সুলতান মামুদের সাথে মহম্মদ ঘুরির তুলনা:

মুইজউদ্দিন-মহম্মদ-বিন্-সাম ওরফে মহম্মদ ঘুরিকে ভারতে তুর্কি শাসনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকার করার ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের কোনো দ্বিধা নেই। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গিয়াসউদ্দিনের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বার বার ভারত অভিযান করেন এবং ব্যর্থতা সত্ত্বেও নিজ লক্ষ্যে অবিচল থেকে নিষ্ঠা ও কর্মোদ্যোগের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। স্বাধীনভাবে সমগ্র ঘুররাজ্য শাসনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি অনুগত থেকে তিনি ভ্রাতৃপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যা মধ্যযুগের ইতিহাসে ছিল খুবই বিরল।

কিন্তু মহম্মদ ঘুরির কৃতিত্ববিচার করতে গিয়ে তাঁর পূর্ববর্তী আক্রমণকারী সুলতান মামুদের সাথে তুলনামূলক আলোচনা অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে। একথা ঠিক যে, এরা দুজনে ভিন্ন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ করেছিলেন। এমনকি দুজনের ভারত অভিযানের রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্যও পুরোপুরি এক ছিল না। তথাপি এই দুই আক্রমণকারী যোদ্ধাকে পাশাপাশি রেখে আলোচনা করার মূল কারণ সম্ভবত কয়েকটি ক্ষেত্রে দুজনের আপাত সাদৃশ্য। যেমন, দুজনেই ছিলেন বহিরাগত মুসলমান এবং ভারতের বিরুদ্ধে বহু আক্রমণ, হত্যা ও লুণ্ঠনের নায়ক। দুজনেই মধ্য-এশিয়ার রাজনৈতিক শক্তির কেন্দ্র থেকে ভারতের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়েছিলেন ইত্যাদি। কিন্তু অভিযানের লক্ষ্য এবং অর্জিত সাফল্যের নিরিখে মহম্মদ ঘুরি ও সুলতান মামুদের কৃতিত্বের ধার ও ভার এক নয়।

এই দুই যোদ্ধার তুলনামূলক বিচার করতে গিয়ে ঐতিহাসিকেরাও দ্বিমত পোষণ করেছেন। স্ট্যান্‌লি লেনপুল সুলতান মামুদকে মহম্মদ ঘুরির তুলনায় অনেক বেশি সফল ও প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করেন। তিনি লিখেছেন: “As compared with Mahmud, Muhammad is an obscure figure.” বস্তুত, সমরকুশলী যোদ্ধা ও সমরবিজয়ী সেনাপতি হিসেবে সুলতান মামুদ মহম্মদ ঘুরির তুলনায় অনেক বেশি অগ্রণী ছিলেন। তিনি গ্রীষ্মকালে মধ্য-এশিয়ায় যুদ্ধবিজয় সেরে শীতকালে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ভারতের বিরুদ্ধে। এইভাবে একবার ভারতে এবং একবার মধ্য-এশিয়ার রণাঙ্গনে সাফল্যের সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। দেশে বা বিদেশে কোথাও যুদ্ধ-পরাজয়ের গ্লানি তাঁকে ভোগ করতে হয়নি। তাই সৈয়দ জাফর (S. A. Jaffar) লিখেছেন: “Mahmud Ghazni was verily endowed with a genius of war. He was a scientific general, skillful in planning and through in execution.” পক্ষান্তরে মহম্মদ ঘুরি ছিলেন একজন সাধারণ সমরনায়ক। যুদ্ধকে তিনি ভয় করতেন না, দৃঢ় মনোবলেরও অভাব ছিল না; কিন্তু সামরিক প্রতিভা তাঁর ছিল না। সুলতান মামুদের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে ধারাবাহিক সাফল্য তিনি পাননি। ভারতে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে তিনি পরাজিত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন, যার মধ্যে পৃথ্বীরাজের বিরুদ্ধে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে এবং গুজরাটের ভীমদেবের বিরুদ্ধে অহিলবারের যুদ্ধে মামুদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বিশাল।

