ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিচর্চার ইতিহাস খুবই প্রাচীন। তবে পরম্পরাগত প্রযুক্তিচর্চা সমকালীন সমাজ ও অর্থনীতির বিকাশ ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে নিরূপিত হত। গুপ্তযুগে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে যে সকল মৌলিক গবেষণা ও আবিষ্কার ঘটেছিল, সেখানে জাগতিক রহস্য সম্পর্কে উৎসাহ ছিল চালিকা শক্তি। তবে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে উন্নত কৃষি-প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কাজে সীমিত সাফল্য দেখা যায়। হয়তো পূর্ব-পরিকল্পনা বা সুনির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা থেকে এই কাজ সম্পন্ন হয়নি। হতে পারে, আদিম মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের স্তরে ভোঁতা পাথরের অস্ত্র থেকে মানুষ যেমন মসৃণ বা অপেক্ষাকৃত ধারালো হাতিয়ার তৈরিতে সফল হয়েছিল, তেমনি কাঠের লাঙ্গলের পরিবর্তে লোহার ফলা বা হাত-কুঠারের ব্যবহার মানুষের করায়ত্ব হয়েছিল। যাই হোক, ভারতে মুসলমান যোদ্ধাদের প্রবেশ ও অবস্থানের পর একই সাথে বাস্তব প্রয়োজন ও ঐকান্তিক প্রয়াস প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ক্ষেত্র উজ্জ্বল করেছে। ভারতে মহম্মদ ঘুরির অভিযান ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সূত্রে ত্রয়োদশ শতকে কিছু প্রযুক্তি ভারতে প্রবেশ করে। পরবর্তীকালে (চতুর্দশ শতকের পরে) পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলি থেকেও প্রযুক্তিগত জ্ঞান ভারতে প্রবেশ করে।
সুলতানি যুগে কৃষিক্ষেত্রে জলসেচ দ্বারা উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। সেকালে মূলত কুয়ো বা নদী, পুকুর থেকে জমিতে জলসেচ দেওয়া হত। তবে ফিরোজ তুঘলক খাল খনন করে জলসেচের বিকল্প গড়ে তুলেছিলেন। কুয়ো বা পুকুর থেকে জলতোলার কাজে নোরিয়া অর্থাৎ সারিবদ্ধ বালতি লাগানো চক্র ব্যবহার করা হত। ডোঙাজাতীয় যন্ত্র দিয়েও জল তোলা হত। কেউ কেউ বলেন যে, প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে পারসিক চক্র জাতীয় যন্ত্র জল উত্তোলনের কাজে ব্যবহৃত হত। প্রাচীন সাহিত্যে এটিকে ‘অরঘট্ট’ বা ‘অরহট্ট’ বা ‘ঘটিযন্ত্র’ বলা হয়েছে। এই ব্যবস্থায় ঢাকায় পর পর বাঁধা থাকত মাটির কলসি। চাকা ঘোরালে মাটির এক পাত্রের জল পরের পাত্রটিতে এসে পড়ত। ঐতিহাসিক নীডহাম্ (Needhum) মনে করেন এই যন্ত্রটির সাথে বেড় বরাবর বালতি লাগানো নোরিয়া যন্ত্রের মিল আছে। এই যন্ত্রে শিকলের ব্যবহার ছিল কিনা স্পষ্ট নয়। তা ছাড়া এই যন্ত্র দ্বারা গভীর কুয়ো থেকে জল তোলা যেত না। রোমে প্রচলিত সাকিয়া বা পারসিক চক্রের (persian wheel) সাথে এটিকে একাকার ভাবা সঠিক নয়।
খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রোমান সাম্রাজ্যে গিয়ার (Gear) যুক্ত পারসিক চক্র বা সাকিয়া যন্ত্রের প্রাথমিক ধারণা গড়ে ওঠে। পরবর্তী চারশো বছরের মধ্যে শেকলের সাথে সারিবদ্ধ ঘট লাগিয়ে জল তোলার প্রযুক্তি প্রয়োগ করা সম্ভব হয়। ঐতিহাসিক স্কীয়লার (Schioler)-এর মতে, একাদশ শতক নাগাদ বাগদাদ গিয়ারযুক্ত পারসিক চক্রের সাথে পরিচিত হয়। ভারতে পারসিক চক্র ব্যবহারের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় বাবরের আত্মজীবনী ‘তুজুক-ই-বাবরী’গ্রন্থে। সপ্তদশ শতকে মুঘল চিত্রকলায় একটি উন্নত পারসিক চক্র যন্ত্রের অঙ্কন দেখা যায়। এই চক্রের শেকলগুলি ছিল জোড়া-কাছিবিশিষ্ট এবং কলসির জল ধরে রাখা বা ছেড়ে দেবার জন্য বিশেষ প্রযুক্তি ছিল। লাহোর, দিপালপুর, সরহিন্দ-সহ উত্তর-পশ্চিম ভারতে এমন কাঠের গিয়ারবিশিষ্ট জলত্তোলন প্রযুক্তির প্রচলন ছিল। পিন-ড্রাম-গিয়ারিং ( Pin-drum-gearing) ব্যবস্থা দ্বারা জল উত্তোলনের ব্যবস্থা পূর্ব-ভারতে পরিচিত ছিল না। উচ্চগাঙ্গেয় অববাহিকা অঞ্চলেও পারসিক চক্রের প্রচলন বহুকাল পরে হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে পূর্ব ভারতে কপিকল দিয়ে চামড়ার বালতিতে জল তোলা হত। এই চামড়ার জলপাত্র চরস নামে পরিচিত ছিল। উত্তর-পশ্চিম ভারতে কুয়ো থেকে জলসেচ দেওয়ার প্রচলন ছিল। সম্ভবত সেই কারণে ওই অঞ্চলে পারসিক চক্রের প্রয়োগ ঘটেছিল। অন্যদিকে পূর্ব ভারতে অগভীর জলাশয় বা নদী থেকে চাষের ক্ষেতে জল দেওয়া হত। তাই এই অঞ্চলে চরস বা ডোঙা জনপ্রিয় ছিল।
ত্রয়োদশ শতকের পরবর্তীকালে গিয়ারযুক্ত চরকা এবং তুলো পেঁজার কাজে ব্যবহৃত ধুনুৰ্গুণবিশিষ্ট যন্ত্র (এর ব্যবহারকারীরা ‘ধুনুরি’ নামে পরিচিত) ভারতে বস্তু উৎপাদনের কাজে গুণমান ও পরিমাণগত পরিবর্তন সূচিত করে। ঐতিহাসিক লিন হোয়াইট, নীডহাম প্রমুখ মনে করেন, প্রাচীন ভারতে চরকার প্রচলন ছিল না। ড. অনিরুদ্ধ রায়ের মতে, ত্রয়োদশ শতকের আগে বিশ্বের কোনো সভ্যতাতেই চরকার আবির্ভাব ঘটেনি। ভারতে চরকার ছবি প্রথম পাওয়া যায় মুঘল চিত্রকর্মে (১৬০৬ খ্রিঃ)। চতুর্দশ শতকে ইসামীর গ্রন্থে (১৩৫০ খ্রিঃ) চরকার উল্লেখ থেকে ড. ইরফান হাবিব মনে করেন যে, চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগে চরকা ভারতীয়দের কাছে পরিচিত ছিল। অধ্যাপক রায়ের মতে, সম্ভবত ত্রয়োদশ শতকের কিছু আগে চিন দেশে চরকার উদ্ভব হয় এবং মোঙ্গল সাম্রাজ্য বিস্তারের সূত্রে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ থেকে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে তা ছড়িয়ে পড়ে।
চরকার ব্যবহার সুতোর উৎপাদন বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু এই যন্ত্রে সরু সুতো তৈরি করা যেত না। ভারতের মসলিন ছিল পৃথিবীখ্যাত। এই বস্ত্রের অনন্যতা ছিল অতি সূক্ষ্ম সুতোর বুনন। এর প্রয়োজনে নাটাই বা তকলি’তে পাক দিয়ে সুতো তৈরির রেওয়াজ অব্যাহত ছিল। তুলোর ভেতর থেকে বীজ বা দানা বের করার জন্য চরকি বা বেলুনা নামক যন্ত্র ব্যবহার করা হত। ড. অনিরুদ্ধ রায় চরকির বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, এটি ছিল কাঠের তৈরি একধরনের ফাঁদ। এর মধ্যে বিররীত মুখে ঘূর্ণনবিশিষ্ট দুটি রোলার থাকত। রোলারের মধ্যে তুলো ঢুকিয়ে হাতল ঘুরিয়ে দিলে রোলার দুটি উল্টো মুখে ঘুরত। উভয়মুখী টানে তুলো খুলে যেত এবং দানা ও তুলোর রোঁয়া আলাদা হয়ে যেত।
