উপস্থাপনাঃ উচ্চাভিলাষী যুদ্ধপ্রিয় সুলতান মাহমুদ তার ৩২ বছরের রাজত্বকালে ভারতে ১৭ বার অভিযান পরিচালনা করেন এবং প্রতিটি অভিযানেই তিনি বিস্ময়করভাবে বিজয় লাভ করেন। ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ তার সম্পর্কে মন্তব্য করেন- To the Musalmans of his days, he was a gahi who tried to extirpate infidelity in heathen lands.
সুলতান মাহমুদের অভিযানসমূহঃ
১. সীমান্তবর্তী দুর্গ দখলঃ সুলতান মাহমুদ খাইবার গিরিপথের সীমান্তের লামদান ও পেশােয়ারের ম্যধবর্তী অনেকগুলাে দুর্গ অধিকার করে তার রাজ্যসীমা সুরক্ষিত করেন। ১০০০ খ্রিস্টাব্দের এ অভিযানই ছিল উপমহাদেশে মাহমুদের সর্বপ্রথম অভিযান।
২. জয় পালের বিরুদ্ধে অভিযানঃ ১০০১ খ্রিস্টাব্দে পেশােয়ারের নিকট সংঘটিত যুদ্ধে মাহমুদ জয় পালকে পরাজিত করে পুত্র পৌত্রসহ বন্দি করেন। পরে কতিপয় শর্তে মাহমুদ তাকে মুক্তি দেন। পরাজয়ের এ গ্লানি সহ্য করতে না পেরে জয় পাল স্বীয় পুত্র আনন্দ পালকে সিংহাসনে বসিয়ে অগ্নিতে আত্মাহুতি দেন।
৩. ভীরা অভিযানঃ ১০০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ ঝিলাম নদীর তীরবর্তী ভীরা রাজ্যে তার তৃতীয় অভিযান পরিচালনা করে তথাকার নরপতি বিজয় রায়কে পরাজিত করেন। অবশেষে রাজা বিজয় রায় ভয়ে আত্মাহুতি দিলে তিনি ভীরা দুর্গ দখল করেন।
৪. মুলতান অভিযানঃ ১০০৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ মুলতানের শিয়া শাসক আবুল ফাতেহ দাউদের বিরুদ্ধে তার চতুর্থ অভিযান পরিচালনা করেন। তার আগমনের সংবাদ শুনে আবুল ফাতেহ দাউদ রাজ্য ছেড়ে পলায়ন করলে মুলতান তার করতলগত হয়।
৫. নওয়াজ শাহ-এর বিরুদ্ধে অভিযানঃ মুলতানের শাসনকর্তা সুখপাল ইসলামে দীক্ষিত হয়ে নওয়াজ শাহ নাম ধারণ করেন। সুলতান মাহমুদ এবং ইলাক খানের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলার সুযােগে স্বার্থান্বেষী সুখ পাল ইসলাম ত্যাগ করলে মাহমুদ ১০০৭ খ্রিস্টাব্দে তাকে পরাজিত করে ৪০,০০০ দিরহাম আদায় করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। ফলে পরবর্তীতে আর কেউ এরূপ প্রতারণা করার সাহস পায়নি।
৬. আনন্দ পালের বিরুদ্ধে অভিযানঃ সুলতান মাহমুদের আক্রমণে ভীত হয়ে পাঞ্জাবের রাজা আনন্দ পাল মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিরাট ঐক্যজোট গঠন করে। সুলতান মাহমুদ ১০০৮ খ্রিস্টাব্দে তার বিরুদ্ধে ষষ্ঠ অভিযান পরিচালনা করে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তার বাহিনীকে পরাস্ত করে রাজধানী ‘উদ’ অধিকার করেন।
৭. নগরকোট অধিকারঃ ১০০৯ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ সপ্তম অভিযান পরিচালনা করে কাংড়া পাহাড়ের নিকটবর্তী নগরকোট দুর্গ অধিকার করেন। ঐতিহাসিক ফিরিশতার মতে, নগরকোট দুর্গ অধিকার করে মাহমুদ বিপুল পরিমাণ সােনা রূপা ও অন্যান্য সম্পদ লাভ করেন। যেমন ৭০০০০০ স্বর্ণমুদ্রা, ৭০০ মণ স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত তৈজষপত্র, ২০০ মণ খাঁটি সােনা, ২০০ মণ অপরিশােধিত রূপা এবং ২০ মণ বিভিন্ন ধরনের রত্নাদি।
৮. দাউদের বিরুদ্ধে অভিযানঃ ১০১০ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ মুলতানের বিদ্রোহী শাসনকর্তা দাউদকে পরাজিত করে তাকে ঘােরের দুর্গে অবরােধ করেন।
৯. ত্রিলােচন পালের বিরুদ্ধে অভিযানঃ আনন্দ পালের পুত্র ত্রিলােচন পাল মাহমুদের বিরুদ্ধে সমর প্রস্তুতি নিলে মাহমুদ ১০১৪ খ্রিস্টাব্দে নবম অভিযান পরিচালনা করে তাকে পরাজিত করেন। এ অভিযানে বিজয় লাভের ফলে ত্রিলােচন পালের রাজধানী নন্দনাসহ সমগ্র পাঞ্জাব সুলতান মাহমুদের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।
