অথবা, সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের উদ্দেশ্যসমূহ আলােচনা কর।
উপস্থাপনাঃ ভারতবর্ষে মুসলমানদের সামরিক অভিযানগুলাে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিন্ধু বিজয়ের আড়াই’শ বছর পরে ইসলামে নবদীক্ষিত তুর্কিরা সর্বপ্রথম নতুন উৎসাহ উদ্দীপনায় ভারতবর্ষে সমরাভিযান পরিচালনা করে। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন গজনীর সুলতান মাহমুদ। তিনি ১০০০-১০২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মােট ১৭ বার ভারতে অভিযান পরিচালনা করেন এবং প্রতিবারই বিজয়ী হন। এজন্য ঐতিহাসিক উইলস হেগ বলেন, Mahmud is one of the most prominent figures in the History of Islam.
মাহমুদের ভারত অভিযানের উদ্দেশ্যসমূহঃ
১, সামরিক উদ্দেশ্যঃ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল ছাড়াও সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানে সামরিক উদ্দেশ্য ছিল। নিজ রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য তার উত্তর পশ্চিমে সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব ও সিন্ধু দখল করা অত্যন্ত প্রয়ােজন ছিল। এ সকল অঞ্চল ছিল সামরিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য বার বার ভারত আক্রমণ করে তার সামরিক উদ্দেশ্য হাসিল করেছিলেন। ঐতিহাসিক ফিরিশতা বলেন, “নিজ সামরিক শক্তি আরাে শক্তিশালী ও সুসংহত করা এবং ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের পথ সুপ্রশস্ত করা সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণের উদ্দেশ্য মনে করা হয়।”
২. ধর্মীয় উদ্দেশ্যঃ কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক মনে করেন, মাহমুদের ভারত অভিযানের পেছনে মূলত ধর্মীয় উদ্দেশ্য ও কার্যফল ছিল। এর কারণ হলাে-
ক. মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযানঃ সুলতান মাহমুদ শুধু হিন্দুদের বিরুদ্ধেই অভিযান পরিচালনা করেননি; বরং স্বীয় নিরাপত্তার জন্য তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধারণ করেন। কারণ ভারতের অনেক মুসলমান আনন্দ পালের সাথে মাহমুদ বিরােধী জোটে যােগদান করেন। ড. নাজিম বলেন, বিজেতার ক্রোধ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক ছলনার আশ্রয় নিয়ে কোনাে কোনাে হিন্দু রাজা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
খ. গৌরব ও স্বর্ণলাভঃ ঐতিহাসিক হাবীবুল্লাহর ভাষায়, সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান কখনােই ধর্মযুদ্ধ ছিল না; বরং গৌরব ও স্বর্ণলাভের যুদ্ধ ছিল।
গ. মূর্তি ধ্বংসের অভিযােগ নিরর্থকঃ মূর্তি ধ্বংসকারী হিসেবে মাহমুদকে যে অপবাদ দেয়া হয়েছে তা ঠিক নয়। কারণ ইচ্ছা করে শান্তির সময় তিনি কোনাে মূর্তি ধ্বংস করেননি। অধিকন্তু যুদ্ধের পর তিনি মন্দির পুনঃ সংস্কারের নির্দেশও দিয়েছিলেন।
৩. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যঃ মাহমুদের ভারতবর্ষ অভিযান প্রসঙ্গে ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিম্নরূপ-
ক. পিতার ইচ্ছাপূরণঃ সুলতান মাহমুদের পিতা সবুক্তগীনের পাঞ্জাবে হিন্দ শাহী রাজা জয়পালের সাথে বিরােধ চলে আসছিল। কেননা জয়পাল মুসলিম সম্প্রসারণে বহু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সুতরাং পিতার রাজত্বকালে উদ্ভূত সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান না হওয়ায় মাহমুদ পিতার ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে পাঞ্জাব ও মুলতান স্বীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে শক্তিশালী গজনী সাম্রাজ্য গঠন করেন।
