ভূমিকাঃ বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার মানুষের চিন্তা-চেতনা, জীবনযাত্রা, চিকিৎসাশাস্ত্রসহ সকল ক্ষেত্রে নবদিগন্তের উন্মোচন করে চলেছে। বিজ্ঞানকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করার সাধনা থেকে ঘটে প্রযুক্তির বিকাশ। বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আজ মানুষের জীবনযাত্রার ধরন ও মান পাল্টে দিয়েছে। রাষ্ট্র, সরকার ও প্রশাসনের ওপরও প্রযুক্তির প্রভাব পড়েছে বহুলভাবে। এ প্রেক্ষাপটে তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর ‘ই-গভর্নেন্স’ নামক এক নতুন ধারণার উদ্ভব ঘটেছে। সরকারের কাজকর্মে স্বচ্ছতা, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এখন ‘ই-গভর্নেন্স’-এর বিকল্প নেই। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে ‘ই-গভর্নেন্স’ এখন সময়ের জোরালো দাবিতে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে সুশাসনও একটি আধুনিক ধারণা। ‘ই-গভর্নেন্স’ রাষ্ট্রের নাগরিকদের শাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করে দিয়ে এবং সেখানে স্বচ্ছতা সৃষ্টি ও দক্ষতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করে দিয়েছে।
সুশাসন ও ই-গভর্নেন্স-এর সুবিধা (Advantage of Good Governance and E-Governance): সুশাসন ও ই-গভর্নেন্স-এর পারস্পরিক সম্পর্ক খুবই নিবিড়। ই-গভর্নেন্স নিম্নলিখিত উপায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো নিম্নরূপঃ
১. সেবা প্রদানকারী কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ স্থাপনঃ ই-গভর্নেন্স-এর আওতাধীন যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সাথে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। সময়, খরচ, শ্রম সবকিছুই এতে বেঁচে যায় বা কমে যায়।
২. স্বচ্ছতা আনয়নঃ ই-গভর্নেন্সে স্বচ্ছতার বিষয়টিকে বড় করে দেখা হয়। সরকারের প্রশাসনিক সংগঠনগুলোতে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মে এবং মাঠপর্যায়ের প্রশাসনে স্বচ্ছতা আনয়ন করা প্রয়োজন। সরকার কী কী কাজ করছে, কেন করছে, কী কী মূলনীতির ওপর সরকার সিদ্ধান্ত বা নীতি প্রণয়ন করছে তা জনগণের জানা প্রয়োজন। ই-গর্ভনেন্স তা জানতে সাহায্য করে।
৩. দক্ষ ও সাশ্রয়ী পন্থাঃ ই-গভর্নেন্স-এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো একটি দক্ষ ও সাশ্রয়ী পন্থায় জনগণের নিকট সেবা পৌঁছানো। ধরা যাক সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা পরিবর্তনের ব্যাপারগুলো জনগণের জানানো প্রয়োজন। এজন্য বিপুল সংখ্যক কাগজ-কলম ও সময়ের প্রয়োজন হয়। এ ব্যাপারটি যদি ইলেকট্রনিক ব্যবস্থার সাহায্যে করা হয় তবে তা অনেক সহজে ও কম খরচে করা যেতে পারে। সময়, শ্রম ও অর্থের অপচয় কমিয়ে দেয় বলে এ ব্যবস্থা ব্যবসায়ীদের জন্য সুবিধাজনক ও সাশ্রয়ী।
৪. রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরিঃ রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে ই-গভর্নেন্স বা ই-সরকার কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। ভোটদানের ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা জনগণের সংশ্লিষ্টতা ও আগ্রহ বাড়াতে সাহায্য করে।
৫. তথ্যের সহজলভ্যতাঃ ই-গভর্নেন্স যেকোনো প্রক্রিয়াকে সহজ করে দিতে পারে। এছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের নিকট তথ্য প্রাপ্তি অনেক সহজলভ্য করতে পারে। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাষ্ট্র ইন্ডিয়ানাই সর্বপ্রথম সরকারি তথ্য ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় শনাক্তকরণ করে আইনগতভাবে তা প্রত্যয়নপূর্বক সরবরাহ করেছে। এর ফলে খরচও অনেক কমেছে। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বেই এই অনলাইন সেবা ছড়িয়ে পড়েছে।
৬. জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণঃ ই-গভর্নেন্সের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারাদেশের মানুষ রাজনীতিবিদ ও সরকারি চাকরিজীবীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে এবং তাদের বক্তব্য সকল ব্যক্তির নিকট পৌছাতে পারে। এছাড়াও রাজনীতিবিদ ও সরকারি চাকরিজীবীরা ব্লগারদের বক্তব্য থেকে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে একটি ধারণা করতে পারে। চ্যাটরুমে প্রবেশ করে জনগণ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। ভোটাররা এ সুবিধার মাধ্যমে সরকারের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। এতে জনগণ বুঝতে পারে ভবিষ্যতে কাকে ভোট দেওয়া যেতে পারে এবং কীভাবে সহায়তা প্রদান করলে সরকারি কর্মচারীরা আরো উৎপাদনশীল কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত করতে পারবে।
