প্রশ্নঃ সুলতানী আমলের বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

অথবা, মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম শাসকদের অবদান আলোচনা কর।

অথবা, “সুলতানী আমল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের স্বর্ণযুগ” – আলোচনা কর। 

ভূমিকাঃ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভাবন, বিকাশ ও পরিণতির বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করতে গিয়ে ঐতিহাসিকগণ সমগ্র সময়কে প্রাচীন যুগ (৬৫০-১২০০ খ্রিঃ), মধ্যযুগ (১২০১–১৮০০ খ্রিঃ) ও আধুনিক যুগ (১৮০০- বর্তমান) এ তিনটি অধ্যায়ে ভাগ করেছেন। ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা দখলের মধ্য দিয়ে মধ্যযুগের সূচনা (১২০৪)। মধ্যযুগকে দুভাগে ভাগ করা যায়— খিলজি আমল এবং সুলতানী আমল।

খিলজি আমলঃ খিলজি আমল ১২০৪ থেকে ১৩৪১ পর্যন্ত। খিলজি আমলের প্রথম শাসক ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি। ১২২৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলা দিল্লির অধীনে চলে যায়। মুসলমানদের বাংলা অধিকারের সময় স্বাভাবিকভাবে বেশ কিছুদিন ধরে হত্যা, লুণ্ঠন, ক্ষমতা বদল ইত্যাদি কারণে অস্থির ঘূর্ণিঝড়ের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত হয়। সদ্য আগত মুসলমানদের ভয়ে এদেশের হিন্দু ও বৌদ্ধ জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ফলে সাহিত্য সৃষ্টিতে বাধা আসে এবং গতি মন্থর হয়। তাই প্রায় দেড়শ বছর ধরে সময়টিকে অনেকেই অন্ধকার যুগ বলে থাকেন।

সুলতানী আমলঃ ১৩৪২ সালে ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলার ইতিহাসে শুরু হয় সুলতানী আমল এবং ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুলতানী আমল বিস্তৃত। সুলতানী আমলকে বাংলা ভাষা-সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলে। কেননা সুলতানী আমলই বাংলার স্বাধীন শাসকদের আমল। এ আমলে সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় গৌড়ের শাহী দরবার বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। গৌড় দরবারকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য সর্বৈব সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। ড. দীনেশচন্দ্র সেন সুলতানী আমলকে ‘গৌড়ীয় যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন। ইসলাম ধর্মের প্রগতিশীলতার কারণে সুলতানী আমলেই মূলত বাংলায় ইসলামের সম্প্রসারণ এবং সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটে সংস্কৃত ভাষার বদলে ফারসি ভাষা প্রাধান্য পায়। ব্রাহ্মণদের অহমিকা ঘুচে যায়, কেননা মুসলমানদের কাছে ব্রাহ্মণ-শূদ্র এক ও অভিন্ন। ব্রাহ্মণ কর্তৃক নির্যাতিত বৌদ্ধ ও শূদ্ররা মুসলমানদের বর্ণবৈষম্যহীন মানবিক চরিত্রে প্রীত হয়ে ইসলামে আকৃষ্ট হয়। সাহিত্যেও বর্ণবাদু লোপ পায় এবং গোটা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়। মুক্তি ঘটে হিন্দু রক্ষণশীলতার। উদার মানবতাবাদী বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার প্রসারের সুযোগ পায়। বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে সংস্কৃত, ফারসি, হিন্দি সকল সাহিত্য অবাধে প্রবেশের পথ পায়। প্রাণস্পন্দন ফিরে পায় বাংলা সাহিত্য। সুলতানী আমলে অনুবাদ, মঙ্গলকাব্য, চরিত সাহিত্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, পদাবলী, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান অর্থাৎ সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার চর্চা-চর্যায় বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। আর এক্ষেত্রে বিভিন্ন সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ অবদান অনস্বীকার্য।

সুলতানী আমলে যে সকল সুলতান, শাসক বা তাদের সহযোগী ব্যক্তিত্বের পৃষ্ঠপোষকতায় যে সমস্ত কবি বা পণ্ডিত যে যে কাব্য রচনা করেন তা নিম্নরূপ—

সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহঃ মধ্যযুগের প্রথম মুসলমান কবি শাহ মুহম্মদ সগীর সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ইউসুফ-জুলেখা’ নামে অমর কাব্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।

জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহঃ বাংলার শাসক গণেশের পুত্র যদু। সুলতানদের প্রীতিধন্য হয়ে যদু জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহ নাম ধারণ করে গৌড়ের মসনদে সুলতান হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। সর্বজনবিদিত কৃত্তিবাস ওঝা সুলতান জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘রামায়ণ’ অনুবাদ করে সবার প্রীতিধন্য হন। ‘রামায়ণ’ অনুবাদের পর সুলতান প্ৰসন্ন হয়ে কবি কৃত্তিবাসকে পুষ্পমাল্যদানে সম্মানিত করেছেন।

সুলতান রুকনউদ্দিন বরবক শাহঃ ‘ভাগবত’ পুরাণের অনুবাদক হিসেবে খ্যাত কবি মালাধর বসু সুলতান রুকনউদ্দিন বরবক শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ নামক অনুবাদ কাব্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। কবির অনবদ্য কবিকীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ সুলতান কবিকে ‘গুণরাজ খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করে সম্মান প্রদর্শন করেছেন।

সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহঃ মধ্যযুগের বিখ্যাত মুসলমান কবি জৈনুদ্দিন সুলতান ইউসুফ শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় রচনা করেছেন ইসলামের ঐতিহ্যমূলক কাব্য ‘রসুলবিজয়’।

সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহঃ মধ্যযুগের যে স্বাধীন সুলতানী আমলকে সাহিত্য সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ বলা হয়, সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ সেই সুলতানী আমলের প্রতিষ্ঠাতা। হুসেন শাহ গৌড়ের সিংহাসনে হুসেন শাহ বংশের প্রতিষ্ঠার পর সব দিক দিয়ে বাংলায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। হুসেন শাহ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি ছিলেন গভীর অনুরক্ত। কবি যশোরাজ খানের ব্রজবুলি পদে তার আভাস পাওয়া যায় ৷ তিনি নিজে কবি বিজয়গুপ্তকে ‘মনসামঙ্গল’ এবং বিপ্রদাসকে ‘মনসাবিজয়’ এবং যশোরাজ খানকে ‘বৈষ্ণব পদ’ রচনায় পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তাছাড়া তাঁর সহযোগিতায় ও প্রভাবে তাঁরই সেনাপতি বাংলার শাসক পরাগল খাঁ এবং পরাগল খাঁর মৃত্যুর পর তার পুত্র ছুটি খাঁ যথাক্রমে কবীন্দ্র পরমেশ্বর এবং শ্রীকর নন্দী নামে দুই কবিকে মহাভারত রচনায় পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এই মহাভারত দুটি যথাক্রমে ‘পরাগলী মহাভারত’ ও ‘ছুটিখান মহাভারত’ নামে ইতিহাসে নন্দনীয়। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি হুসেন শাহের সীমাহীন প্রীতির কারণে এর সমৃদ্ধি সাধনে তাঁর প্রয়াস অনস্বীকার্য।

সুলতান নাসিরউদ্দিন নসরত শাহ্ঃ সুলতান হুসেন শাহের পুত্র নাসিরউদ্দিন নসরত শাহ। নসরত শাহের পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ। নসরত শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং ফিরোজ শাহের নির্দেশে কবি শ্রীধর কথক ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনা করেন। আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় আফজাল আলী রচনা করেন কিছু বৈষ্ণব পদ।

গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহঃ সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রীচৈতন্যের জীবনী অবলম্বনে কবি বৃন্দাবনদাস ‘চৈতন্যভাগবত’ কাব্য রচনা করেন। কবি লোচনদাসের হাতে ‘চৈতন্যমঙ্গল’ এ সময়েই রচিত।

উপসংহারঃ উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি সাধনে সুলতানী আমলের বিভিন্ন সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতার অবদান অনস্বীকার্য। তাদের এ ইতিবাচক ভূমিকার জন্য বিভিন্ন কবি তাদের প্রশংসা করেছেন। সুলতানদের প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনা ও বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগজনিত কারণে মধ্যযুগে স্বাধীন সুলতানী আমলে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা যে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে তাতে সুলতানী আমল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের স্বর্ণযুগ নির্মাণ করেছে।