খ. তুর্কি পারস্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাঃ সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের প্রধান সংকল্প ছিল একটি তুর্কি পারস্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। এ সংকল্প বাস্তবায়নের জন্য তিনি অভিযান পরিচালনা করেন।
গ. দ্বৈত মতবাদঃ ঐতিহাসিক স্মিথ মনে করেন, “মাহমুদ ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে বহিরাগত নৃপতি।” তিনি আরাে বলেন, মাহমুদ একজন উচুদরের দস্যু ছিলেন, যিনি অসীম ক্ষমতাবলে হিন্দু রাজাদের অপূরণীয় ক্ষতি করেন। ঐতিহাসিক হেগ বলেন, মাহমুদকে সংকীর্ণ অর্থে ভারতবর্ষের নৃপতি বলা যায়।
ঘ. বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশােধ গ্রহণঃ ঐতিহাসিক বেণী প্রসাদ বলেন, মাহমুদ বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশােধ গ্রহণের জন্য ভারতে অভিযান পরিচালনা করেন। হিন্দু রাজন্যবর্গের কর্তব্যে অবহেলা, সন্ধির শর্ত ভঙ্গ, সুলতানের আনুগত্য অস্বীকার ইত্যাদি কারণেও তিনি যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন।
ঙ. রাজনৈতিক প্রয়ােজনঃ ঐতিহাসিক ফিরিশতা বলেন, রাজনৈতিক প্রয়ােজনে এবং প্রাচ্যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় মাহমুদ ভারতে অভিযান পরিচালনা করেন।
৪. অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যঃ
ক. সেনাবাহিনী পােষণঃ সুলতান মাহমুদের একটি দক্ষ সেনাবাহিনী পােষণ এবং মধ্য এশিয়ার শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান প্রভৃতি খাতে ব্যয়ের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়ােজন ছিল। অর্থের প্রয়ােজনে সুলতান মাহমুদ ভারত অভিযান করেন।
খ, আকর্ষণীয় নগরী প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ঃ সুলতান মাহমুদ রাজধানী গজনীকে মনের মতাে করে সাজাতে চেয়েছিলেন। এর জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়ােজন দেখা দেয়। গজনীর রাষ্ট্রীয় কোষাগার অর্থের চাহিদার যােগান দিতে পরত না। তখন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কোষাগার ধনরত্নে পূর্ণ ছিল। তাই ভারত থেকে অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনা করে ভারত আক্রমণ করেন। প্রফেসর হাবীব, নাজিমসহ কতিপয় ঐতিহাসিক সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক কারণকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই বলে সুলতানকে লুণ্ঠনকারী বা অর্থলােলুপ তস্কর বলা যাবে না। কেননা তিনি ভারত থেকে সংগৃহীত অর্থ মানবকল্যাণে ব্যয় করেন। নিজের ভােগবিলাসের জন্য তিনি সে অর্থ ব্যয় করেননি।
গ. জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপােষকঃ জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপােষকতার মহৎ উদ্দেশ্যে মাহমুদ ভারত আক্রমণ করেন। কেননা জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্পকলার জন্য ভারত ছিল সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ।
ঘ, সীমান্ত বিরােধঃ সুলতান মাহমুদের রাজ্যসীমা ভারত সীমান্তের সাথে থাকায় সীমান্ত বিরােধের জের ধরে ভারতের সাথে স্বাধীন ব্যবসায় বাণিজ্যে বিঘ্ন হয়। এ বিরােধের জের হিসেবেই মাহমুদ কর্তৃক ভারতে অভিযান পরিচালিত হয়।
মাহমুদের ভারত আক্রমণের ফলাফলঃ
১. রাজনৈতিক ফলাফলঃ
ক. মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হয়ঃ সুলতান মাহমুদের ১৭ বার অভিযানের মাধ্যমে ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হয়। মাহমুদই সর্বপ্রথম বিজেতা, যিনি খাইবার গিরিপথ দিয়ে ভারতে আসেন। পরবর্তীকালে সে পথ ধরেই মুহাম্মদ ঘুরী ভারতে আসার সুযােগ লাভ করেন।
খ. মাহমুদের মর্যাদা বৃদ্ধিঃ ভারত অভিযান মাহমুদকে সীমিত অর্থে হলেও ভারতের নরপতি হিসেবে মর্যাদা দান করে। এ কথার সাথে একমত পােষণ করে ড. আর. সি. মজুমদার বলেন- His military life is a record of unbroken success.
