দিল্লির সুলতানি শাসনকালে রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সাহিত্য ও শিল্পচর্চার দিকেও দৃষ্টি দেওয়া হয়। প্রথাগতভাবে ভারতে ভূখণ্ডে সংস্কৃত ভাষা ছিল সাহিত্যের প্রধান মাধ্যম। উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্যচর্চার কাজ প্রাচীন ও আদি-মধ্যযুগের ভারতে অব্যাহত ছিল। ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুজ্জীবনের সুত্র ধরে সপ্তম-অষ্টম শতকে সংস্কৃত ভাষার চর্চাতেও নবজীবন লক্ষ্য করা যায়। দশম শতকের পরবর্তীকালে ভারতে তুর্কিদের অভিভাষণ ও স্থায়ীভাবে বসবাস করার সূত্রে এদেশের সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও রূপান্তর ঘটে। ভারতীয় রাজনীতিতে তুর্কিজাতির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ফলে সমাজ ও সংস্কৃতির ওপরেও গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া ঘটে। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার সূত্রে সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে প্রথমে আরবি ও পরে ফারসি ভাষা সাহিত্যের ভাষা হিসেবে প্রথম সারিতে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়। আঞ্চলিক ভাষাচর্চার ক্ষেত্রেও পরিবর্তনের এই ধারা লক্ষ্য করা যায়।

সুলতানি যুগের ফারসি সাহিত্য :

দশম শতক থেকে পারস্য ও মধ্য-এশিয়ায় ফারসি ভাষাচর্চার ব্যাপকতা দেখা যায়। দশম শতকের পরবর্তী কয়েক শতক বিশিষ্ট পারসিক কবি ও সাহিত্যিকরা বহু অমর সাহিত্য সৃষ্টি করেন। ভারতে তুর্কি শাসন প্রতিষ্ঠার আদি পর্বে আরবি ভাষার বিশেষ গুরুত্ব ছিল। ক্রমে তাঁরা ফারসি ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হন। উলেমা প্রমুখ ধর্মীয় আইনবিশারদদের মধ্যে তখনও আরবি ভাষার জনপ্রিয়তা থাকলেও, প্রশাসন ও কাব্য-সাহিত্যের ভাষা হিসেবে ফারসি দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তুর্কি শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতার ফলে ফারসি ভাষাচর্চা দ্রুত ব্যাপকতা লাভ করে। গজনি ও ঘুর প্রদেশের শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রখ্যাত ফারসি কবি-সাহিত্যিক ফিরদোসী, সাদি, মহম্মদ হাফিজ, হামজাশাহ, তাজউদ্দিন হাসান প্রমুখ ফারসি ভাষায় সাহিত্যচর্চার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, ভারতের তুর্কি শাসকেরা সে ধারা অনুসরণ করে ত্রয়োদশ শতক ও পরবর্তীকালে এদেশেও ফারসি ভাষার চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যান। বিখ্যাত ফারসি কবি আমির খসরু গর্বভরে বলেছিলেন যে, মধ্য-এশিয়ার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বুখারার থেকে ভারত সাহিত্যচর্চাতে পিছিয়ে ছিল না তো বটেই, উপরন্তু বুখারার সাংস্কৃতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দ্রুত দিল্লি উঠে এসেছিল। মোঙ্গলদের আক্রমণের চাপে পড়ে বহু পারসিক পণ্ডিত ভারতে চলে এলে এখানে সাদর অভ্যর্থনা পান। তুর্কি শাসকেরা নানাভাবে বহিরাগত পণ্ডিতদের সাহিত্যসৃষ্টির কাজে সহযোগিতা করেন। সরকারি উদ্যোগে দিল্লি, জলন্ধর, ফিরুজাবাদসহ ভারতের নানা স্থানে মুসলিম শিক্ষার কেন্দ্র গড়ে ওঠে। স্থাপন করা হয় আরবি ও পারসিক গ্রন্থের পাঠাগারসমূহ। ফারসি ভাষা ও সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র হিসেবে লাহোর বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে।

