ভূমিকাঃ ‘গভর্নেন্স’ (Governance) একটি বহুমাত্রিক ধারণা যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ, ক্ষেত্র এবং প্রেক্ষাপট থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। গভর্নেন্সকে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ‘শাসনের ব্যবস্থা’ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। ‘গভর্নেন্স’ প্রপ্রঞ্চটির সাথে ‘সু’ প্রত্যয় যোগ করে ‘সুশাসন’ (Good Governance) শব্দটির প্রকাশ ঘটানো হয়েছে। এর ফলে সুশাসনের অর্থ দাঁড়িয়েছে নির্ভুল, দক্ষ ও কার্যকরী শাসন। তবে সুশাসনকে একক কোনো ধারণার মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত বা ব্যাখ্যা করা যায় না। কেননা ‘সুশাসনের ধারণাটি হলো বহুমাত্রিক। বিভিন্ন তাত্ত্বিক, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা সংস্থা সুশাসন’ ধারণাটির (Concept) সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
সুশাসনের উপাদান ও বৈশিষ্ট্য (Elements & Characteristics of Good Governance): জি. বিলনে (G. Bilney), OCED এবং UNDP সুশাসনের বেশ কিছু আদর্শ ও কার্যকরী বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছে, এগুলো নিম্নরূপঃ
১. অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া (Participatory Process): অংশগ্রহণ বলতে রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার নীতি নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নে জনগণের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টনকে বোঝায়। এর অর্থ হলো রাজনৈতিক ও শাসন কাজে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ, নীতি প্রণয়নে নাগরিকের সম্পৃক্ততা, তথ্য, মত ও পরামর্শমূলক কাজে জনগণের অংশীদারিত্ব, রাষ্ট্রীয় নীতি ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় যৌথ উদ্যোগ, যৌথ পরিকল্পনা এবং জনগণের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ৷ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত জনগণের অংশগ্রহণ সুশাসনকে গতিশীলতা দান করে।
২. নৈতিক মূল্যবোধ (Ethics or moral values): আইন অপেক্ষা নৈতিকতার সীমানা অনেক বেশি প্রসারিত। নৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা শাসন কাজ পরিচালনা করা হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নকারী ব্যক্তিবর্গের নৈতিক চরিত্রের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. স্বচ্ছতা (Transparency): স্বচ্ছতার অর্থ পরিষ্কার, স্পষ্ট। দ্বৈত অর্থবোধতার অনুপস্থিতিই হলো স্বচ্ছতা। শাসন ব্যবস্থার আইন কানুন, নীতি বা সিদ্ধান্ত যদি স্পষ্ট, পরিষ্কার বা স্বচ্ছ হয়, যদি এর একাধিক অর্থ বা ব্যাখ্যা করার সুযোগ না থাকে তাহলে তা সহজেই জনগণের বোধগম্য হয়। শাসক-শাসিতের মধ্যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ও তা পালনকারীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকে না। নীতি বা সিদ্ধান্ত স্বচ্ছ হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। তবে স্বচ্ছতার জন্য চাই দায়িত্বশীলতা এবং দুর্নীতি দূর বা প্রতিরোধ করা।
৪. বৈধতা (Legitimacy): সরকারের বৈধতা, সরকারের গৃহীত নীতি বা সিদ্ধান্তের বৈধতা, প্রণীত আইনের বৈধতা শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সুশাসন আবশ্যকীয় উপাদান। এজন্যই অনির্বাচিত, অগণতান্ত্রিক, স্বেচ্ছাচারী বা সামরিক শাসনকে কেউ সুশাসন বলে না। কেননা তারা বৈধ শাসক নয়, তাদের গৃহীত নীতি বা সিদ্ধান্ত, প্রণীত আইন বা সামরিক বিধির বৈধতা থাকে না। বৈধতাকে তাই সুশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বলা হয়।
৫. দায়িত্বশীলতা (Responsibility): সুশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো দায়িত্বশীলতা। এর অর্থ হলো সরকার ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কর্মকাণ্ডের দায়িত্বশীলতা। সরকারের শাসন বিভাগ তাদের নীতি-সিদ্ধান্ত ও কাজের জন্য আইন বিভাগের নিকট দায়ী থাকে। এভাবে পরোক্ষভাবে শাসন কর্তৃপক্ষ জনগণের নিকটই দায়ী থাকে। কেননা আইন বিভাগের সদস্যগণ জনগণেরই নির্বাচিত প্রতিনিধি।
