প্রশ্নঃ সৃজনমূলক ও উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদের মধ্যে সম্পর্ক আলােচনা কর। এ দুটি মতবাদের মধ্যে কোনটি অধিক গ্রহণযােগ্য মতবাদ?

অথবা, সৃজনমূলক ও উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদের মধ্যে সম্পর্ক বর্ণনা কর। এ দুটি মতবাদের মধ্যে কোনটি অধিক গ্রহণযােগ্য মতবাদ? ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ বিবর্তনবাদ জগতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কিত একটি মতবাদ। বিবর্তনবাদ অনুসারে এ বিশ্ব আকস্মিকভাবে সৃষ্টি হয়নি। জগতের অসংখ্য জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ তথা সকল জীবন ও অজৈব সত্তা সহজ-সরল আদিম অবস্থা থেকে বিকশিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে এবং এই বিবর্তনধারা অগ্রসর হয়ে চলেছে নিরন্তর। এক অবিরাম পরিবর্তনপ্রবাহ। আর এ পরিবর্তন ধারায় নিয়ত বদল হচ্ছে জগৎ, জীবন, সমাজ তথা সমাজের সবকিছু। এ পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিবর্তনের ধারণা খুঁজে পাওয়া যায়। নিম্নে সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ ও উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদের সম্পর্ক এবং অন্যান্য তত্ত্ব আলােচনা করা হলাে-

সৃজনমূলক বিবর্তনবাদঃ ফরাসি দার্শনিক হেনরী বার্গসাে ছিলেন সৃজনমূলক বিবর্তনবাদের প্রবর্তক। তার মতে, বিবর্তনপ্রক্রিয়া সৃজনশীল ও সম্পূর্ণ স্বাধীন। বার্গসাের মতে, তিনি মনে করেন যান্ত্রিক ও উদ্দেশ্যবাদ দুই ই বিবর্তনের স্বাধীন ও সৃজনধর্মী প্রক্রিয়ার ওপর আরােপ করে এক অযাচিত নিয়ন্ত্রণ। যন্ত্রবাদে অতীত নিয়ন্ত্রণ করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে এবং উদ্দেশ্যবাদে ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করে অতীত ও বর্তমানকে। উভয় মতেই সবকিছু নির্দিষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত। যন্ত্রবাদ প্রতিটি কার্যফলকে মনে করে তার পূর্ববর্তী কারণিক ঘটনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে। বিবর্তনপ্রক্রিয়ায় নতুন কিছু আবির্ভাবের অবসর নেই এ দুই মতবাদের কোনােটিতে অতীত দ্বারা বর্তমানের নিয়ন্ত্রণ যেমন একরকমের নিয়ন্ত্ৰণবাদ, ঠিক তেমনি ভবিষ্য দ্বারা বর্তমানের নিয়ন্ত্রণও এক ধরনের নিয়ন্ত্ৰণবাদ। একদিক থেকে যন্ত্রবাদ ও উদ্দেশ্যবাদ দুটিই নিয়ন্ত্ৰণবাদী। এ দুইয়ের কোনােটিতে অবকাশ নেই অভিনবত্ব বা সৃষ্টিশীলতার। নিম্নলিখিত কারণে তিনি যন্ত্রবাদ ও উদ্দেশ্যবাদ উভয়কে বর্জন করেছেন।

যান্ত্রিক বিবর্তনে প্রতিটি উত্তরস্তর পূর্ববর্তী স্তর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ মতবাদ অনুসারে, জড় প্রাণকে এবং প্রাণ মনকে নিয়ন্ত্রিত করে। যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ অনুসারে, প্রাণ হচ্ছে জড়ের জটিলতর রূপ এবং মন হচ্ছে প্রাণের জটিলতর রূপ। এ মতের বৈশিষ্ট্য হল ‘নিয়ন্ত্রণ ও পুনরাবৃত্তি’। যন্ত্রবাদের বিরুদ্ধে বার্গসাে বলেন, বিবর্তনপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না এবং বিবর্তনে পুনরাবির্ভাবের কোনাে স্থান নেই। সুতরাং যান্ত্রিক বিবর্তনকে তিনি ভ্রান্ত বলে বর্জন করেছেন।

উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তন সম্পর্কে বার্গসাে বলেন, এটি হচ্ছে যন্ত্রবাদের বিপরীত রূপ। কারণ যান্ত্রিক বিবর্তনপ্রক্রিয়ায় প্রত্যেকটি উত্তরস্তর পূর্ববর্তী স্তর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনপ্রক্রিয়ায় বলা হয়েছে প্রতিটি পূর্বস্তর উত্তরস্তর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনও নিয়ন্ত্রণ স্বীকার করে বলে বার্গসাে যান্ত্রিক ও উদ্দেশ্যমূলক উভয় প্রকার বিবর্তনবাদকে বর্জন করেন।

বার্গসাের মতবাদ অনুসারে, প্রাণ প্রবাহই বিশ্বের পরম তত্ত্ব। প্রাণপ্রবাহ অবিরাম গতিতে সৃষ্টির গতিতে এগিয়ে চলেছে। এর ভবিষ্যৎ গতি অনির্দিষ্ট এবং অজ্ঞাত। প্রাণ ও কাল অভিন্ন বলে একে বার্গসাে কালপ্রবাহও বলেছেন। তার মতে, সৃষ্টির পর উক্ত পাণপ্রবাহ থেকে এক বিপরীত শক্তির সৃষ্টি হয়। এ বিপরীত শক্তি থেকে উদ্ভূত হয় জড়। কাজেই প্রাণ হচ্ছে গতি এবং জড় হচ্ছে বিপরীত গতি। বার্গসের মতে, “প্রাণপ্রবাহ থেকেই জড়জগৎ, প্রাণ ও মনের সৃষ্টি হয়। এ প্রাণপ্রবাহকে বুদ্ধির দ্বারা জানা যায় না। একে সত্তাল সাহায্যে উপলব্ধি করা যায়।”

উৎকর্ষের দিকঃ সৃজনমূলক মতবাদের কতকগুলাে উৎকর্ষের দিক রয়েছে; যেমন-

(ক) এ মতবাদ অনুসারে বিবর্তনপ্রক্রিয়া সৃজনশীল ও সম্পূর্ণ স্বাধীন।

(খ) বিবর্তন প্রক্রিয়ার প্রতি স্তরে যে নতুন গুণের সৃষ্টি হয় তা যথার্থই সত্য।

(গ) বিবর্তন প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তিমূলক নয়।

জড়, প্রাণ ও মনের প্রকৃতিগত পার্থক্য থেকেই বােঝা যায় যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে বার্গসাের অভিমত যথার্থই সত্য।

সমালােচনাঃ হেনরি লুই বার্গসাে বিবর্তনপ্রক্রিয়ার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার কোনাে প্রমাণ আমরা খুঁজে পাই না। এই তথ্য একেবারেই কাল্পনিক এবং আজগুবি। এ মতবাদের বহুসমালােচনা রয়েছে। উক্ত সমালােচনাসমূহ নিম্নে আলােচনা করা হলাে-

প্রথমত, এ মতবাদ বিজ্ঞানসম্মত নয়। এর তাৎপর্য বুদ্ধির সাহায্যে বােঝা সম্ভব নয় বলেই তিনি স্বজ্ঞার কথা উল্লেখ করেছেন। কার্যকারণ সম্পর্ক স্বীকৃত হলেও তিনি বিবর্তনপ্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে নিয়ন্ত্রণকে অস্বীকার করেছেন।