তুর্কি-আফগান আমলে ভারতের অগ্রণী ফারসি সাহিত্যকার ছিলেন আমির খসরু (১২৬৩-১৩২৫ খ্রিঃ)। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক ও সঙ্গীতজ্ঞ। সুলতান বলবনের জ্যেষ্ঠপুত্র মহম্মদের গৃহশিক্ষক হিসেবে তিনি প্রথম পাদপ্রদীপের আলোকে আসেন। আলাউদ্দিন খলজির সভাকবি হিসেবে তিনি খ্যাতি ও প্রতিপত্তির শীর্ষে আরোহণ করেন। কাব্যসৃষ্টিতেই তাঁর আগ্রহ ছিল সর্বাধিক। তিনি মসনভি, দিওয়ান, কাসিদা ও গজল রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আলাউদ্দিন খলজির শাসনকালে তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনাগুলি সৃষ্টি হয়। তিনি তিনটি ইতিহাসমূলক গ্রন্থ রচনা করেন— ‘খাজাইন-উল্-ফুতুহ, ‘ন্যুসিপিহর’ ও ‘তুঘলকনামা’। প্রথমটি গদ্যে ও অন্য দুটি পদ্যে রচিত। সুফিদর্শনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার শিষ্য আমির খসরুর রচনায় সহনশীলতা ও মানবিক গুণাবলীর প্রকাশ দেখা যায়। ভারতবর্ষকে তিনি নিজের জন্মভূমি বলতে গর্ববোধ করতেন। তাঁর বিভিন্ন কাব্য সাহিত্যে ভারতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভূয়সী প্রশংসাধ্বনিও হয়েছে। ‘ভারতের তোতাপাখি’ নামে তিনি অভিহিত হতেন।

কুতুবউদ্দিন আইবকের আমলের রাজকর্মচারী হাসান নিজামী আরবি ও ফারসি ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যচর্চা করেন। নিজামী রচিত ‘তাজ-উল্-মাসির’ সুলতানি যুগের প্রথম ইতিহাসমূলক সাহিত্য হিসেবে গুরুত্ব পায়। এই গ্রন্থে আরবি ও ফারসি ভাষার অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। লেখক আরবি ভাষায় রচনা শুরু করে নানাক্ষেত্রে ফারসি ভাষার প্রয়োগ ঘটান। হাসান নিজামী গদ্যে ও পদ্যে পারদর্শী ছিলেন। তাই তাঁর গদ্যসাহিত্যেও কাব্যের মাধুর্য উপলব্ধি করা যায়। আলাউদ্দিন খলজির রাজত্বকাল একদিকে যেমন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ পর্ব হিসেবে চিহ্নিত হয়, তেমনি এই পর্ব সাহিত্য-সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ রূপেও বন্দিত হয়। জিয়াউদ্দিন বারাণী লিখেছেন যে, আলাউদ্দিনের আমলে ভারতে নানা জাতির বিখ্যাত পণ্ডিতদের সমাবেশ দেখা যায়। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের নানা শাখার প্রখ্যাত ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিভার সমাবেশের ফলে দিল্লি বাগদাদের শত্রু, কায়রোর প্রতিদ্বন্দ্বী এবং কনস্ট্যান্টিনোপলের সমমর্যাদার স্তরে উন্নীত হয়েছিল (“The capital of Delhi by the presence of these unrivalled men of great talents, had become the envy of Baghdad, the rival of Cairo and equal of Constantinople.”)। ধর্মপ্রাণ পণ্ডিত নিজামউদ্দিন আউলিয়া ও অন্যান্য বহু পণ্ডিত এই সময় ফারসি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন।

গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ও মহম্মদ-বিন-তুঘলকের আমলেও ফারসি ভাষায় কাব্য-সাহিত্যচর্চার উৎসাহ দেখানো হয়। মহম্মদ-বিন্-তুঘলক স্বয়ং সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি নিয়মিত দার্শনিক, ধর্মবিদ্, তার্কিক, চিকিৎসাবিজ্ঞানী প্রমুখের সাথে মতবিনিময় করতেন। তাঁর সমকালে ফারসি ভাষা-সাহিত্যের প্রখ্যাত সাধক ছিলেন সুয়াইয়ান-উদ্-দিন-উমরানী। তিনি ফারসিতে “হুসেইনী, ‘তলখিস’, ‘সিতা’ইত্যাদির ওপর টীকা রচনা করেন। সুলতান ফিরোজ শাহ স্বয়ং সাহিত্যরসিক ছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ফুতুহ্-ই-ফিরোজশাহি’ ফারসি সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ। সমসাময়িক কালের সুপরিচিত ফারসি সাহিত্যকারদের অন্যতম ছিলেন কাজি আবদুল মুকতাদির সানিহি, মৌলানা খাজাগি, আহমেদ থানেশ্বরী প্রমুখ।