গ. হিন্দুদের প্রতিপত্তি হ্রাসঃ বার বার পরাজয় বরণ করে হিন্দু রাজন্যবর্গের মধ্যে চরম অনৈক্য ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সােমনাথ মন্দিরের পতনের মাধ্যমে হিন্দুদের হতাবশিষ্ট মনােবলটুকু হ্রাস পায়।
ঘ. পাঞ্জাবে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাঃ পাঞ্জাব থেকে হিন্দুদের বিতাড়িত করে মাহমুদ শুধু গজনী রাজ্যভুক্তই করেননি; বরং এর রাজনৈতিক তাৎপর্যও ছিল অর্থবহ এবং সুদূরপ্রসারী। এ প্রসঙ্গে আর. সি. মজুমদার বলেন-‘The Ghazngvid Occupation of Punjab serves as the key to unlock the gates of Indian interior.
২. অর্থনৈতিক ফলাফলঃ মাহমুদ ভারত আক্রমণ করে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত ধন সম্পদ ও ঐশ্বর্য লাভ করেন। ভারত থেকে আহরিত এসব ধন সম্পদ মাহমুদকে যুদ্ধ ও শান্তিকালীন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আর্থিক সহায়তা দান করে।
৩. ধর্মীয় ফলাফলঃ
ক. ইসলাম প্রচারঃ মাহমুদের ভারত আক্রমণের ফলে বহু ইসলাম প্রচারক ও অলী আউলিয়া এদেশে আগমন করে ইসলামের সুমহান বাণী ছড়িয়ে দেন। তাদের আত্মত্যাগ ও প্রচারের ফলে এ দেশের বহু বিধর্মী ইসলাম গ্রহণ করে।
খ. মুসলিম তাহযীব তমুদুনের প্রভাবঃ ঐতিহাসিক আল বেরুনী বলেন, সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের ফলে উপমহাদেশে স্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলেও মুসলিম তাহযীব তমদুনের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টি করে।
৪. সামরিক ফলাফলঃ
ক, ভারতীয় সামরিক শক্তির দুর্বলতা প্রকাশঃ মাহমুদের ভারত আক্রমণের ফলে এদেশের হিন্দু সেনাবাহিনীর সামরিক দুর্বলতা মুসলমানদের নিকট প্রকাশ পায় এবং মুসলমানদের সামরিক কলাকৌশল ও ব্যবস্থাপনার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়।
খ. প্রশাসনিক প্রাধান্যঃ ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, মাহমুদের ভারত আক্রমণের মাধ্যমে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রাধান্য সূচিত হয়। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরবর্তীতে মুহাম্মদ ঘুরী ভারতে অভিযান চালিয়ে স্থায়ীভাবে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
৫. সাংস্কৃতিক ফলাফলঃ মাহমুদের বিজয়াভিযানের মাধ্যমে বিজিত হিন্দু ও বিজেতা মুসলমানদের সভ্যতা সংস্কৃতি পরস্পরের সান্নিধ্যে আসার সুযােগ পায়। ফলে উভয় সভ্যতা সংস্কৃতির ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা হয়। ঐতিহাসিক হেগ বলেন- He was the first to carry the banner of Islam into the heart of India.
উপসংহারঃ ভারত উপমহাদেশে সুলতান মাহমুদের অভিযানের গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি ১৭ বার ভারতবর্ষে সামরিক অভিযান পরিচালনা এবং প্রতিটি অভিযানেই সফলতা লাভ করে এক অক্ষয় কীর্তি রেখে গেছেন। এসব অভিযানের উদ্দেশ্য ও ফলাফল ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। তাই স্মিথ বলেন- The dnnexction constitutes the sole claim of Mahmud to be counted as an Indian sovereign.
Leave a comment