সুলতানি যুগে হিন্দু সমাজ ও তার ওপর ইসলামের প্রভাব:

ভারতবর্ষের আদি হিন্দু সমাজব্যবস্থা মানবসমাজের অন্যতম অগ্রণী, দৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী সমাজব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত। ভারতে মুসলমানদের আগমন ও মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠা সেই সামাজিক ক্রমবিবর্তনের ধারায় একটি নতুন পর্বের সূচনা করে। অধ্যাপক কে. এম. আশরাফ মনে করেন, মুসলিম শাসনের প্রথম যুগে ভারতীয় সংস্কৃতির গঠনাত্মক শক্তিগুলির বিকাশ ঘটেছিল। সুলতানি আমলে হিন্দু মুসলিম সংস্কৃতির পারস্পরিক প্রভাবের ফলে যে উন্নত জীবনধারা ও সংস্কৃতির সূচনা হয়েছিল, তার ওপর ভিত্তি করেই মুঘল শাসকেরা সংস্কৃতির গৌরবময় সৌধ রচনা করেছিলেন। “মুসলিম-সভ্যতার প্রভাবে হিন্দুদের প্রাচীন ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরভেদ প্রায় ঘুচে যায়। জাতিভেদ-প্রথার ক্ষেত্রেও কিছু কিছু সংস্কার প্রবর্তিত হয়। ধর্মীয় প্রবণতার দিক পরিবর্তন ঘটে এবং শেষ পর্যন্ত ভারতের এক অখণ্ড রূপকল্পনাও সম্ভব হয়।”

প্রাক্-মুসলিম ভারতীয় সমাজের চিত্র মৌর্য ও গুপ্তবংশীয় শাসনকালের সমাজ থেকে উল্লেখযোগ্য ভাবে স্বতন্ত্র ছিল না। হর্ষবর্ধনের মৃত্যু থেকে উত্তর ভারতে ‘রাজপুত-সংস্কৃতির’ পর্ব বলে অভিহিত করেছেন। এ ধরনের নামকরণের যৌক্তিকতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ রাজপুতরা ভারতীয় জনসমষ্টির ভগ্নাংশ মাত্র। একথা হয়তো সত্য যে, তারা সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের বহু মহান ধারার ধারক ও বাহক ছিলেন। কিন্তু সেই উন্নত সংস্কৃতির ধারা সীমাবদ্ধ ছিল সমাজের সচ্ছল ও উচ্চবর্গী মানুষদের মধ্যে। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবাসীর সাথে এদের কোনো সম্পর্কই ছিল না। সমকালীন রাষ্ট্রনেতা বা সংস্কারকগণ সাধারণ জনতার শ্রদ্ধা বা আস্থা অর্জন করতে পারলে একটা নবোথিত শক্তি ও সংস্কৃতির চাপে সুপ্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি তাসের ঘরের মতো ধ্বসে পড়ত না। যাইহোক্, আরবদের ভারত আক্রমণের সূত্রে ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতির অগ্রণী গোষ্ঠী ‘ক্ষত্রিয়’রা দ্বিতীয় সারিতে সরে যায় এবং তাদের স্থান নেয় ‘অগ্নিকুল’ রাজপুত গোষ্ঠী।

অধ্যাপক দশরথ শর্মা তাঁর ‘লেকচারস্ অন রাজপুত হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার’ শীর্ষক রচনায় ভারতীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতির সম্মুখভাগে ক্ষত্রিয়দের পরিবর্তে অগ্নিকুল রাজপুতদের আগমনকে আরব আক্রমণের গুরুত্বপূর্ণ ফল বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতির কোনো মৌলিক রূপান্তর আনতে পারেনি বা আনতে চায়নি। প্রায় আগের মতোই ভারতীয় সমাজ বর্ণবিভাগের কাঁটাজালে আবদ্ধ ছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র–এই চতুর্বর্ণের সামাজিক অবস্থানের বিশেষ হেরফের ঘটেনি। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় রাজপুতরা সুবিধাভোগীশ্রেণি হিসেবে সংস্কৃতি ও রাজনীতির একচেটিয়া কর্তৃত্ব ভোগ করত। বৈশ্য ও শূদ্রদের সাথে তাদের ছিল দুরতিক্রম ব্যবধান।