চামড়ার দড়িযুক্ত কাঠের তৈরি ধনুকসদৃশ একটি যন্ত্র দ্বারা তুলোকে পিজে সহজে ব্যবহার উপযোগী করা হত। মধ্যপ্রাচ্যে চতুর্দশ শতকে ধুনুরিদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। পঞ্চদশ শতকের সূচনার কিছু আগেই ইউরোপে এই তুলো পেঁজা যন্ত্রের প্রচলন ঘটেছিল। ভারতে চতুর্দশ শতকের আগেই এই প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল বলে ঐতিহাসিকদের অনুমান। মুসলমান ধুনুরিরা এই কাজে লিপ্ত থাকতেন। অনুমিত হয় যে, মুসলমানরাই ভারতের বাইরে থেকে এই তুলো পেঁজার হাতিয়ার ভারতে এনেছিল এবং চতুর্দশ শতকের আগেই এর ভারতে আবির্ভাব ঘটেছিল।
সুলতানি আমলে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষচর্চার উৎসাহ দেখা যায়। একাদশ শতকের মধ্যেই মধ্য-এশিয়াতে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ভারতে আগত মধ্য-এশীয় পণ্ডিত ও কবি আলবেরুণী, আমির খসরু প্রমুখ তাঁদের রচনায় সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আপন কক্ষপথে আবর্তন সম্পর্কে তাঁদের গভীর বিশ্বাস ব্যক্ত করেন। দিল্লির সুলতানদের অনেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষবিদ্যার গুরুত্ব ও প্রভাব সম্পর্কে আস্থা পোষণ করতেন। হাসান নিজামী, সামস্-ই-সিরাজ আফিফ প্রমুখ তাঁদের রচনায় মানুষের ওপর জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও জ্যোতিষ শাস্ত্রের প্রভাব আলোচনা করে মহাকাশবিদ্যাচর্চার কাজকে উৎসাহিত করেন। উল্লেখ্য যে, উলেমাশ্রেণি মহাকাশ-সম্পর্কিত গবেষণার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু সুলতান ও অভিজাতদের এ-বিষয়ে উৎসাহ ও আস্থা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মহাকাশচর্চার কাজ সহজ করেছিল। বারাণীর রচনা থেকে জানা যায় যে, আলাউদ্দিন খলজির আমলে বর্হিভারত থেকে বহু বিজ্ঞানী ভারতে এসে জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের বিজ্ঞানী এই কাজে লিপ্ত ছিলেন এবং তাঁরা সরকার কর্তৃক পুরস্কৃতও হতেন। সুলতান মহম্মদ-বিন-তুঘলক গণিতশাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও মহাকাশচর্চার কাজকে বিশেষ উৎসাহিত করেছিলেন। প্রতিটি বিষয়ে তাঁর উৎসাহ ছিল তীব্র এবং জ্ঞান ছিল গভীর। সুলতান ফিরোজ তুঘলক স্বয়ং জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্রের অনুরাগী ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে জ্যোতির্বিজ্ঞান-বিষয়ক সংস্কৃত পুঁথি ফারসিতে অনুদিত হয়। এর ভিত্তিতে ফিরোজ শাহ জ্যোতির্বিজ্ঞান-বিষয়ক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চার অনুসঙ্গ হিসেবে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যেই ভারতে দিক্নির্ণয় যন্ত্র এবং অ্যাস্ট্রোলার এসে যায়।
