ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্য:

ভারতের বহির্বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্য। ভারত মহাসাগরের পথ ধরে ভারতীয় পণ্যের রপ্তানি ও বিদেশি পণ্যের আমদানির ইতিহাস খ্রিস্টপূর্ব কাল থেকে খুঁজে পাওয়া যায়। হরপ্পা সংস্কৃতির আমলে (খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০-২৭৫০ অব্দ) সিন্ধুনদের তীর থেকে ভারতীয় জলযান পারস্য উপসাগর পাড়ি দিয়ে মেসোপটেমিয়ার বন্দরে পৌঁছাত। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষ ভাগ থেকে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চিন-রোম বাণিজ্যে ভারত ও ভারত মহাসাগর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। চিনের বিশ্বখ্যাত রেশম বাণিজ্যে নিয়োজিত চিন ও রোমের বাণিজ্যপোতগুলি ভারতীয় বন্দরে এসে পণ্য বিনিময় করত। রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারত মহাসাগরে দূরপাল্লার বাণিজ্য কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে ইসলামের আবির্ভাব ও ক্রমপ্রসারের ফলে ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটে।

সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, ভারত মহাসাগরের পশ্চিম ও দক্ষিণ সীমা যথাক্রমে উত্তমাশা অন্তরীপ এবং দক্ষিণ মেরু অঞ্চল। লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগর ভারত মহাসাগরের অন্তর্ভুক্ত। তবে চিন সমুদ্র এর বৃত্তের বাইরে। ভারত মহাসাগরের উত্তরে আছে ভারত, পাকিস্তান, ইরান (পারস্য) ও আরব দেশ ; পশ্চিমে আফ্রিকা মহাদেশ; পূর্বপ্রান্তে মালয় উপদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ এবং দক্ষিণে অ্যান্টার্কটিকা।

খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে ইসলামের উত্থান ও প্রসার বিশ্বের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ভর করে আরবদেশ যেন দীর্ঘ নিদ্রা থেকে জেগে ওঠে ও নবজীবনের নতুন প্রাণশক্তিকে ভিত্তি করে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে। ইসলামের সম্প্রসারণকে কেন্দ্র করে ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। খ্রিস্টীয় বারো শতকে ধর্মযুদ্ধের (crusade) সময় থেকে ইউরোপে প্রাচ্যের দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। আরব ও তুর্কি শাসকদের জাঁকজমকপূর্ণ ও বিলাসবহুল জীবনধারা ইউরোপীয় শাসকদের আকর্ষণ করে। ফলে রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপের বি-নগরায়ণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তার অবসান ঘটে এবং এশিয়ার সাথে ইউরোপের বাণিজ্যে নতুন গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। এই সূত্রে অনিবার্যভাবে ভারত মহাসাগর বাণিজ্য-অর্থনীতির কেন্দ্রে চলে আসে।

মধ্যযুগের গোড়ায় ভারত মহাসাগর ও চিন সমুদ্রে বাণিজ্যের চরিত্রগত পরিবর্তন দেখা যায়। ভারতীয় ও চিনা দ্রব্যসামগ্রী মধ্য-এশিয়ার ভিতর দিয়ে স্থলপথে পাঠানো ছিল ব্যয়বহুল ও বিপজ্জনক। আদি-মধ্যযুগে এই চিরাচরিত পথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে চিন ও পারস্য উপসাগরের সাথে সপ্তম শতক থেকেই সামুদ্রিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। প্রথমদিকে পারসিকরা তাদের নিজ পণ্য নিজস্ব জাহাজে নিয়ে বাণিজ্য শুরু করে। অষ্টম শতক থেকে আরব বণিকেরা চিনের ক্যান্টন বন্দরে আসতে শুরু করে।

