প্রশ্নঃ  সুশাসন প্রতিষ্ঠার সমস্যা সমাধানের উপায়সমুহ আলোচনা কর। 

ভূমিকাঃ বর্তমান সময়ে প্রায় সব রাষ্ট্রই ‘কল্যাণকর রাষ্ট্রের’ (Welfare State ) রূপ পরিগ্রহ করছে। এরূপ কল্যাণকর রাষ্ট্রে জনগণের কল্যাণ ও ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ ঘটানোর চেষ্টা হচ্ছে। দমন ও নিপীড়নের মাধ্যমে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র শাসন পরিচালনা করার দিন বদলে গেছে। শাসনের সাথে সেবা প্রদানের বিষয়টি এখন গুরুত্ব লাভ করেছে। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা অতীব গুরুত্বপূর্ণ, যা কখনো আকস্মিকভাবে ঘটানো যায় না। একে অর্জন করতে হয় ধাপে ধাপে এবং সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে। সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো এখন সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য চাপ দিচ্ছে। তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলেও রয়েছে বহু সমস্যা।

সুশাসন প্রতিষ্ঠার সমস্যা সমাধানের উপায় (Measures to remove the problems of good governance): সুশাসন প্রতিষ্ঠার সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবেঃ

১. সংবিধানে মৌলিক অধিকারের সন্নিবেশ ও তা বাস্তবায়নঃ বাক, ব্যক্তি স্বাধীনতাসহ সব ধরনের মৌলিক অধিকার সংবিধানে সন্নিবেশিত করতে হবে। শুধু তাই নয় এগুলো যেন কেউ ব্যক্তিস্বার্থে বা ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে খর্ব করতে না পারে সেজন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

২. মিডিয়া ও প্রচার মাধ্যমের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপের অবসানঃ অধিকাংশ রাষ্ট্রেই অকারণে ও সম্পূর্ণ ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে সরকার মিডিয়া ও প্রচার যন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। ফলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জনমত গঠনের সুযোগ নষ্ট হয়, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়। সরকার আরো স্বৈরাচারী হয়। এ জন্য মিডিয়া ও প্রচার যন্ত্রের ওপর সরকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে।

৩. সহিংসতা দূর ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠাঃ রাজপথে সহিংস আন্দোলন করে, জ্বালাও পোড়াও নীতি অবলম্বন করে, অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত হরতাল সংস্কৃতি চালু রেখে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান খোঁজার কু-অভ্যাস বদলাতে হবে। জাতীয় সংসদে বসে এবং পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উপায়েই রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। সরকারের বিরোধিতার জন্য হরতালের বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতে হবে। নির্বাচিত সরকারকে নির্বাচনের মাধ্যমেই সরানোর আশ্রয় নিতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সুশাসনের অন্তরায়।

৪. জবাবদিহিতা বা দায়বদ্ধতার নীতি প্রতিষ্ঠাঃ রাষ্ট্র পরিচালক বা সরকার থেকে শুরু করে প্রশাসনের সব স্তরে জবাবদিহিতা বা দায়বদ্ধতার নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। লক্ষ্য অর্জনে কার কি দায়িত্ব এবং কোন্ সময়ের মধ্যে তা সম্পন্ন করতে হবে, কার নিকট জবাবদিহি করতে হবে তা পূর্বেই নির্ধারণ করতে হবে। শাসন বিভাগ বা মন্ত্রিসভাকে আইনসভার নিকট তাদের গৃহীত নীতি, সিদ্ধান্ত ও কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তা করতে ব্যর্থ হলে আইনসভায় অনাস্থা এনে মন্ত্রিসভাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যবস্থা বিধান করতে হবে। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ব্যর্থতার জন্য কী ব্যবস্থা নেয়া যাবে সেকথাও পরিষ্কার করে উল্লেখ থাকতে হবে।

৫. স্বচ্ছ প্রশাসন গড়ে তোলাঃ শাসন বা গভর্নেন্স-এর লক্ষ্য হবে স্পষ্ট, হীরকের মত স্বচ্ছ। শাসনের স্বরূপ, শাসকের কাজকর্ম, প্রণীত আইন-কানুন এমন হতে হবে যেন তা সকল নাগরিকের বোধগম্য হয়। এগুলো যেন কেউ ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে বা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। দুর্নীতি দূর করে স্বচ্ছ প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে।

৬. নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করাঃ মানুষ সরকার এবং রাষ্ট্র প্রণীত আইন মেনে চলে শুধু শাস্তির ভয়ে নয়। মানুষ বিবেকবোধ, প্রজ্ঞা, উচিত-অনুচিত, ভালো-মন্দ বিচার করেও রাষ্ট্র এবং সরকারকে মেনে চলে। নৈতিক মূল্যবোধ সরকার এবং সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে পরিশীলিত করে। নৈতিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ ও আমলা-প্রশাসকগণের আচরণ সীমা লংঘন করে না। তারা আইন অনুযায়ী, সংবিধান অনুযায়ী কাজ করেন। তারা সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তারা দুর্নীতিতে লিপ্ত হন না।