অবশ্য অধ্যাপক সতীশচন্দ্র দেখিয়েছেন যে, অষ্টম শতকে “ব্যক্তি বা গোষ্ঠী উচ্চবর্ণে উন্নীত হতে পারত।” তবে সামাজিক মৌল-চরিত্র পরিবর্তনের দিক থেকে তা ছিল নগণ্য। তবে বৃত্তি পরিবর্তন করে বর্ণাক্রম পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, যেমন—–ব্রাহ্মণ যুদ্ধে যোগ দিয়েছে কিংবা ক্ষত্রিয় বাণিজ্যকর্মে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু এর ফলে বর্ণভেদের কঠোরতা হ্রাস পায়নি। কেবল বৈশ্য ও শুদ্রদের ব্যবধান কিছুটা শিথিল হয়েছিল; এবং তারও গতি ছিল নিম্নমুখী। অর্থাৎ‍ সমাজের মূল জনগোষ্ঠী ব্রাহ্মণ্য-হিন্দুবাদের কঠোর শৃঙ্খলপাশে আবদ্ধ অবস্থায় এক অসহায়-ক্রোধ সম্বল করে দিনাতিপাত করছিল। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণভাবে নারীজাতির জীবনও ছিল আবদ্ধ এবং পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত। সতীদাহ, বহুবিবাহ, দেবদাসী প্রথা যথাপূর্ব চালু ছিল। উচ্চবর্ণের কিছু মহিলা হয়তো শিক্ষাসংস্কৃতিচর্চায় কিছুটা স্বাধীনতা পেয়েছিলেন; কিন্তু মূলস্রোতের অবস্থা ছিল পূর্ববৎ করুণ।

ড. আর. সি. দত্ত তাঁর ‘লেটার হিন্দু সিভিলাইজেশন’ গ্রন্থে দশম-একাদশ শতকীয় ভারতীয় সমাজকে ইউরোপের ‘অন্ধকার যুগে’র মতোই সার্বিক সংকীর্ণতায় আকীর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, ইউরোপের সামন্তপ্রভু ও ভারতের রাজপুত-ক্ষত্রিয়রা ছিল সমচরিত্রের অধিকারী। তবে উভয়ের মধ্যে প্রভেদ এই যে, ইউরোপের সামন্তপ্রভুরা পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সহযোদ্ধা, সহকর্মী মানুষদের কাছে টেনে নিতে পেরেছিলেন, কিন্তু ভারতে রাজপুত-ক্ষত্রিয়রা সেই উদারতা বা দূরদর্শিতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। আরবীয় পণ্ডিত আলবেরুণীর মতে, ভারতের সমাজ পরিচালকদের কূপমণ্ডুকতা, বহির্জগতের সাথে যোগাযোগের একান্ত অনাগ্রহ ভারতীয় সমাজকে আপন সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রেখেছিল। ঐতিহাসিক টয়েনবি (A. Toynbee) হিন্দুদের পারস্পরিক সম্পর্ককে ‘a social enormity’ বলে অভিহিত করেছেন।

