসার, শ্রদ্ধার রানিমা’তে রূপান্তরিত করে নিল। জোতদারেরা যারা তেভাগা মানেনি ইলা মিত্রের নির্দেশে তাদের খােলান থেকে ধান তুলে নিয়ে আসা হলাে। ক্রমে ক্রমে এ আন্দোলন বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। লেখকের ভাষায়-
“কমিশনের রিপাের্ট অনুসারে ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ পাবার জন্য আন্দোলন শুরু করা হবে। ঐ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অল্পদিনের মধ্যেই বিভিন্ন জেলায় তেভাগা আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। জলপাইগুঁড়ি, রংপুর, দিনাজপুর, যশাের, খুলনা এবং আরাে অনেক জায়গায় তেভাগা আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছে। সেখানে আমাদের সগ্রামী ভাইয়েরা মরণপণ লড়াই করছে।”
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পরে কেউ কেউ মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল- কিন্তু অল্পদিনে তারা বুঝে নেয় ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে মাত্র; সাধারণ যেকের ভাগ্য এতে কোনাে পরিবর্তন হবে না। উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলন ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে, কৃষকরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে, দিনাজপুরে নারায়ণ জোতদারদের সঙ্গে সংঘর্ষে শহিদ হয়। এরপর রামচন্দ্রপর হাটে এক বড় জনসভায় মে দিবস পালিত হয়।
জনসমাবেশ দেখে ঘাবড়ে যায় স্থানীয় জোতদার, ইজারাদার, মহাজনরা কোণঠাসা হয়ে আছে। আন্দোলনকারীরা টের পেল মুসলিম লীগ এ আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক মােড় দেবার চেষ্টা করছে। হয়ত যখন তখন মুসলিম লীগ উচ্চারিত জাতীয় দলাল তেভাগার নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করতে পারে পাকিস্তানি পুলিশ, সকলকেই তাই আত্মগােপন করতে হলো। জােতদার, রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশ মিলে এ আন্দোলনের চিড় ধরাতে চাইলেও আজ কষকরা রানিমাকে ছেড়ে ভুল করতে রাজি নয়। উনিশ শ’পঞ্চাশের জানুয়ারির পাঁচ তারিখে ঝলমলে সকালে চকচকে কাস্তে হাতে হাজার কষক নেমে পড়ে মাঠে। তবে জোতদারবর্গ পুলিশকে জানিয়েছে, আজ তাদের ধান চোরেরা লুট করবে। বিশাল জনতার মিছিল আর তেভাগার সমর্থনে শ্লোগানে হকচকিয়ে যায় পুলিশ বাহিনী। তবুও গুলি খেয়ে এক কৃষকের মৃত্যু হলেই জনতা পলিশকে আক্রমণ করে এবং খুন করে কবর দেয় মাটিতে। ঘটনাটির পর দ্রুত যেন সবকিছু ঘটতে থাকে। তিন পুলিশের পর পর সাধারণ চাষিদের উপর পাকিস্তানি পুলিশ শুরু করে নারকীয় অত্যাচার। যুবতী মেয়েদের ধর্ষণ করা থেকে শুরু তার বাড়ি ঘরের মধ্যে আগুন সংযােগ, নাবালক শিশু থেকে দুধের গাই এমনকি বৃদ্ধ, বৃদ্ধারা জীবন্ত অবস্থায় পুড়ে মারা যায়। লেখকের ভাষায়-
“দাউদাউ পুড়ে যাচ্ছে গ্রাম। ঘাসুরা, চণ্ডিপুর, কেন্দুয়া, জগদল, ধরল, শ্যামপুর, নাপিতপাড়া সর্বত্র আগুনের লেলিহান শিখা- কালাে ধোঁয়া বিস্তৃত হচ্ছে এক গ্রামের সীমানা পেরিয়ে অন্য গ্রামে- নদীতীর এবং তার ওপার । গুলির মুখে লুটিয়ে পড়ছে মানুষ।”