ভারতের কাপড়, মশলা ও বিলাসদ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে ভারতীয় উপকূলের সাথে আরব বণিকদের সম্পর্ক বাড়তে থাকে। ইহুদি, খ্রিস্টান ও পারসিক বণিকদের পাশাপাশি আরব বণিকরা পশ্চিম উপকূলে বসবাস শুরু করে। প্রাক্-মুসলমান যুগে এই প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং মুসলমান বিজয়ের পর এই প্রবণতা অনেক বৃদ্ধি পায়। আদি-মধ্যযুগে ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যে আরব বণিকদের প্রাধান্য থাকলেও, এটাই সমুদ্র বাণিজ্যের সম্পূর্ণ চিত্র নয়। একই সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে ভারত ও চিনের বাণিজ্যে সিংহলী ও করমণ্ডলের ক্লিং বণিকদের জাহাজগুলির বিশেষ ভূমিকা ছিল। দ্বাদশ শতকের চিনা সাক্ষ্য উল্লেখ করে ড. অনিরুদ্ধ রায় লিখেছেন যে, চিনের ‘জাঙ্ক’ জাহাজগুলি মাল পরিবহণ শুরু করার পরেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ভারত ও চিনের পণ্য নামত এবং হাতবদল হয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ত।

ভৌগোলিক অবস্থার প্রয়োজনে সারা মধ্যযুগে এশিয়ার সামুদ্রিক বাণিজ্য দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। একটি পূর্বদিকের এবং অন্যটি পশ্চিমদিকের বাণিজ্য। একই মৌসুমি বায়ুর ওপর নির্ভর করে চিন থেকে ইউরোপের বন্দরে যাওয়া যেত না। তাই পূর্ব ও পশ্চিমের জাহাজগুলি মাঝামাঝি কোনো বন্দরে অপেক্ষা করত পরবর্তী অনুকূল বায়ুপ্রবাহের জন্য। এখানেই উভয় প্রান্তের জাহাজগুলি মাল বিনিময় করে নিজ নিজ বন্দরে ফিরে যেত। ড. অনিরুদ্ধ রায় উল্লেখ করেছেন যে, দুটি ভিন্ন ধরনের জাহাজে দু-দিকের বাণিজ্য চলত। পূর্ব প্রান্তের জাহাজটিকে ‘জাঙ্ক’ বলা হয় এবং পশ্চিম প্রান্তের জাহাজটির নাম ছিল ‘ধাত্ত’। এগুলির নির্মাতা ছিল যথাক্রমে চিন ও আবর। ভারতীয় মহাসাগরের জাহাজগুলি ভূমধ্যসাগরীয় ও উত্তর ইউরোপীয় জাহাজগুলির তুলনার বড়ো ছিল। তবে ভারতীয় জাহাজগুলি পল্‌কা হলেও দড়িবাঁধা বলে ভারতীয় বন্দরের বড়ো বড়ো ঢেউ এদের ক্ষতি করতে পারত না।

ভারতের পশ্চিম উপকূলের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর ছিল মালাবারের কালিকট ও কোচিন এবং গুজরাটের সুরাট, ব্রোচ, ক্যাম্বে প্রভৃতি। এগুলি থেকে প্রাচ্যদেশগুলি ও ইউরোপের মধ্যে সমুদ্রবাণিজ্য চলত। চিনা সিল্ক, মাটির মাসন, সোনালি কলাই, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মশলা ইত্যাদি মালাবার উপকূলে আনা হত এবং সেখান থেকে জাহাজ বোঝাই করে পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগরের বন্দরগুলিতে নিয়ে যাওয়া হত। স্থলপথে কিছু পণ্য যেত বর্তমান সিরিয়ার অন্তর্গত এলোপ্পোতে এবং ইজিপ্টে। সেখান থেকে ইতালীয় (জেনোয়া, ভেনিস) বণিকরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চালান দিত। অধ্যাপক সতীশচন্দ্রের মতে, পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল, লোহিত সাগর ও পূর্ব আফ্রিকার বন্দরগুলির সাথে গুজরাটের বন্দরগুলির বিপুল বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। ভারত থেকে এইসব পণ্য সমুদ্রপথে বহন করে নিয়ে যেত মূলত আরব বণিকরা। পঞ্চদশ শতক থেকে এরা মালাবারে বসতি স্থাপন করে মালয় প্ৰণালী ও দক্ষিণ চিনের ক্যান্টন পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত থাকে। অবশ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইন্দো-পারস্য বাণিজ্যে ভারতীয়দেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। পঞ্চদশ শতকে মিশরের ‘করিম’ নামক একটি বাণিজ্য সংস্থা মিশর ও পশ্চিম ভারতের উপকূলের মধ্যে বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি ‘করিম’ বণিকদের গুরুত্ব কমে যায়। এখন হিন্দু বেনিয়া, মুসলিম বণিক, ইহুদি, আর্মেনীয় প্রভৃতি নানা জাতি ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যে লিপ্ত হয়। বলা বাহুল্য, সমুদ্র বণিকদের যথেষ্ট আর্থিক সচ্ছলতা ছিল। একাদশ শতকে এডেন থেকে ভারত ও চিনের মধ্যে বাণিজ্যে জনৈক ইরানীয় বণিক যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলেন। ত্রয়োদশ শতকে ইব্রাহিম টিবে নামক জনৈক পারসিক বণিক প্রায় একশো জলযান নিয়ে ভারতীয় উপকূলে পৌঁছেছিলেন। গুজরাটি বণিকদের অর্থসম্পদ ও প্রতিপত্তি ছিল আকর্ষণীয়। বহু ভারতীয় বণিক পারস্য উপসাগরে হরমুজ, ওমান, বসরা প্রভৃতি বন্দরে বসতি স্থাপন করে সমুদ্র-বাণিজ্যে অংশ নিতেন। আফ্রিকার মোম্বাসা, মালিন্দিপেত, কিলাওয়া প্রভৃতি বন্দরেও ভারতীয় বণিকদের উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল।