৭. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাঃ আইনের শাসনের প্রাণভোমড়া তিনটি প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে। এগুলো হলো শাসকের ন্যায়পরায়ণ আচরণ, নিপীড়নমুক্ত স্বাধীন পরিবেশে ও আইনের শাসন প্রয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ। আইন হতে হবে নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট যেন সহজেই তা বোধগম্য হয় এবং সবাই তা পালন করতে বা মেনে চলতে পারে। আইন কার্যকর করবে আদালত। কোনো ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী বিচার কাজ চলবে না, তা চলবে আইনের আলোকে।

৮. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণঃ বিচার বিভাগকে আইন ও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগ করতে হবে। জেলা ও অধঃস্তন আদালতগুলোর বিচারক নিয়োগ করতে হবে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে।

৯. সরকারের দক্ষতা বৃদ্ধিঃ সরকারকে দক্ষ, দূরদর্শী ও কার্যকর ভূমিকা পালনে সক্ষম হতে হবে। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তথ্যের সহজলভ্যতা সৃষ্টি করতে হবে, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। দক্ষ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

১০. দুর্নীতি প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণঃ দুর্নীতির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করতে হবে। দুর্নীতি বিরোধী সভা-সমিতি, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করতে হবে। এজন্য সুশীল সমাজের সৎ মানুষদের নিয়ে ‘দূর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতি বিরোধী আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে, প্রয়োজনে সিলেবাসে দুর্নীতি বিরোধী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়াও নৈতিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা-জনগণের মনে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিকে ঘৃণা করার মানসিকতা বৃদ্ধি করতে হবে।

১১. সুযোগ্য নেতৃত্বঃ দক্ষ, সৎ, দূরদর্শী, অভিজ্ঞ, ন্যায়পরায়ণ, জনদরদি বা জনবান্ধব নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শিক্ষিত, সৎ ও প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বের অভাবে একটি রাষ্ট্র কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সাধন করতে পারে না।

১২. সার্বভৌম ও কার্যকর আইনসভাঃ আইনসভার সার্বভৌমত্ব শুধু তত্ত্বকথায় যেন পর্যবসিত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। রাষ্ট্রের সকল সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে—আইনসভায় বসে যুক্তিতর্ক পেশ করে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। আইনসভাকে বাদ দিয়ে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবিদাওয়া আদায়ের কুঅভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। অকারণে, ঘন ঘন সংসদ বয়কট বা এখান থেকে ওয়াকআউট করা যাবে না। সংসদে অনুপস্থিত থাকার সময়সীমা কমাতে হবে৷ সকল সদস্যের বিশেষ করে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যদের আলোচনার সুযোগ দিতে হবে।

১৩. জন অংশগ্রহণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিঃ রাষ্ট্র ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বনির্ভর ও স্ব-শাসিত করার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নীতি প্রণয়নে নাগরিকদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে।

১৪. স্বাধীন কর্মকমিশন প্রতিষ্ঠাঃ জনপ্রশাসনে নিয়োগ এবং পদোন্নতির জন্য মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে হবে। এজন্য নিরপেক্ষ, সৎ ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি সমন্বয়ে কর্মকমিশন গঠন করতে হবে।

১৫. স্বাধীন নির্বাচন কমিশনঃ রাজনৈতিক দল গঠন ও পরিচালনায় স্বচ্ছতা আনয়ন করতে হবে। দলগুলোর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করতে হবে। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা, স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।

১৬. স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠনঃ মানবাধিকার লংঘন যেন না হয়, কারো ওপর যেন জুলুম-নির্যাতন না করা হয়, সরকার যেন অন্যায়-নির্যাতন না করতে পারে—তা দেখার জন্য মানবাধিকার কমিশন গঠন করতে হবে।

১৭. জনস্বার্থকে প্রাধান্য প্রদানঃ সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সার্বিক কল্যাণ সুশাসনের লক্ষ্য হওয়ায় এ প্রক্রিয়ায় জনগণের সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। এ অংশগ্রহণ সম্ভবপর হয় যখন গভর্ন্যান্স উক্ত জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরিণত হয়।

১৮. লক্ষ্য নির্ধারণ এবং অগ্রাধিকার বিবেচনায় পারঙ্গমতাঃ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে লক্ষ্য নির্ধারণ এবং অগ্রাধিকার বিবেচনায় পারঙ্গম ও দূরদর্শী হতে হবে। 

১৯. দারিদ্র্য দূরীকরণঃ দারিদ্র্য দূরীকরণে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। 

২০. স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালীকরণঃ স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে। স্থানীয় সরকারকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান করার পাশাপাশি এর উপর থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করতে হবে।

২১. জনসচেতনতা বৃদ্ধিঃ সুশাসন কী, কীভাবে সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে, এক্ষেত্রে জনগণ ও সরকারের কী করণীয় সে সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

২২. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠাঃ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য মৌলবাদী, জঙ্গী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোর অপতৎপরতা নস্যাৎ করতে হবে।

২৩. ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাঃ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এজন্য লর্ড অ্যাক্টন বলেছেন যে, ‘ক্ষমতা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় এবং নিরংকুশ ক্ষমতা দুর্নীতিকেও নিরংকুশ করে তোলে’। Power Corrupts, absolute Power tends to corrupt absolutely.)