মহম্মদ আওয়াফির রচনা থেকে জানা যায় যে, ভারতীয় নাবিকরা ‘চৌম্বক কম্পাস’-এর সাহায্যে মহাসাগরে পাড়ি দিতে পেরেছিল। অ্যাস্ট্রোলার ও কম্পাস তৈরির কাজে আরবরা প্রাথমিক সাফল্য পায়। খলিফাদের উদ্যোগে নবম শতকে এই বিষয়ক পরীক্ষানিরিক্ষা শুরু হয়েছিল। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক তাঁর নামাঙ্কিত নতুন রাজধানীতে প্রধান প্রাসাদের ওপর একটি উন্নত অ্যাস্ট্রোলার যন্ত্র বসিয়েছিলেন। এর থেকে গ্রহনক্ষত্রের গতিবিধি যেমন অবহিত হওয়া যেত, তেমনি সময় নিরূপণের কাজেও এটি সাহায্য করত। আফিফ এটিকেই ‘জলঘড়ি’ বলে বর্ণনা করেছেন।
ড. অনিরুদ্ধ রায় লিখেছেন, “এই যন্ত্রের আওয়াজ শুনে লোকেরা রমজানের উপবাস, প্রার্থনা ইত্যাদি করত। যন্ত্রটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, যাতে দিন ও রাত্রির সময় ঠিকমতো জানা যায়। ধর্মীয় প্রয়োজনে এই ধরনের যন্ত্রের সাথে দ্বাদশ শতকেই আরবদের পরিচয় ঘটেছিল।” আফিফ বলেছেন, ভারতে এই যন্ত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে দারুণ উৎসুক্য জাগিয়েছিল। তাই এটিকে বিশুদ্ধ ভারতীয় ‘জলঘড়ি’র সাথে তুলনা করা চলে না। বলা বাহুল্য, এই যন্ত্রের জটিলতা ও কর্মবৈচিত্র্য ছিল অনেক বেশি। ভারতের আঞ্চলিক শাসকদের কেউ কেউ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার চর্চা করতেন। জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কীর (পঞ্চদশ শতক) উদ্যোগে এমন একটি ঘড়ি তৈরি করা হয়েছিল যা প্রতি চব্বিশ মিনিটে আওয়াজ করত। ঘড়িটি মূল প্রাসাদের প্রবেশপথের পুবদিকের খিলানের মাথায় বসানো ছিল। জল ও আগুনের সাহায্যে খিলানের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানটিকে হাওয়া শূন্য করে ঘড়িটি চালানো হত। প্রতি চব্বিশ মিনিটে এক ঘড়ি হিসাব ধরে ষাট ঘড়ি সময় বাঁধা ছিল। এটিই ছিল সেখানকার সময়ের একক। লোদীবংশের কয়েকজন অভিজাত জলঘড়ির পরিবর্তে ‘সূর্যঘড়ি’ বসিয়েছিলেন বলে জানা যায়। একশ্রেণির কর্মচারী ছিল যারা সূর্যের ছায়া দেখে সময় নিরূপণ করত। লাহোরের শাসক দৌলত খাঁ লোদী এমন ঘড়ির অধিকারী ছিলেন। অবশ্য বাবর ভারতে ক্ষমতা দখলের পর এদেশে জলঘড়ির প্রাধান্যই লক্ষ্য করেছেন। সময়-জ্ঞাপনকারী কর্মীরা একটি পিতলের চাকতির ওপর কাঠের হাতুড়ি পিটিয়ে প্রতি চব্বিশ মিনিটে সময়ের জানান দিত। অন্যান্য মুসলিম-শাসিত রাজ্যগুলিতে ষাট মিনিটে এক ঘণ্টা এবং চব্বিশ ঘণ্টায় একদিন ধরা হত। কিন্তু তখন ভারতের মুসলিম শাসকরা ‘জলঘড়ি’র সময় অনুসরণ করতেন।
ভারতে তুর্কি-আক্রমণের সূত্রে ঘোড়ার জিন ও লৌহ-রেকাব-এর ব্যবহার এ-দেশে পরিচিতি পায়। ঐতিহাসিক লিন হোয়াইট এর মতে, ঘোড়ার রেকাবের বিবর্তনে ভারতীয় কারিগরদের একটা ভূমিকা ছিল। প্রাচীন ভারতীয় দেওয়াল চিত্রে ঘোড়ার গায়ে আলগা দড়ির জিনজাতীয় বস্তুর নিদর্শন দেখা যায়। এই জিনবন্ধনীর তলদেশে একটি ফাঁস থাকত, যা ঘোড়সওয়ারের পা রাখার কাজে ব্যবহার করা যেত। তবে সৈনিকের যুদ্ধদক্ষতা বাড়ানোর কাজে এই জিন বা পাদানির বিশেষ উপযোগিতা ছিল না। দশম ও একাদশ শতকে যথাক্রমে খাজুরাহো মন্দির ও কোনারকের মন্দিরের দেওয়াল-ভাস্কর্যে জিন ও রেকাববিশিষ্ট অশ্বের প্রতিকৃতি দেখা গেছে। তবে এগুলির আকার থেকে পণ্ডিতদের অনুমান