১০. থানেশ্বর বিজয়ঃ ১০১৪ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ হিন্দু ধর্মের পবিত্র স্থান বলে কথিত থানেশ্বরে দশম অভিযান পরিচালনা করে সফলতা অর্জন করেন। ফলে হিন্দু রাজা তার বশ্যতা স্বীকার করে। অসংখ্য ধনসম্পদসহ থানেশ্বর দুর্গটি তার হস্তগত হয়।
১১. কাশ্মীর অভিযানঃ সুলতান মাহমুদ ১০১৫ থেকে ১০১৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দু’বার কাশীর অধিকারের প্রচেষ্টা চালান, কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তার এ প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
১২. মথুরা ও কনৌজ অভিযানঃ সুলতান মাহমুদ ১০১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিহার সাম্রাজ্যের রাজধানী কনৌজে অভিযান পরিচালনা করেন। পথিমধ্যে তিনি মথুরা ও বৃন্দাবন জয় করেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ কনৌজে উপনীত হলে প্রতিহার রাজা রাজ্যপাল বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করে। ফলে হর্ষবর্ধনের স্মৃতি বিজড়িত রাজধানী কনৌজ তার হস্তগত হয়।
১৩. চান্দেলা রাজার বিরুদ্ধে অভিযানঃ কনৌজের আশ্রিত রাজাকে হত্যার প্রতিশােধ নেয়ার জন্য মাহমুদ ১০১৯ খ্রিস্টাব্দে চান্দেলা রাজার বিরুদ্ধে এয়ােদশ অভিযান পরিচালনা করেন। চান্দেলা রাজা মাহমুদের বাহিনীকে প্রতিরােধে অক্ষম হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে। মাহমুদ বিজয়ী বেশে চান্দেলা রাজ্যের রাজধানী দখল করেন।
১৪. গােয়ালিয়র অভিযানঃ ১০২১-২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাহমুদ সীমান্ত অঞ্চল সােয়াত, রাজাধর এবং ওয়াযিরিস্তানের বিদ্রোহী উপজাতিদের দমন করে গােয়ালিয়রে তার চতুর্দশ অভিযান পরিচালনা করেন। গােয়ালিয়রের হিন্দু রাজা তার আনুগত্য স্বীকার করে বার্ষিক কর প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।
১৫. কালিঞ্জর বিজয়ঃ ১০২২-২৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ কালিঞ্জরে তার পঞ্চদশ অভিযান পরিচালনা করেন। সুলতান দুর্ভেদ্য কালিঞ্জর দুর্গ দখল করলে হিন্দু রাজা গােণ্ডা, আত্মসমর্পণ করে সুলতানের উদ্দেশ্যে হিন্দি ভাষায় এক প্রশস্তি কাব্য রচনা করেন। সুলতান এতে প্রীত হয়ে বার্ষিক কর প্রদানের শর্তে গােণ্ডাকে কালিঞ্জরের দায়িত্ব ফিরিয়ে দেন।
১৬. সােমনাথ বিজয়ঃ সােমনাথ অভিযান ইতিহাসের অন্যতম দুঃসাহসিক সামরিক অভিযান। ১০২৫ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ এ অভিযানে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে বিভিন্ন রাজাকে পরাজিত করে দীর্ঘপথ অতিক্রমের পর ১০২৬ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ সােমনাথে। উপস্থিত হন। হিন্দুরা প্রবল বাধা প্রদান করেও পরাজিত হয়। সােমনাথ মন্দির থেকে মাহমুদ দু’কোটি স্বর্ণ মুদ্রা এবং প্রচুর অলঙ্কার হস্তগত করেন। ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন- The victory of Somnath added fresh laurel to Mahmud’s brow. অর্থাৎ, সােমনাথ বিজয় মাহমুদের ললাটে নতুন বিজয় গৌরব সংযুক্ত করে।
১৭. জাঠদের পরাজয়ঃ জাঠদের উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে মাহমুদ ১০২৭ খিস্টাব্দে জাঠদের বিরুদ্ধে চৌদ্দশ নৌকার বিশাল বহর নিয়ে সর্বশেষ অভিযান পরিচালনা করেন। এ দুঃসাহসিক অভিযানে মাহমুদ তাদের পরাজিত করেন এবং অধিকাংশকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
উপসংহারঃ সুলতান মাহমুদ বিরতিহীনভাবে ১৭ বার ভারত অভিযান পরিচালনা করে প্রতিবারই বিজয় অর্জন করেন। তার এ বিজয়ের মাধ্যমে পরবর্তীকালে উপমহাদেশে স্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়। এজন্য ঐতিহাসিক গীবন মাহমুদকে Undoubtedly one of the greatest kings of the world বলে অভিহিত করেছেন।
Leave a comment