৬. আইনের শাসন ( Rule of Law): সুশাসন তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন আইনের শাসন বিদ্যমান থাকে। আইনের শাসনের মূলকথাই হলো- (ক) আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান, (খ) সকলেরই আইনের আশ্রয় লাভের সুযোগ, (গ) শুনানী ব্যতীত কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা। আইন হতে হবে সুনির্দিষ্ট, স্পষ্ট ও সহজবোধ্য। এছাড়াও আইনের শাসনের জন্য প্রয়োজন সরকারের ন্যায়পরায়ণ আচরণ, রাষ্ট্রের নিপীড়নমুক্ত স্বাধীন পরিবেশ এবং নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার বিভাগ৷
৭. দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতা (Accountibility): একটি রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ যেমন তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত ও কাজের জন্য আইন বিভাগের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে তেমনি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরস্থিত সংগঠন পরিচালনার জন্যও এর পরিচালকদের দায়বদ্ধ থাকতে হয়, জবাবদিহি করতে হয়। এই দায়বদ্ধতার রয়েছে দুটি দিক, (ক) রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা ও (খ) প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা। নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করে নির্বাচকদের ম্যান্ডেট লাভ এবং তা বাস্তবায়নে রাজনীতিবিদগণ যে অঙ্গীকার ঘোষণা করেন, তাকে বলে রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা। তেমনি প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্যও প্রশাসকদের বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারীদের দায়বদ্ধ থাকতে হয়। দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা গেলে শাসনের ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি পায়, অর্পিত দায়িত্ব দ্রুত সম্পন্ন হয়, দুর্নীতি হ্রাস পায় এবং লক্ষ্য অর্জিত হয়।
৮. দক্ষতা (Efficiency): দক্ষতার অর্থ হলো প্রাপ্ত সম্পদের ও উপকরণের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সুবিধা অর্জন। অবাধ তথ্য সরবরাহ, প্রশিক্ষণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ও তার ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্পর্কে জ্ঞান, দুর্নীতি বিরোধী মনোভাব, কর্তব্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, কাজের আগ্রহ, কাজে ফাঁকি দেয়ার অভ্যাস বা বিলম্বে যোগ দেয়ার বদঅভ্যাস পরিত্যাগ, সততা ইত্যাদি বজায় থাকলে দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
৯. জনপ্রশাসনের সেবাধর্মী মনোভাব (Service oriented attitude of Public administration): প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সব সময় মনে রাখতে হবে যে, জনকল্যাণের জন্যই প্রশাসন গড়ে উঠেছে। তারা জনগণের সেবক, প্রভু নন। জনসেবার জন্যই প্রশাসনের জন্ম হয়েছে, প্রশাসন চলে জনগণের অর্থে- এ উপলব্ধিই সুশাসনের পথকে প্রশস্ত করে।
১০. স্বাধীন বিচার বিভাগ (Independent Judiciary): সরকারের তৃতীয় স্তম্ভ হলো বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগের লক্ষ্য হলো ন্যায়বিচার নিশ্চিত বা প্রতিষ্ঠা করা। বিচার বিভাগ যদি সরকারের অন্য দুটি বিভাগের হস্তক্ষেপ মুক্ত, স্বাধীন নিরপেক্ষ থাকে; বিচারকগণ যদি সৎ, দক্ষ, নিরপেক্ষ ও উচ্চ নৈতিক গুণাবলির অধিকারী হন; ভয়ভীতি বা প্রলোভনের কাছে নতি স্বীকার না করেন তাহলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। বিচার বিভাগ আইনের শাসনের প্রকৃত অভিভাবক ও রক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারে। সুতরাং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সুশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বলা চলে।
১১. সততা (Honesty): সুশাসন তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেই সৎ হন। ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষুদ্র গোষ্ঠী স্বার্থ, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থলিপ্সা, বিলাসী জীবনের প্রতি আগ্রহ মানুষকে অসৎ করে তোলে। কাজেই এগুলো পরিহার করতে পারলে তা’ সুপ্রশাসন প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।