অধ্যাপক হাবিবের ভাষায় তিনি ছিলেন “Hero of three stupendous defeats — Ankhud, Tarain and Anhillwara, ” তবে কয়েকটি যুদ্ধে ঘুরি পরাজিত হয়েছিলেন এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে, প্রকৃত যোদ্ধার মতোই তিনি পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে পরবর্তী অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। এটাও কম কৃতিত্বের নয়। তা ছাড়া মনে রাখা দরকার যে, মামুদের তুলনায় মহম্মদ ঘুরিকে ভারতে অনেক বেশি বড়ো ও সুসংগঠিত রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল।

যোদ্ধা বা সেনাপতি হিসেবে পিছিয়ে পড়লেও, রাজনীতিবিদ ও সংগঠক হিসেবে মহম্মদ ঘুরি সুলতান মামুদকে অতিক্রম করে যেতে পেরেছেন। ঘুরি ও মামুদের ভারত-অভিযানের প্রকৃতিগত স্বাতন্ত্র্য খুবই স্পষ্ট। সুলতান মামুদের ভারত-আক্রমণের মূল প্রেরণা ছিল এদেশের অতুল সম্পদ। এই সম্পদ লুণ্ঠনের আশায় তিনি অনুগামীদের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনার সৃষ্টি করেছেন। ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের কোনো ইচ্ছাই তাঁর ছিল না। কারণ মধ্য-এশিয়ার সাথে ছিল তাঁর রক্তের বন্ধন। ভারতবর্ষের সম্পদকে তিনি মধ্য-এশীয় রাজনীতির সংগ্রামে ব্যবহার করার লক্ষ্যে স্থির ছিলেন। তাই ঈশ্বরীপ্রসাদ লিখেছেনঃ “তিনি ঘূর্ণিঝড়ের মতো ভারতে এসেছেন এবং প্রচুর সম্পদ সংগ্রহ করে সত্বর নিজরাজ্যে ফিরে গেছেন।” অর্থলোভে অন্ধ এই যোদ্ধা ভারতের মাটিতে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গৌরব অর্জনের কোনো স্বপ্ন দেখতে পারেননি। কিন্তু মহম্মদ ঘুরি ছিলেন রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অধিকারী। ভারতের সম্পদ নয়; ভারতের মাটিতে নতুন রাজ্যের ভিত্তি স্থাপনই ছিল তাঁর লক্ষ্য। ঈশ্বরীপ্রসাদের ভাষায়: “Not so fanatical as Mahmud, Muhammad was certainly more political than his great predecessor. He saw clearly the rotten political condition of India and made up his mind to found a permanent dominion.”

স্বরাজ্য থেকে দূরবর্তী ভূখণ্ডে নতুন শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি রচনার জন্য যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রয়োজন, মহম্মদ ঘুরির চরিত্রে তার অভাব ছিল না। অধ্যাপক নিজামী (K. A. Nizami) লিখেছেন : “The two striking feature of Muizzuddin’s character were his dogged tenacity of purpose and his grim political realism.” যুদ্ধে পরাজয়ের পরেও যেমন তিনি যুদ্ধপ্রেরণা হারিয়ে ফেলেননি, তেমনি ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করার পরেই সেখানে তৎক্ষণাৎ নিজের শাসন শুরু করেননি। কারণ তখন ভারতীয় ভাষার সাথে পরিচিত তুর্কি-মুসলমানের সংখ্যা ছিল খুবই কম। পাঞ্জাব থেকে বাংলা পর্যন্ত এত বড়ো অঞ্চলের শাসন-দায়িত্ব প্রত্যক্ষভাবে পরিচালনা করা তাদের পক্ষে ছিল অসম্ভব। তাই যুদ্ধজয়ের পরে মহম্মদ ঘুরি ভারতীয় শক্তির প্রতি ধর্মীয় জিঘাংসামূলক আচরণ করেননি। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর পৃথ্বীরাজের বশ্যতার ভিত্তিতে দিল্লি ও আজমিরের শাসনভার খাণ্ডেরায় ও পৃথ্বীরাজের পুত্রের হাতে অর্পণ করেছিলেন। বশ্যতাস্বীকার করার পরে হিন্দু সর্দারদের স্ব-স্ব পদে এবং সম্মানের সাথে তিনি বহাল রাখেন। ঘুরি নিশ্চিত ছিলেন যে, গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে এবং প্রদেশ ও জেলার শাসকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে স্থানীয় শাসকদের হাতে শাসন-দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। তাঁর এই চিন্তা রাষ্ট্রপ্রজ্ঞার নিদর্শন। হাসান নিজামী, ইবন-ই-অসির-এর বিবরণ থেকে তাঁর এই প্রশাসনিক আপস নীতির বিবরণ পাওয়া যায়।

