মহম্মদ ঘুরির বিশ্বস্ত অনুচর ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ-বিন্-বখতিয়ার খলজি আনুমানিক ১২০৩ ০৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে বাংলাদেশের একাংশে মুসলমান শাসনের সূচনা করেন। তবে দিল্লি-সুলতানির গৌরবোজ্জ্বল দিনেও বাংলাদেশ দিল্লি-অধীনতামুক্ত থেকে নিজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেছে। বাংলার শাসকেরা কখনো দিল্লির দোর্দণ্ডপ্রতাপ সুলতানের প্রতি নিছক মৌখিক আনুগত্য মাত্র জানিয়ে ; কখনো বা সুলতানকে আপসমুখী মনোভাব গ্রহণে বাধ্য করে নিজেদের প্রায় স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন। বিদ্রোহী বাংলার এই স্বতন্ত্র অস্তিত্বের অন্যতম কারণ হল দিল্লি থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব, জলবায়ুর পার্থক্য এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা। তখন দিল্লির সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল নদীপথ। কিন্তু এই জলপথ তুর্কিদের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। তাই দিল্লির ক্ষমতাবান সুলতানরাও বাংলাদেশের ওপর সরাসরি খবরদারি করার ইচ্ছাকে চেপে রাখতে বাধ্য হয়েছেন। অবশ্য প্রথমদিকে দিল্লির প্রতি মৌখিক আনুগত্য জানালেও শেষ পর্যন্ত, বাংলাদেশে স্বাধীন সুলতানির প্রতিষ্ঠাই ঘটেছিল।
বাংলাদেশে বখতিয়ার খলজির শাসন মোটামুটি দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের বীরভূম জেলা ও উত্তর-পূর্ব বাংলার দিনাজপুর জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ১২০৩ থেকে ১২০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বাংলায় শাসন-সংগঠনে ব্রতী ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তিনি তিব্বতদেশে এক দুঃসাহসিক অভিযানে অগ্রসর হন এবং ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। ইতিমধ্যে তাঁর অনুচরদের কেউ কেউ ক্ষমতালোভী হয়ে উঠেছিলেন। এবং এমনই এক অনুচর আলিমর্দান ঘুমন্ত অবস্থায় অসুস্থ বখতিয়ারকে হত্যা করেন (১২০৬ খ্রিঃ)। একই বছরে মহম্মদ ঘুরিরও মৃত্যু হয়। ফলে তুর্কি-অধিকৃত ভারতবর্ষে উচ্চাকাঙ্ক্ষী আমিরদের মধ্যে ক্ষমতাদখলের লড়াই অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে। বখতিয়ারের হত্যাকাণ্ডের গ্রহণের উদ্দেশ্যে তাঁর আর এক অনুচর ইজউদ্দিন মহম্মদ শিরান খলজি আলিমর্দানকে আক্রমণ ও বন্দি করেন। ইতিমধ্যে ঘুরির অন্যতম অনুচর কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লির সিংহাসন দখল করে স্বাধীন সুলতানির সুচনা করেছেন। শিরান দিল্লির প্রতি মৌখিক আনুগত্য দেখান। কিন্তু বন্দি আলিমর্দান কারাগার থেকে পালিয়ে গিয়ে শিরানের বিরুদ্ধে কুতুবউদ্দিনকে প্ররোচিত করেন। শিরানকে বিতাড়িত করে কুতুব জনৈক আইওয়াজ খলজিকে দেবকোটের (বাংলা) শাসক নিযুক্ত করেন। কিছুদিন পরে আইওয়াজের পরিবর্তে আলিমর্দান বাংলার দায়িত্ব পান (১২১০ খ্রিঃ)। কুতুবউদ্দিনের জীবদ্দশায় আলিমর্দান দিল্লির বশ্যতা মেনে চলেন। তবে কয়েক মাসের মধ্যে কুতুবউদ্দিন মারা গেলে আলিমদান দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করেন এবং ‘আলাউদ্দিন’ নাম নিয়ে স্বাধীন সুলতানি শুরু করেন। তিনি মাত্র দু-বছর বাংলা শাসন করেন। তিনি ছিলেন ন্যায়নীতিবর্জিত নিষ্ঠুর রাজনীতিক। তাঁর শাসনকাল ছিল স্বৈরাচারী, নির্মম ও আতঙ্কে পূর্ণ। অবশেষে খলজির আমিররা সংঘবদ্ধ হয়ে আলিমর্দানকে হত্যা করেন। লক্ষ্মণাবতী বা লখনৌতির সিংহাসনে বসেন হুসামউদ্দিন আইওয়াজ খলজি (১২১৩ খ্রিঃ)। ইনি গিয়াসউদ্দিন আইওয়াজ নামে পরিচিত হন। গিয়াসউদ্দিন চৌদ্দ বছর (১২১৩-‘২৭ খ্রিঃ) বাংলা শাসন করেন। তাঁর আমলে দেবকোটের গুরুত্ব কমে যায় এবং লখনৌতি রাজধানীর গুরুত্ব অর্জন করে।
বাংলার খলজি শাসকদের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর রাজত্বকাল ছিল বাংলার শান্তি ও সমৃদ্ধির কাল। মুসলমান শাসকদের মতে, তিনিই প্রথম নদীমাতৃক বাংলাদেশে রণতরীর উপযোগিতা বুঝতে পারেন ও একটি নৌবহর নির্মাণ করেন। নবপ্রতিষ্ঠিত রাজধানীর নিরাপত্তা ও নৌ পরিবহণ বৃদ্ধির প্রয়োজনে তিনি একাধিক খাল খনন করেন, সেতু ও বাঁধ নির্মাণ করেন। শেষ পর্যন্ত গিয়াসউদ্দিন নিজেকে ‘স্বাধীন সুলতান’ বলে ঘোষণা করেন এবং নিজ নামে ‘খুৎবা পাঠ করেন ও ‘মুদ্রা’ প্রচলন করেন। আব্বাসিদ খলিফা আল্ নাসিরীর কাছ থেকে সম্মানসূচক অনুমোদনও লাভ করেন। দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস গিয়াসউদ্দিনকে দমন করার উদ্দেশ্যে ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা অভিযান করেন। গিয়াসউদ্দিন ইলতুৎমিসের বশ্যতা স্বীকার করে নেন এবং তাঁর নামে খুৎবা পাঠ করতে ও মুদ্রা উৎকীর্ণ করতে রাজি হন। সুলতান বাংলা থেকে ৮ লক্ষ টাকা ও ৩৮টি হাতি উপহার পান। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করেন এবং বিহার থেকে দিল্লির প্রতিনিধি আলাউদ্দিন জানিকে বিতাড়িত করেন। অবশেষে ইলতুৎমিসের নির্দেশে তাঁর পুত্র নাসিরউদ্দিন বাংলা আক্রমণ করে গিয়াসউদ্দিনকে পরাজিত ও হত্যা করেন।
Leave a comment