৭. প্রকৃত গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসরঃ ই-গভর্নেন্সের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে যে কোনো সরকার প্রকৃত বা যথার্থ · গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হতে পারে। কীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং কীভাবে সরকারি কর্মচারীদের নিকট থেকে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হয় তা জনগণ বুঝতে পারে।
৮. পরিবেশগত সুবিধাঃ পরিবেশবিদ, সংবাদ মাধ্যম ও সচেতন জনগণের চাপে অনেক দেশের সরকার ইন্টারনেট ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। এর ফলে বিপুল সংখ্যক কাগজের ব্যবহার কমে গেছে। এর ফলে পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা কমে যাচ্ছে।
৯. দ্রুততা ও সুবিধা বৃদ্ধিঃ বিভিন্ন সরকারি অফিসে না গিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে জনগণ সরকারি কাজকর্ম সম্পাদন এবং খুব সহজেই যেকোনো হিসাব সংরক্ষণ করতে পারে। চাকরিজীবী ও ছাত্রদের আবেদনপত্র সহজে সংগ্রহ ও তা জমা দিতে পুরো প্রক্রিয়াটি সহজে সম্পন্ন করা যায়। শারীরিক প্রতিবন্ধীরা খুব সহজেই ঘরে বসে বিভিন্ন রকম প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধা ও সরকারি সেবা গ্রহণ করতে পারে।
১০. জনগণের অংশগ্রহণঃ সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে যে, জনগণ আগ্রহ সহকারে ই-গভর্নেন্সের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছে। ক্রমবর্ধমানহারে জনগণ অনলাইনে রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করছে। এমনকি তরুণ প্রজন্মের যে অংশটি রাজনৈতিক বিষয়ে এতদিন উদাসীন ছিল তারাও ই-গভর্নেন্সের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ৯০% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ অপরাধীদের শনাক্তকরণে ইন্টারনেটের ব্যবহারকে স্বাগত জানিয়েছে।
১১. অবাধ ও সার্বজনীন তথ্য প্রবাহঃ ই-গভর্নেন্স ব্যবস্থায় ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সবার জন্য সরকারি তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ উন্মুক্ত থাকে। কোনো তথ্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য সংরক্ষিত থাকে না। এরূপ অবাধ ও সর্বজনীন তথ্য প্রবাহ মানুষে মানুষে প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে।
১২. সময় বাঁচায়ঃ ই-গভর্নেন্স ব্যবস্থা বিকশিত হবার পূর্বে হাতে-কলমে বা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সংবাদ প্রেরণ, কাগজপত্র বা ফাইল সংরক্ষণ থেকে শুরু করে সব ধরনের সরকারি কাজ করা হতো। এতে প্রচুর সময় ব্যয় হতো। ই- গভর্নেন্স ব্যবস্থা সময় বাঁচিয়েছে এবং দ্রুত কাজ সম্পন্ন করতে সাহায্য করেছে।
১৩. সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠাঃ ই-গভর্নেন্স এর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো স্বচ্ছতা। সরকারের সব কার্যক্রম বা সকল পদক্ষেপ জনগণ জানতে ও বুঝতে পারে। এরূপ স্বচ্ছতাই জবাবদিহিতার পরিবেশ তৈরি করে।
১৪. দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়কঃ ই-গভর্নেন্সে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আছে বলেই দুর্নীতি স্বভাবতই কমে যায়। সরকার কী করছে, কীভাবে করছে, আর্থিক লেনদেন কীভাবে হচ্ছে- জনগণ সহজেই জানতে পারে বলে দুর্নীতি প্রতিরোধে ই- গভর্নেন্স প্রশংসা অর্জন করেছে।
১৫, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাসঃ ই-গভর্নেন্স আমলাতান্ত্রিক জটিলতার দুর্ভোগের বা হয়রানির হাত থেকে জনগণকে রেহাই দেয়। কেননা এর ফলে সরকারি অফিসে গিয়ে তথ্যের জন্য দিনের পর দিন ঘুরতে হয় না বা ঘুষ দিতে হয় না। ঘরে বসেই জনগণ এগুলো জানতে পারে।
উপসংহারঃ সরকার ও জনগণের মধ্যে অতিরিক্ত যোগাযোগের বিভিন্ন রকম নেতিবাচক ফলও রয়েছে। যখন ই-গভর্নে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একটি শক্তিশালী পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়, তখনই জনগণ ব্যাপক মাত্রায় সরকারের সাথে পারস্পরিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়ে। এর ফলস্বরূপ, যেহেতু সরকার জনগণ সম্পর্কে প্রচুর পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করে, সেহেতু জনগ এক ধরনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধহীন হয়ে পড়ে। এ অবস্থা আরো খারাপ পর্যায়ে পৌছলে দেশে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারী শাস প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কেননা যখনই জনগণের ব্যাপারে সরকারের কাছে সীমাহীন তথ্য থাকে, তখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হয়।
Leave a comment