ভারতে ইসলামের আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠা এবং ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতির ওপর ইসলামের প্রভাবে ভারতীয় সমাজের উপরোক্ত প্রেক্ষাপটের অস্তিত্ব গুরুত্বপূর্ণ। কেবল একহাতে তরবারি ও অন্যহাতে কোরান নিয়ে ইসলাম ভারতবর্ষে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে—এরূপ ধারণা আদৌ ইতিহাসসিদ্ধ নয়। ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার নানা উপাদান ভারতে ইসলামের আগমন ও প্রসারকে ত্বরান্বিত করেছিল।’ ভারতের গ্রামীণ সমাজের সীমাবদ্ধ জীবনযাত্রা, অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দু, বৃত্তিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করেছিল, তাতে মুসলমানদের প্রতিষ্ঠা সহজতর হয়েছিল। ভারতে ইসলামের প্রসারের জন্য বলপূর্বক ধর্মান্তরের ঘটনা কিছু অবশ্যই আছে। তবে এগুলি ঘটেছিল একান্তই বিচ্ছিন্নভাবে। আমরা আগেই দেখেছি যে, কোনো মুসলমান শাসকই সরকারিভাবে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেননি। এদেশে ইসলামের প্রসার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবাসীর কাছে আদৌ কোনো বিপদ সংকেত ছিল না। জাতিভেদ, বর্ণভেদ, বৃত্তিভেদ ইত্যাদির দাপটে ভারতীয় সমাজ এতটাই বিচ্ছিন্ন ছিল যে, সামগ্রিকভাবে হিন্দুচেতনা দানা বাঁধার সুযোগ ছিল না। মুসলিম শাসকদের আমলে হিন্দুদের ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তার বিকাশ বিশেষ বাধাও পায়নি।

ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন, “রাজকীয়, প্রচেষ্টায় যেসব ধর্মান্তরকরণের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলি মূলত বিদ্রোহী সামস্ত রাজাদের ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত হয়েছে; সকলের ক্ষেত্রে নয়। ঔরঙ্গজেবের মতো গোঁড়া মুসলমান ও সর্বশক্তিমান সম্রাটও শিবাজীর পৌত্র শাহুকে ইসলামে দীক্ষিত করেননি, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও।” ড. ভট্টাচার্যের মতে, ধর্মান্তরের ব্যাপারটা ছিল প্রধানত রাজনৈতিক। প্রচলিত হিন্দুসমাজের বিরুদ্ধে অসন্তোষ, উচ্চবর্ণের উৎপীড়ন ইত্যাদি কারণে অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এর পেছনে জবরদস্তি ছিল কম। অনেকে শাসকশ্রেণির কৃপাভাজন হবার জন্য, আবার কেউ কেউ আদর্শগত কারণে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, জাতিভেদ প্রথায় বিচ্ছিন্ন এবং কর্মফলবাদের অসার তত্ত্বে বিশ্বাসী ভারতীয় গ্রামীণ সমাজ সুবিধাভোগী ভারতীয় রাজন্যবর্গ এবং আগন্তুক মুসলমান যোদ্ধাদের মধ্যে কোনো প্রভেদ খুঁজে পায়নি। ভারতীয় সমাজের ওপর ইসলামের প্রভাব কিংবা ভারতীয়দের কাছে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রেও একই উপাদান সক্রিয় ছিল।

প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতীয় (হিন্দু) সমাজে ইসলামের গ্রহণযোগ্য ছিল শূন্য। কারণ ইসলামের দর্শন ও আচারাদি হিন্দু-সংস্কৃতির প্রায় বিপরীতধর্মী ছিল। বহু ঈশ্বরবাদী ও পৌত্তলিক হিন্দুদের কাছে ‘একেশ্বরবাদী’ এবং পৌত্তলিক প্রথার বিরোধী ইসলাম দর্শন তাদের অস্তিত্বের পক্ষে চ্যালেঞ্জ রূপেই প্রতিভাত হয়েছিল। এই বিরোধ ছিল খুবই স্বাভাবিক। ইতিপূর্বে ভারতে যে সকল বিদেশি এসেছিল, তাদের স্বনির্ভর বা সম্পূর্ণ কোনো সংস্কৃতি ছিল না। ফলে তারা সহজেই ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে একাত্ম হতে পেরেছিল। কিন্তু মুসলমানরা ভারতে আসার আগেই তাদের ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্রদর্শন একটা পূর্ণরূপে ধারণ করেছিল। সমাজ ও রাষ্ট্রদর্শনের সমন্বয়ে ইসলাম-সংস্কৃতি পেয়েছিল দৃঢ় ভিত্তি। এহেন দুটি পরস্পর-বিরোধী জীবনধারার সংঘাত ছিল অনিবার্য। আলবেরুণী স্বীকার করেছেন যে, মামুদ গজনির ধ্বংসাত্মক অভিযান এবং লুণ্ঠন হিন্দুদের কাছে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতাকে দারুণভাবে শিথিল করেছিল।