অষ্টম শতকে সিন্ধুদেশের ওপর আরবদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হলে ভারতের সমুদ্র বাণিজ্যে গতি আসে। ইতিমধ্যে পারস্য উপসাগরের ওপর আরবদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়েছিল। এখন সিন্ধু তাদের দখলে এলে ভারতের পশ্চিম উপকূল ও পারস্য উপসাগর একই রাজনৈতিক বৃত্তের মধ্যে চলে আসতে পারে। ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসে (মগধ, ১৯৮১ খ্রিঃ) সভাপতির ভাষণে অধ্যাপক ওমপ্রকাশ বলেছেন যে, ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলি চিরদিনই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত ক্যাম্বের ব্যস্ততা ছিল চূড়ান্ত। ক্যাম্বের গুরুত্ব হ্রাস পেলে পশ্চিম উপকূলে সুরাট ও দিউ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। লোহিত সাগরের উপকূল বন্দরের সাথে এই দুটি বন্দরের বাণিজ্যিক যোগ ছিল বেশি। এ ছাড়া চাউল, দাভোল, ভাটকল, কালিকট, পুলিকট, নেগাপত্তম্ প্রভৃতি বন্দর থেকে ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যতরী লিপ্ত ছিল। পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে বাংলার সাতগাঁ, চট্টগ্রাম ও শ্রীপুর বন্দর সমুদ্র-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সিন্ধুর লাহোরি বন্দরটিও এই কারণে একদা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

ইউরোপীয় লেখকদের ব্যাখ্যানুযায়ী ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যে ভারতীয় বণিকরা ছিল আর্থিকভাবে দুর্বল। এশীয় জাহাজগুলি ছিল হাল্কা ও অনুন্নত এবং আমদানি-রপ্তানি দ্রব্যের মূল অংশ দখল করেছিল বিলাস সামগ্রী। কিন্তু এমন ধারণা ভ্রান্ত। ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যে দৈনন্দিন জীবনের অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের লেনদেন ঘটত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির খাদ্যে ঘাটতি ছিল। সেখানে চাল উৎপাদন হত কম। আবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে বস্ত্র, চিনি ইত্যাদির যথেষ্ট চাহিদা ছিল। স্বভাবতই ভারত থেকে রপ্তানি হত বিপুল পরিমাণ বস্তু। মালয়, আরব ও ইন্দোনেশিয়ার ভারতের মোটাবস্ত্রের বড়ো বাজার ছিল। ইউরোপের দেশগুলিতে চাহিদা ছিল ভারতীয় সূক্ষ্ম বস্ত্রের। এ ছাড়া রপ্তানি হত চাল, ডাল, গম, তেল ইত্যাদি। খাদ্যশস্য বেশি যেত মালাক্কা, হরমুজ ও এডেনে। বাংলা থেকে রপ্তানি হত কাঁচা রেশম ও চিনি, গুজরাট থেকে যেত কাঁচা তুলো, মালাবার পাঠাত নানারকমের মশলা। ভারতে আমদানি করা হত সোনা, রূপা, মালয়ের টিন, পূর্ব আফ্রিকার হাতির দাঁত, মদ, গোলপজল, ফল ও ঔষধ।