কিন্তু পুলিশ ইলা মিত্রকে কোথাও খুঁজে পায় না। পরিষ্কার সাঁওতাল ভাষা বলতে পারা ইলা মিত্র সীমান্ত পেরিয়ে যাবার জন্য সাঁওতাল মেয়ের ছদ্মবেশই ধারণ করলেন অবশেষে। কিন্তু এত চেষ্টার পরও শুধু চন্দ্রালােকিত রাতে পথ ভুল করার ফলে পাকিস্তানি পুলিশের হাতেই পড়তে হয় তাদের। ছদ্মবেশী ইলার পরিচয় পুলিশের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে এ নারী সাঁওতাল মেয়ে নয়- সত্যিই সত্যিই এবার প্রজাপতি কাঁটাতারে বেড়ায় আটকে যায়। রােহনপুর জেল হাজতে পুলিশ ইলার উপর বুটের লাথি, ঘুষি, বেত্রাঘাত আর চাবুকের ঝড় বয়ে গেল। এত নির্মম অত্যাচারের পরেও ইলা মিত্রের মনে প্রজাপতি স্বপ্নরঙিন কল্পনায় খেলা করে। লেখকের ভাষায়-
“ও লাল-নীল সবুজ হলুদ আলাে দেখতে পায়। মাথার ভেতর হাজার প্রজাপতি- রঙের ঔজ্জ্বল্যে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।.. আধা অচেতনে শুনতে পায় বুটের দাম্ভিক আওয়াজ এবং কর্কশ কণ্ঠ, আমরা আবার রাত্রে আসব। তুমি যদি স্বীকার না করাে তাহলে সেপাইরা একে একে তােমাকে ধর্ষণ করবে।”
মুখ দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত উঠলেও ইলা মিত্র দেখেন সাঁওতাল ছেলে হরেকের মারের চোটে নাকে মুখে রক্ত গড়াচ্ছে তবু রমেন মিত্র বা ইলা মিত্রের কথা না বলে হরেক সেখানেই মারা যায়, আর বাকি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ছেলেরা সকলেই প্রহারের ফলে জ্ঞান হারায় থানার মাটিতে অনেকে কাঁটাতারে পড়া প্রজাপতির মতােই মুখ দিয়ে কোনাে শব্দ বের না করে, রক্ত উঠিয়ে মারা যায়। এরপরে আরাে সংগ্রামী প্রজাপতির মতাে পুলিশের ফাঁদে আটকা পড়েছে। এ সম্পর্কে লেখক জানিয়েছেন-
“ট্রেনে করে পালিয়ে যাচ্ছিল বেশ কিছু সাঁওতাল, তাদেরকে রাজশাহীর কাছে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিভিন্ন জায়গা, থেকে গ্রেফতার হয়ে আসতে থাকে আরাে অনেকে। গ্রেফতার হয় এমন অসংখ্য সাঁওতাল কৃষক যে, চাপাইনবাবগঞ্জের সাব জেল পূর্ণ হওয়ায় কয়েক দফায় আসামীদের পাঠানাে হয় রাজশাহী জেলে। ওরা এখনাে জঙ্গি, তেজী এবং একরােখা। চিগুরায় দাঁত মেলে হাসে, ওরা আমাদের ধরবে ধরুক, মারবে মারুক, জেলে ভরবে ভরুক, আমরাও শেষ দেখতে চাই।”
এদের সবার থেকে আলাদা বিচার ইলা মিত্রের, ওরা বলে পাকিস্তানি অপারেশন এখানাে শেষ হয়নি। রমেন মিত্রকে পেলে এরা হয়ত গুলি করে মারত কিন্তু ইলার দেহ বলে সে নারী, সুতরাং এ নারীকে জব্দ করতে হবে শরীরের দিক থেকে। পাকিস্তানি পুলিশের নারকীয় অত্যাচার শেষে ইলা মিত্রকে পার্টি থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কোনাে সংস্কারের বশবর্তী হয়ে তিনি যেন কিছু গােপন না করেন। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে লিফলেট আকারে জবানবন্দি প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৫০ সালের ১৬ জানুয়ারি। এদিন থেকে তার উপর পুলিশের নির্যাতন শুরু। সেলিনা হােসেনের প্রবন্ধ সংকলন ‘নির্ভয় করাে হে’ বইয়ে ‘সেই জবানবন্দিটি এবং আমাদের ঋণ’ নিবন্ধে বিস্তৃতভাবে যে জবানবন্দিটি তুলে ধরা আছে। আমরা সম্পূর্ণ বিবৃতিটি না দিয়ে শুধু অংশ বিষে তুলে ধরবঃ