মহম্মদ ঘুরি ছিলেন মানব-চরিত্রের দক্ষ বিচারক। যোগ্য ও প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিকে চিনে নিতে তিনি ভুল করতেন না। এইভাবেই কুতুবউদ্দিন আইবক, তাজউদ্দিন ইলদিজ, বাহাউদ্দিন তুথ্রিল, ইতিয়ারউদ্দিন প্রমুখ সৈনিকদের সংগ্রহ করেছিলেন যাঁরা ভারতবর্ষে তুর্কি শাসনের ভিত্তি রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাই অধ্যাপক হবিবুল্লাহ যথার্থই বলেছেন যে : “If he (Ghuri) failed to found a dynasty, he yet trained up a bond of men who were to prove more loyal to his ideals and better bitted to maintain his empire.”

সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সুলতান মামুদ ছিলেন অনন্য কৃতিত্বের অধিকারী। আলবেরুণী, উতবি, ফিরদৌসী, আনসারী প্রমুখের মতো জ্ঞানীগুণী পণ্ডিত-দার্শনিক গজনির রাজসভা উজ্জ্বল করেছিলেন। সংগৃহীত অর্থে মামুদ গজনিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে আন্তরিক শিক্ষানুরাগের পরিচয় স্থাপন করেছেন। লেপুল লিখেছেন: “নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বিজিত রাজ্য থেকে শিল্পকর্ম এনে নিজ রাজধানীকে সুসজ্জিত করেছিলেন; কিন্তু সুলতান মামুদ বিদেশ থেকে শিল্পী ও কবিদের আমন্ত্রণ করে এনে নিজ রাজসভাকে উজ্জ্বলতর করেছিলেন।”তাই লেপুল মনে করেন, “শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী হিসেবে সুলতান মামুদের তুলনায় মহম্মদ ঘুরি ছিলেন নগণ্য।” কিন্তু ঐতিহাসিক নিজামী এই বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারেননি। তাঁর মতে, মহম্মদ ঘুরি হয়তো সুলতান মামুদের মতো শিল্পানুরাগের স্বাক্ষর সে. পারেননি; কিন্তু তিনি আদৌ সংস্কৃতিমনস্ক ছিলেন না—একথা বলা যায় না। নিজামীর মতে, গিয়াসউদ্দিন ও মহম্মদ ঘুরির আমলেই ঘুর সংস্কৃতির ধারা নব-রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ঘুরির পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলানা ফকরুদ্দিন রাজি, নিজাম ঊরুজী প্রমুখ পণ্ডিত ঘুররাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ধর্মশিক্ষার প্রসার ঘটান। মহম্মদের আমলেই একধরনের রঙিন টালি (glazed tile) আবিষ্কৃত হয়েছিল। যে রহস্যবাদী সংস্কারকের দল মুসলিম সমাজে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সহনশীলতার ফল্গুধারা প্রবাহিত করেছিলেন, তাঁরা মহম্মদ ঘুরির আমলেই লালিত হয়েছিলেন গজনি ও হিরাটের মাটিতে। সুলতান মামুদ গজনিকে শিল্পসমৃদ্ধ করলেও ভারতের শিল্প-নিদর্শনের ওপর যে তাণ্ডব চালিয়েছিলেন, মহম্মদ ঘুরি তা কখনোই করেননি। অবশ্য এটা ঠিক যে, শিল্পসংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য মহম্মদ ঘুরি মামুদের কতো আন্তরিকভাবে সময় ও উদ্যোগ ব্যয়িত করেননি। সম্ভবত সে সুযোগ ও সময় তাঁর ছিল না।