১২. লিঙ্গ বৈষম্যের অনুপস্থিতি (Absence of Gender disparity): সুপ্রশাসনে লিঙ্গ বৈষম্য করা হয় না। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যোগ্য ব্যক্তিই প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় নিয়োগ পান এবং সততা, দক্ষতা ও যোগ্যতার জন্য পুরস্কৃত হন বা পদোন্নতি পান।
১৩. বিকেন্দ্রীকরণ (Decentralisation): সুপ্রশাসন প্রতিষ্ঠায় বিকেন্দ্রীকরণের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিকেন্দ্রীকরণ হচ্ছে ক্ষমতার বণ্টন ও বিভক্তিকরণের নীতি। এর অর্থ হলো ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও দায়িত্বকে প্রশাসনের উচ্চ স্তর থেকে নিম্ন স্তরে ছড়িয়ে দেয়া। বিকেন্দ্রীকরণের ফলে জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে জনসচেতনতাও বৃদ্ধি পায়, প্রশাসনের মূল্যবান সময় বেঁচে যায়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনোবল ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
১৪. শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাঃ শক্তিশালী, মর্যাদাসম্পন্ন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হলে স্থানীয়ভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও উন্নয়ন করা যায়। এর ফলে প্রশাসনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায় এবং দক্ষ নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে।
১৫. সুশীল সমাজ (Civil Society): সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সুশীল সমাজের ভূমিকাকে বর্তমানে খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। সুশীল সমাজ নিরপেক্ষ ও নিরাসক্ত দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যা চিহ্নিত করা এবং তার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন । সুশীল সমাজের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিগণ প্রেস, রেডিও, টিভি মাধ্যম, বিভিন্ন সামাজিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকে বা মুখপাত্র হিসেবে যে বক্তব্য প্রকাশ করে থাকেন তা’ সুষ্ঠু জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
১৬. জন গ্রহণযোগ্যতা (Public Acceptability): সুপ্রশাসন তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন তা জনগণের আশা- আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম হয় বা সচেষ্ট হয়। জনগণের জন্য গ্রহণযোগ্য নয় এমন কোনো শাসনকে তাই সুশাসন বলা যায় না।
১৭. পেশাদারিত্ব (Professionalism): সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পেশাদারী দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য তাদের প্রচুর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি পেলে প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়৷
১৮. মর্যাদা ও বিশ্বাস অর্জনঃ প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজকর্ম, দক্ষতা ও যোগ্যতা দ্বারা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ এবং জনগণের নিকট নিজেদেরকে মর্যাদাসম্পন্ন ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে।
১৯. প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা (Free Media): প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে সুষ্ঠু জনমত গড়ে ওঠে না। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে সফল করতে হলে, সুশাসনের পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে তাই প্রচার মাধ্যম হবে স্বাধীন ও সরকারের অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত।
২০. মুক্ত এবং বহুত্বভিত্তিক সমাজ (Free and Plural Society): সমাজের গঠন কাঠামো যদি স্বাধীন ও মুক্ত হয় এবং এর প্রকৃতি যদি বহুত্বভিত্তিক হয় তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়। কৃত্রিমভাবে সমাজ নির্মাণ বা সমাজ কাঠামোতে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করে।
পরিশেষঃ পরিশেষে উল্লেখ্য, ‘সুশাসন’ ধারণাটি বিশ্ব ব্যাংকের উদ্ভাবিত একটি ধারণা। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ব ব্যাংকের এক সমীক্ষায় সর্বপ্রথম ‘সুশাসন’ (Good Governance) প্রত্যয়টি ব্যবহার করা হয়। এতে উন্নয়নশীল দেশের অনুন্নয়ন চিহ্নিত করা হয় এবং বলা হয় যে, সুশাসনের অভাবেই এরূপ অনুন্নয়ন ঘটেছে।
Leave a comment