মহম্মদ হাবিব লিখেছেন যে, “হিন্দুরা ইসলামের দর্শনের প্রতি ততটা বীতশ্রদ্ধ ছিলেন না, যতটা ছিল মুসলমানদের রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি” (“It was not the principles of Islam they disliked but the manners and customs of the Mussalmans.”)। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ হিন্দুদের কঠোরতর রক্ষণশীলতার বর্মে আবৃত হতে প্ররোচিত করে। রঘুনন্দ, সায়ন, মাধবাচার্য, বিজ্ঞানেশ্বর প্রমুখ হিন্দু শাস্ত্রকার কঠোর অনুশাসনের মাধ্যমে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার বিধান দেন। সার্বিকভাবে হিন্দুদের দৃষ্টিতে মুসলমানদের ‘ম্লেচ্ছ’ হিসেবে তুলে ধরা হয়। অন্যদিকে মুসলমানরাও, বিশেষ করে গোঁড়াপন্থী উলেমারা, পৌত্তলিক হিন্দুদের ওপর রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ আরোপ করে বশীভূত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। এইভাবে একটি রক্ষণশীল শক্তি আর একটি রক্ষণশীল প্রতিপক্ষের উত্থান সহজ করে দেয়। ‘ম্লেচ্ছ’ মুসলমানদের সাথে ‘কাফের’ হিন্দুদের সামাজিক মিলন কিছুটা জটিল হয়ে ওঠে।

তুর্কি-আফগান যুগের প্রথম পর্বের এই সামাজিক চালচিত্র কালক্রমে পরিবর্তিত হয়। ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতকে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির এই বিরোধ ও বিচ্ছেদ ক্রমশ শিথিল হয়ে আসে। 

প্রথমত, এই সামাজিক বিরোধ মূলত উভয় সম্প্রদায়ের ওপর তলায় সীমাবদ্ধ ছিল। আমরা আগেই দেখেছি যে, নিম্নবর্ণীয় হিন্দুরা মুসলমানদের আগমন ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে উদাসীন ছিল। তেমনি সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেও সামাজিকভাবে হিন্দুদের সম্পর্কে বিদ্বেষ বা ঘৃণা আক্ষরিক অর্থে ছিল না। যেটুকু ছিল তার ভিত্তি ছিল রক্ষণশীলপন্থীদের নিরন্তর জেহাদের ফল। পরস্তু, হিন্দুধর্মের কঠোরতা, জাতিভেদ ইত্যাদি নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মনে, ইসলামের প্রতি এক সুপ্ত অনুরাগের জন্ম দিয়েছিল। মুসলমান সমাজের সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ নিম্নশ্রেণির হিন্দুদের কাছে সামাজিক উচ্চক্রমে উত্তরণের বিকল্প হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল। ফলে বৈষম্যভরা হিন্দুসমাজ থেকে নিস্তার লাভের আশায় স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এদের অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। অধ্যাপক আশরাফ লিখেছেন : “এইভাবে হিন্দু-ধর্মত্যাগীদের নিয়ে ইসলাম ধর্ম পুষ্ট হতে লাগল। এই জোয়ারের বিরুদ্ধে প্রতিকার হিসেবে ধর্মত্যাগী উচ্চবংশীয় হিন্দুদের স্বধর্মে প্রত্যাবর্তনের পথ খুলে দেওয়া হল। কিন্তু নিম্নবর্ণীয়দের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হল না। পরিণামে বহিরাগত ইসলামের গণতান্ত্রিক আদর্শ দ্বারা উদ্‌বুদ্ধ এই পতিত শ্রেণির হিন্দুরা ‘ভক্তিনির্ভর’ একটি উদার ও জনপ্রিয় ধর্মদর্শনের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হতে থাকে।”