দিল্লি-সুলতানির অবক্ষয়ের যুগেও ফারসি সাহিত্যচর্চায় ভাটা পড়েনি। লোদীবংশীয় শাসকদের মধ্যে সুলতান সিকন্দর লোদী স্বয়ং ছিলেন একজন কাব্যরসিক ও কবি। আঞ্চলিক স্তরে বাহমনী রাজ্য এবং অন্যান্য মুসলিম রাজ্যসমূহ যেমন– বিজাপুর, আহমদনগর, গোলকুণ্ডা, মালব, জৌনপুর, বাংলা, মুলতান প্রভৃতিও ভাষা ও সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাহমনী রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মামুদ গাওয়ান ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন সাহিত্যরসিক ও কবি। লোদী আমলের শ্রেষ্ঠ ফারসি কবি ছিলেন দিল্লির শেখ জামালউদ্দিন। পারস্যের কবি ও জমিদারের সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল।

সুলতানি আমলে ফারসি ভাষায় বহু মূল্যবান ইতিহাসমূলক সাহিত্য রচিত হয়। মিনহাজউদ্দিনের ‘তাবাকত্-ই-নাসিরী’ গ্রন্থ ইসলামিক আন্দোলনের বিস্তারিত বিবরণে সমৃদ্ধ। লেখক তাঁর গুণমুগ্ধ পৃষ্ঠপোষক সুলতান নাসিরউদ্দিন মামুদের নামে এই ইতিহাসমূলক গ্রন্থের নামকরণ করেন। আলাউদ্দিনের রাজত্বকালের বিবরণসমৃদ্ধ গ্রন্থ আমির খসরুর ‘তারিখ-ই-আলাই, মহম্মদ-বিন্-তুঘলক ও ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজত্বকালের বিবরণভিত্তিক জিয়াউদ্দিন বারাণীর গ্রন্থ ‘তারিখ-ই ফিরোজশাহি’ ও ‘ফুতুহ-ই-জাহান্দারি’ প্রভৃতি ফারসি ভাষা-সাহিত্যের অনবদ্য নিদর্শন। এই ধরনের অসংখ্য ফারসি গ্রন্থের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাম হল শামস্-ই-সিরাজ ‘আফিফ’ রচিত ‘তারিখ ই-ফিরোজশাহি, ইয়াহিয়া-বিন-শিরহিন্দি রচিত ‘তারিখ-ই-মুবারকশাহি, ইসামী রচিত ‘ফুতুহ-উস্ সালাতিন’ ইত্যাদি।

রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার ফলে সুলতানি যুগের ফারসি ভাষার দ্রুত বিস্তার সম্ভব হয়। খসরুর সময় থেকে ফারসিতে নতুন ধারার সূচনা ঘটে। একে বলা হত ‘সবক-ই-হিন্দি’ বা ভারতের রীতি। তিনি হিন্দিকে বলতেন ‘হিন্দভি’। এই সময় ফারসি ভাষার সাথে হিন্দি ভাষার অপূর্ব সমন্বয় ঘটে। উদ্ভব ঘটে ‘উর্দু’ নামক এক মিশ্র ভাষার। এর ফলে ফারসি ভাষা ও হিন্দি ভাষার সাথে পরিচিত লোকেদের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান অনেক সহজ হয়ে যায়।

সুলতানি যুগের সংস্কৃত সাহিত্য :