“কেসটির ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি । বিগত ৭-১-৫০ তারিখে আমি রােহনপুরে গ্রেফতার হই এবং পরদিন আমাকে নাচোল নিয়ে যাওয়া হয় হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতে। আমার যেহেতু বলার কিছু ছিল না, কাজেই তারা আমার সমস্ত কাপড়চোপড় খুলে নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গভাবে সেলের মধ্যে আমাকে বন্দি করে রাখে। …. সেদিন সন্ধ্যাবেলায় এস. আই.-এর উপস্থিতিতে সেপাইরা তাদের বন্দুকের বাট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে শুরু করে। সে সময় আমার নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়তে থাকে।
যে কামরাটিতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলাে সেখানে স্বীকারােক্তি আদায়ের জন্য তারা নানা ধরনের অমানুষিক পদ্ধতিতে চেষ্টা চালায়। দুটো লাঠির মধ্যে আমার পা দুটি ঢুকিয়ে চাপ দেওয়া হচ্ছিল এবং সে সময়ে চারধারে যারা, দাঁড়িয়ে ছিলাে, তারা বলছিলাে যে, আমাকে পাকিস্তানি ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে। ….. জোর করে আমাকে কিছু বলাতে না পেরে তারা আমার চুলও উপড়ে তুলে ফেলেছিল।
সেলের মধ্যে আবার এস, আই সেপাইদেরকে চারটে গরম সেদ্ধ ডিম আনার হুকুম দিল এবং বললাে, এবার সে কথা বলবে। তারপর চার পাঁচজন সেপাই আমাকে জোরপূর্বক ধরে চিত করে শুইয়ে রাখলাে এবং একজন আমার যৌন অঙ্গের মধ্যে একটি গরম সিদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দিল… এরপর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।
৯-১-৫০ তারিখের সকালে যখন আমার জ্ঞান হলাে তখন উপরিউক্ত এস, আই এবং কয়েকজন সেপাই আমার সেলে এসে তাদের বুট দিয়ে আমার পেটে লাথি মারতে শুরু করলাে। এরপর ডান পায়ের গােড়ালিতে একটা পেরেক ফুটিয়ে দেওয়া হলাে। এস, আইকে বিড়বিড় করে বলতে শুনলামঃ ‘আমরা আবার রাত্রিতে আসছি এবং তুমি যদি স্বীকার না করাে, তাহলে সেপাইরা একে একে ধর্ষণ করবে। গভীর রাত্রিতে… তিন চারজন আমাকে ধরে রাখলাে এবং একজন সেপাই সত্যি আমাকে ধর্ষণ করতে শুরু করলাে।’
পরদিন ১০-১-৫০ তারিখে যখন জ্ঞান ফিরে এলাে তখন আমি দেখলাম যে, আমার দেহ থেকে দারুণভাবে রক্ত ঝরছে সেই অবস্থাতেই আমাকে নাচোল থেকে নবাবগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হলাে।”
সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়- ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ একজন মহৎ শিল্পীর দায়বদ্ধ মানসচেতনার ফসল। এ উপন্যাস রচনার মাধ্যমে সেলিনা হােসেন নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন দেশের বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাসের পাতা থেকে একজন সংগ্রামী নারীর জীবনকে কথাসাহিত্যে রূপায়িত করার মহৎ শৈল্পিক দায়িত্ব- সাথে সাথে প্রকাশ পেয়েছে রমেন, আজমল, আজিজ, মাতলা, হরেক, কুতুব, আছিয়া, জোহরা এবং অন্যান্য তেভাগা আন্দোলনের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা। স্বপ্নরঙিন মানুষগুলাের স্বপ্ন কীভাবে প্রজাপতির মতাে কাটাতারে আটকে গেছে তার বিশ্বস্ত বর্ণনা। তাই সার্বিক বিচারে বলা যায়- সেলিনা হােসেনের কাঁটাতারে প্রজাপতি উপন্যাসটির নামকরণ যথার্থ হয়েছে।
Leave a comment