সূচনা: ভারতে সুলতানি শাসনকালে রাজকীয় জমি ছােটোবড়াে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে মর্যাদা অনুসারে মুসলিম অভিজাতদের মধ্যে বিলি করা হত। এটি ‘ইক্তা ব্যবস্থা’ নামে পরিচিত। সুলতানি আমলে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের অস্তিত্ব থাকলেও এই ইক্তা ব্যবস্থাকে ভিত্তি করেই সুলতানি শাসনব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো গড়ে ওঠে।
[1] ইক্তা ব্যবস্থা: আক্ষরিক অর্থে ‘ইত্তা’ বলতে ‘এক অংশ বােঝায়। ইতিহাসবিদ কে. এ. নিজামি লিখেছেন, “ভারতের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য দিল্লির প্রথম দিকের তুকী সুলতানগণ বিশেষ করে ইলতুৎমিস ইত্তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। “কিন্তু পরবর্তীকালে বিভিন্ন সুলতানের আমলে ইক্তা ব্যবস্থায় নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সুলতানি যুগে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামােরই আত্মপ্রকাশ ঘটে।
[2] ইক্তা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য: ইক্তা ব্যবস্থায় সামৰ ন্ত্রিক ধাঁচের কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। এগুলি হল— [i] এই ব্যবস্থার দ্বারা সুলতান তাঁর ‘খালিসা’ জমির বাইরে অবস্থিত জমিগুলি নির্দিষ্ট শর্ত ও কর্তব্য পালনের বিনিময়ে তার সেনাধ্যক্ষ, সৈনিক ও অভিজাতদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। [ii] বিনিময়ে ইক্তাদার বা ‘মাকৃতি নামে ইক্তাতার প্রাপকরা সুলতানকে প্রয়ােজনে সৈন্য সরবরাহ করতেন। [iii] সুলতানের হয়ে মাকৃতি তার ইক্তা এলাকায় স্থানীয় আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ও কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন।
[3] ইক্তা প্রথার বিবর্তন: ইলতুৎমিসের পরবর্তীকালে কোনাে কোনাে সুলতানের পদক্ষেপে ইক্তা ব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক কাঠামােটি আরও জোরদার হয়ে ওঠে। [i] বলবন ইক্তার হিসাব রক্ষা ও কেন্দ্রের প্রাপ্য অর্থ কঠোরভাবে আদায় করার নীতি নেন। [ii] আলাউদ্দিন খলজি ইত্তা ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করলেও গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের আমলে নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে। [iii] বিন তুঘলক সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব প্রদানে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে ইক্তার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেন। [iv] এরপর ফিরােজ তুঘলক ইক্তা ব্যবস্থায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করে এই প্রথাকে বংশানুক্রমিক করে দেন। এভাবে ইত্তা প্রথায় সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।
[4] সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা: ভারতে সুলতানি যুগে ইউরােপের সামন্ততান্ত্রিক পিরামিড কাঠামাের বিভিন্ন স্তর বিন্যাস লক্ষ করা না গেলেও সুলতানের কাছ থেকে ইস্তার জমি লাভের পর ইত্তাদাররা নিজ নিজ ইক্তা-অঞ্চলে সামন্তপ্রভুদের মতােই স্বাধীনভাবে প্রশাসন পরিচালনা করতেন। এভাবে ইক্তা প্রথার মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা লুকিয়েছিল।
উপসংহার: পরবর্তীকালে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ইক্তাদাররা দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসনকে অগ্রাহ্য করতে থাকে। ফলে সুলতানি শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দেশের বিভিন্ন অংশে এই ইক্তাদাররাই স্বাধীন সামন্তপ্রভুর ভূমিকা গ্রহণ করে শাসন শুরু করেন। ইত্তা ব্যবস্থার কাঠামােটি থেকে পরবর্তী মােগল আমলে সামন্ততান্ত্রিক ধাঁচের জায়গিরদারি ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটে।
Leave a comment