সুলতানি যুগে সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান-বিষয়ক বহু গ্রন্থ লেখা হয় সংস্কৃত ভাষায়। তুলনামূলকভাবে পূর্ববর্তী কয়েক শতকের তুলনায় কম হলেও, মুসলমান শাসকদের আমলে সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্যচর্চার পথ অন্তত সরকারিভাবে অমসৃণ ছিল না। ড. কালিকিঙ্কর দত্ত বলেছেন : “The period was not entirely barren of important composition in sanskrit, religious as well as secular …” দেশের নানাস্থানে সংস্কৃতচর্চার জন্য শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাজনৈতিকভাবে এই সকল প্রতিষ্ঠানের কাজে হস্তক্ষেপ করা হত না। শংকরাচার্যের ‘অদ্বৈতবাদ’কে কেন্দ্র করে বহু সংস্কারক সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য ও দর্শন রচনা করেন। ত্রয়োদশ শতকে পার্থসারথি মিশ্র ‘কর্ম-মীমাংসা’র ওপর বহু গ্রন্থ রচনা করেন। এদের মধ্যে বহুল প্রচলিত গ্রন্থটির নাম ‘শাস্ত্ৰ দীপিকা’। সুলতানি আমলে যোগ, বৈশেষিক ও ন্যায়দর্শনের ওপর বহু টীকা রচিত হয়। দ্বাদশ শতকে বিজ্ঞানেশ্বর লেখেন ‘মিতাক্ষরা’ নামক আইন সংকলন। হিন্দু আইনের উত্তরাধিকার সম্পর্কে জীমূতবাহন লেখেন ‘দায়ভাগ’ গ্রন্থ।

সংস্কৃত ভাষায় রচিত নাটকগুলি ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সমকালে রচিত গুরুত্বপূর্ণ নাটকটি হল জয়সিংহ সূরি রচিত ‘হাম্মির-মদ-মর্দান’। আনুমানিক ত্রয়োদশ শতকের বিশেষ দশকে এটির রচনা সম্পূর্ণ হয়। অনুরূপ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নাটক হল কেরলের যুবরাজ রবি বর্মন রচিত ‘প্রদ্যুম্ন-অভ্যুদয়, বিদ্যানাথ রচিত (১৩০০ খ্রিঃ) ‘প্রতাপ-রুদ্র-কল্যাণ’, বামন ভট্ট রচিত ‘পার্বতী পরিণয়’(১৪০০ খ্রিঃ) ইত্যাদি। গুজরাটের সুলতান দ্বিতীয় মহম্মদের বিরুদ্ধে চম্পানগরের জনৈক যুবরাজের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধকে স্মরণীয় করার জন্য গঙ্গাধর রচনা করেন ‘গঙ্গাদাস প্রতাপ বিলাস’। আনুমানিক ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নবাব হুসেন শাহের মন্ত্রী রূপ গোস্বামী ‘বিদগ্ধ মাধব’ ও ‘ললিত মাধব’ নামক দুটি বিখ্যাত নাটক রচনা করেন। তিনি সংস্কৃত ভাষায় প্রায় পঁচিশটি সাহিত্য রচনা করেছিলেন।

মধ্যযুগে মিথিলা ও বাংলায় স্মৃতিশাস্ত্র ও ব্যাকরণ-বিষয়ক অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়। সেযুগে মিথিলার প্রখ্যাত লেখক ছিলেন পদ্মনাভ দত্ত, বিদ্যাপতি উপাধ্যায়, বাচস্পতি মিশ্র প্রমুখ। বাংলার খ্যাতিমান শাস্ত্রকারদের অন্যতম ছিলেন রঘুনন্দন। মধ্যযুগে বহু ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ জৈন সাহিত্য রচিত হয়। আঞ্চলিক ক্ষেত্রে সংস্কৃত ভাষাচর্চার কেন্দ্র হিসেবে বিজয়নগর রাজ্যের বিশেষ খ্যাতি ছিল। বিশিষ্ট পণ্ডিত ও বৈয়াকরণিক সায়নাচার্য ও তাঁর ভাই মাধব বিদ্যারণ্য রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বহু গ্রন্থ রচনা করেন। সেযুগে কোনো কোনো মুসলিম পণ্ডিতও সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞানার্জন করে সাহিত্যচর্চার কাজে লিপ্ত ছিলেন বলে জানা যায়।।

সুলতানি যুগের আঞ্চলিক সাহিত্য:

ভক্তিবাদী আন্দোলনের ফলে ভারতের সমাজ ও ধর্মজীবনে যেমন সুদুররসারী প্রভাব পড়েছিল, তেমনি এই আন্দোলনের সুত্র ধরে সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষাও সাহিত্যের ভাষা হিসেবে ওপরের সারিতে উঠে আসার সুযোগ পায়। রক্ষণশীল হিন্দুরা সংস্কৃত ভাষার চিরাচরিত মর্যাদায় বিস্তৃত হতে পারেননি। তুর্কি শাসকরা আরবি ও ফারসি ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গুরুত্ব দিতে তৎপর ছিলেন। কিন্তু ভক্তিবাদী সংস্কারকগণ মানুষের কথ্য ভাষাকেই তাঁদের মতপ্রচারের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলে, স্থানীয় কথ্য ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। রামানন্দ ও কবির হিন্দি ভাষাতেই কবিতা রচনা করেন। কবিরের ‘দোহা’ এবং ‘সকিস্’-গুলি আধ্যাত্মিক রসে সমৃদ্ধ হয়ে হিন্দি ভাষা-সাহিত্যকে এক নতুন মাত্রা ও জনপ্রিয়তা দেয়। সাধিকা মীরাবাঈ ও তাঁর অনুগামীরা ‘ব্রজভাষা’য় রাধা-কৃষ্ণের বন্দনা গান রচনা করেন। নামদেব কথ্য মারাঠি ভাষায় তাঁর মতাদর্শ প্রচার করেন। নানক ও তাঁর অনুগামীরা পাঞ্জাবি ও গুরুমুখি ভাষায় গীত রচনা করেন। বাংলা ভাষা-সাহিত্যে বৈপ্লবিক রূপান্তর আনেন বৈষ্ণব সাধকবৃন্দ। কবি চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি ঠাকুর প্রমুখ বাংলা ভাষায় কাব্যচর্চা করে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বিদ্যাপতি ঠাকুর মিথিলায় জন্ম নিলেও বাংলা ভাষাকে তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। আঞ্চলিক সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিদ্যাপতি জনৈক হিন্দু সামন্ত শিব সিংহের সভাকবি হিসেবে কাব্যচর্চার বিশেষ সুযোগ পান।

বাংলার মুসলমান শাসকেরাও বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার কাজে বিশেষ উৎসাহ দেখান। তাঁদের উদ্যোগে ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় অনুদিত হয়। সুলতান বারবক শাহ (১৪৫৯ ‘৭৬ খ্রিঃ) সাহিত্যের একান্ত অনুরাগী ছিলেন। সেকালের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক বৃহস্পতি মিশ্র, মালাধর বসু, কৃত্তিবাস প্রমুখ তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। বৃহস্পতি মিশ্র ‘পদচন্দ্রিকা’ কাব্য রচনা করে বিশেষ খ্যাতি পান। এ ছাড়া তিনি ‘গীতগোবিন্দ’, ‘কুমারসম্ভব’, ‘রঘুবংশ’ প্রভৃতি বহু গ্রন্থের টীকা লেখেন। মালাধর বসু ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’কাব্য রচনার (১৪৭৩ খ্রিঃ) জন্য সুলতানের কাছ থেকে ‘গুণরাজ খাঁ’ উপাধি পান।

‘বাংলার বাইবেল’ হিসেবে কথিত রামায়ণের বঙ্গানুবাদ করে কৃত্তিবাস বাংলা ভাষা সাহিত্যের গৌরব বৃদ্ধি করেন। গৌড়ের সুলতান নসরৎ শাহের উদ্যোগে শ্রীকর নন্দী মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করেন। হুসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খাঁ’র উদ্যোগে কবিন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের অপর একটি বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন। বিজয়নগরের শাসকদের উদ্যোগে তেলেগু ভাষায় ব্যাপক সাহিত্যচর্চা হয়। রাজা কৃষ্ণদেব রায় স্বয়ং তেলেগু ভাষায় রাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক গ্রন্থ ‘আমুক্ত মাল্যদা’রচনা করেন। তিনি সংস্কৃত ভাষায় ‘জাম্ববতি কল্যাণম্’নামে একটি নাটকও রচনা করেন। বিশিষ্ট তেলেগু কবি পেড্ডান ও নন্দী তিয়ামা রচনা করেন যথাক্রমে ‘মনুচরিতম্’ ও ‘পারিজাত পহর নামু’ নামক দুটি গ্রন্থ।