দ্বিতীয়ত, অধ্যাপক মহম্মদ হাবিব দিল্লিতে সুলতানি শাসনের প্রতিষ্ঠাকে ‘উত্তর ভারতে নগর বিপ্লবের সূচনা’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, এই নগরায়ণের পশ্চাৎপটে সামাজিক উপাদান বিশেষ সক্রিয় ছিল। তাঁর মতে, তুর্কি শাসকরা প্রশাসনিক বা আর্থিক প্রয়োজনে নতুন নতুন শহর-নগর প্রতিষ্ঠা করে শহুরে শ্রমিকদের (city labours) মধ্যে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এতে আকৃষ্ট হয়েছিল হিন্দু-সমাজের নিম্নশ্রেণিভুক্ত অসংখ্য মানুষ। বস্তুত, সামাজিক বৈষম্যমুক্ত জীবনযাপনের আশায় এই সকল শ্রমজীবী হিন্দু (মুসলমানও ছিল) সুলতানি সাম্রাজ্যের সংস্কৃতির ও অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ়করণের বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। অবশ্য নগরায়ণে তুর্কি শাসকদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কোনো প্রভাব ছিল না। নিতান্তই বাস্তব প্রয়োজনবোধ, অর্থাৎ শত্রুভাবাপন্ন ভারতীয় (হিন্দু) রাজন্যবর্গ ও স্বতন্ত্র সামাজিক ধারা থেকে নিজেদের অস্তিত্ব সুরক্ষিত করার জন্য তুর্কি সুলতান ও প্রাদেশিক শাসকগণ স্বয়ংসম্পূর্ণ লোকালয় তৈরি করে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রকারান্তরে, তাঁদের এই উদ্যোগ একদিকে ভারতে নগর-বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল, অন্যদিকে হিন্দু-সমাজের বর্ণভেদ ও জাতিভেদ-প্রথার বিরুদ্ধে নিম্নবর্গীয় ও নিম্নবর্ণীয় মানুষদের আশ্রয় দিয়েছিল। ভারতীয় হিন্দু-সমাজের শতাব্দী-লালিত সামাজিক ভেদ ও বিচ্ছিন্নতাবোধকে সামান্যভাবে হলেও শিথিল করার কাজে এই ‘মিশ্র নগর-সভ্যতার অবদান অনস্বীকার্য।

তৃতীয়ত, সামাজিক ও আর্থসামাজিক কারণে বহু হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আবার বহু মুসলমান এক বিশেষ ধারণাবশত হিন্দু মহিলাকে বিবাহ করে। এই সকল ধর্মান্তরিত নারী-পুরুষ তাদের অতীতের আচার-আচরণ বা সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণভাবে ভুলে যেতে পারেনি। ফলে মুসলিম সমাজের মধ্যে হিন্দুরীতির নীরব অনুপ্রবেশ ঘটে। পূজা-পার্বণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই মিশ্র-সংস্কৃতির প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য এর দ্বারা ইসলাম সংস্কৃতির মৌল ধারার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কিন্তু উভয় সংস্কৃতির মধ্যস্থিত কৃত্রিম বিরোধের তীব্রতা হ্রাস পায় এবং উন্মুক্ত হয়।

চতুর্থত, ভারতীয় সমাজ ধর্মনির্ভর। স্বভাবতই ধর্মভাবনার রূপান্তরের ওপর সামাজিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা অনেকটাই নির্ভরশীল। ইসলামের সামাজিক সাম্যভাবনা এবং সুফিবাদী সাধকদের মানবিক আহ্বান হিন্দুদের চিন্তা ও চেতনায় আলোড়ন তোলে। এই কারণে হিন্দু ভক্তিবাদী আন্দোলনের ওপর ইসলামের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। ইসলামের সান্নিধ্যে আসার ফলেই হিন্দুদের ভক্তিযোগ দর্শনশাস্ত্রের সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে নতুনরূপে সমাজের অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া মানুষের বাস্তব জীবনের সাথে যুক্ত হতে পারে। ইসলামের অন্তর্নিহিত সত্য ভারতীয় সমাজে বৈপ্লবিক চেতনার সঞ্চার ঘটায়।