দ্বিতীয়ত, যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে এ মতবাদ যথার্থ হলেও উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে তা সঠিক নয়। অন্তর-পরিণতিমূলক বিবর্তনপ্রক্রিয়া অনুসারে বিবর্তনের উদ্দেশ্য বিবর্তনের মধ্যেই নিহিত। বাইরের কোনাে শক্তির দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত নয়। বিবর্তনপ্রক্রিয়া আত্মনিয়ন্ত্রিত।

তৃতীয়ত, বার্গসাে অন্ধগতিময় প্রাণপ্রবাহকে জগতের পরম তত্ত্ব বলেছেন। কিন্তু এ অন্ধপ্রাণপ্রবাহ থেকে জগতের শৃখলা, সামঞ্জস্য এবং বিভিন্ন গঠনবৈচিত্র্য কীভাবে উদ্ভূত হয়েছে তা সহজে বুঝা যায় না।

চতুর্থত, বার্গসের বিবর্তনপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণহীন। বিবর্তনপ্রক্রিয়ার যদি কোনােরূপ নিয়ম-শৃখলা না থাকে তবে তা হয় উশৃঙ্খলতা। কিন্তু এ বিবর্তনপ্রক্রিয়া কখনই সুশৃঙ্খল জগতের ব্যাখ্যা দিতে পারে না।

উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদঃ উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদ একটি অভিনব বিবর্তনবাদ। এই বিবর্তনবাদের দুজন উল্লেখযােগ্য দার্শনিক হলেন লয়েড মর্গান এবং স্যামুয়েল আলেকজান্ডার। বিবর্তনপ্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে নতুন উন্মেষ ঘটে বলে মর্গান সর্বপ্রথম বিবর্তনকে উন্মেষমূলক বিবর্তন বলে বর্ণনা করেন। এ মতবাদ অনুসারে, জগতের বিবর্তনপ্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে নতুন নতুন সত্তা বা গুণের উন্মেষ ঘটে যা পরবর্তী স্তরের পুনর্বিন্যাস নয়। উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদীরা জাগতিক প্রক্রিয়ার নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা স্বীকার করলেও তাদের মতে বিবর্তনের প্রতিটি স্তরে অভিনবত্ব বিদ্যমান। উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদীরা বলেন, মন প্রাণ থেকে আর প্রাণ জড় থেকে উন্মােষিত হলেও প্রাণের মধ্যে এমন এক গুণ বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা জড়ের মধ্যে নেই। আবার মনের মধ্যে এমন গুণ রয়েছে যা প্রাণে নেই। তাদের মতে, জড় থেকে প্রাণ এবং প্রাণ থেকে মন পর্যায়ক্রমে বিচ্ছিন্ন থাকলেও প্রাণ জড়ের জটিল আকারমাত্র নয়। প্রাণ হলাে নতুন গুণ ও শক্তিবিশিষ্ট এমন এক সত্তা যা তার উন্মেষের আগে জডের মধ্যে নিহিত ছিল না। আবার মনও জটিল আকারের জড় ও প্রাণের পুনর্বিন্যাস মাত্র নয়। বরং মন হলাে এমন গুণ ও শক্তিসম্পন্ন এক নতন সত্তা যা তার উন্মেষের আগে জড় ও প্রাণ প্রভৃতি স্তরের মধ্যে নিহিত ছিল না।

মর্গানের মতে, বিবর্তনপ্রক্রিয়ার আদি উপাদান একাধারে জড় ও মানস শক্তি। তিনি বলেন, ঈশ্বর হলাে তেজশক্তি যার কার্যক্ষমতা নতুনের উন্মেষ ঘটায় এবং উন্মেষমূলক বিবর্তনের সমস্ত গতিকে পরিচালিত করে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সৃজনমূলক ও উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদ কোনােটিই পরিপূর্ণ যুক্তিযুক্ত এবং সন্তোষজনক মতবাদ নয়, তারপরও বিববর্তনের ধারা বিকাশে এই মতবাদ দু’টির গুরুত্বকে কোনােক্রমেই অস্বীকার করা যায় না।