যে, দড়ি বা চামড়া দিয়ে এগুলি তৈরি করা হয়েছিল। যাই হোক, এমন নম্র রেকাব ঘোড়সওয়ারের যুদ্ধদক্ষতা বা গতিবৃদ্ধির পক্ষে তেমন উপযোগী ছিল না। ভারতে অভিযানরত গজনির সেনাবাহিনীর অশ্বারোহী যোদ্ধারা লোহার রেকার ও চামড়ার জিনবন্ধনী ব্যবহার করেছিল। সম্ভবত চিনদেশে ষষ্ঠ শতকের কোনো এক সময় লোহার রেকাব চালু হয়েছিল। পরে তুর্কি-যোদ্ধারা তা ভারতে অভিযানের সময় ব্যবহার করে সাফল্য পায়। একইভাবে ঘোড়া বা উটের খুরে লোহার পাত বা নাল লাগিয়ে ওই পশুদের দীর্ঘ পদযাত্রার উপযোগী করে তোলার প্রযুক্তিও তুর্কিরা ভারতে নিয়ে আসে। নবম শতকে রোমান সাম্রাজ্যে ঘোড়ার নালের ব্যবহার ছিল বলে স্থানীয় সাহিত্যে উল্লেখ পাওয়া যায়। পরে মুসলমানদের কাছে তা পরিচিত হয় এবং ভারতে প্রবেশের পর এদেশেও নালের ব্যবহার ব্যাপকতা পায়।
ঘোড়ার জিন ও লৌহ-রেকারের পাশাপাশি উন্নত তির-ধনুক তুর্কিসেনাদের যুদ্ধশক্তি বৃদ্ধি করেছিল। এই যোদ্ধারা সহজে বহনযোগ্য ধনুক ও ছোটো ছোটো তির ব্যবহার করত। পারস্যে এই ক্রুশাকার ধনুকের নাম ছিল নাভাক। এই ধনুকের ডান প্রান্তে একটা চোঙা বসিয়ে তার মধ্যে তির লাগানো থাকত। অধ্যাপক অনিরুদ্ধ রায় লিখেছেন যে, এই ব্যবস্থা তিরের গতিবেগ ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত করার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করেছিল। চিনদেশে খ্রিস্টপূর্ব কালেই এই পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল। পরে মুসলমান যোদ্ধারা ভারতের গতানুগতিক বৃহদাকার ধনুকের বিরুদ্ধে এই কৃশাকার ধনুক ব্যবহার করে সাফল্য পায়। ক্রমে এই নতুন প্রযুক্তি ভারতে জনপ্রিয় হয়।
সুলতানি যুগে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। আবুল ফজলের বর্ণনা থেকে অনুমান করা সম্ভব যে, ষোড়শ শতকের আগে ভারতে উন্নতমানের গাদা বন্দুকের প্রচলন ছিল না। তবে সুলতানি আমলে রকেট ও কামান ব্যবহারের প্রযুক্তি পরিচিত ছিল। অধ্যাপক অনিরুদ্ধ রায়ের মতে, আরবরা সিন্ধু অভিযানের সময় ন্যাপথা বা গ্রিক আগুন ভারতে প্রথম নিয়ে আসে অষ্টম শতকের প্রথম দশকে। এ ছাড়াও আরবরা সিন্ধুতে ‘মঞ্জানিক’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে। সুলতানি আমল জুড়ে এই দুটি অস্ত্রের ব্যবহার অব্যাহত ছিল। ইক্তিদার আলম খানের মতে, চতুর্দশ শতকের শেষদিকে বারুদ মেশানো রকেট (বান) ভারতে ব্যবহার শুরু হয়। তবে এই দূরগামী ও দ্রুতগামী রকেট প্রথম আবিষ্কার করে চিন। চিন থেকে সরাসরি এই প্রযুক্তি ভারতে প্রবেশ করেছিল। বারুদ দেওয়া কামান ভারতে এসেছে কিছু পরে পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে। চিন ও ইউরোপ উভয় অঞ্চলেই ব্রোঞ্জ বা পাথরের গোলাবারুদ সহযোগে ছোঁড়া হত। পরে ইউরোপে লোহার গোলা ছোঁড়ার প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হলে কামানের লক্ষ্যভেদ ক্ষমতা অনেকটা বৃদ্ধি পায়। বাবরের আত্মজীবনী গ্রন্থের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, ষষ্ঠদশ শতকে ভারতে কামানের ব্যবহার চালু হয়েছিল।
Leave a comment