মার্কোপোলো, আব্দুর রজ্জাক, নিকলো কন্টি, নিকিতন প্রমুখ বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ থেকে দক্ষিণ ভারতের বন্দর, বণিক ও সমৃদ্ধ বাণিজ্যধারার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনদিক সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় এবং সরাসরি কোনো স্থলপথ না-থাকায় দক্ষিণ ভারতীয় বাণিজ্যের কেন্দ্রে ছিল সমুদ্রবাণিজ্য। দক্ষিণ ভারতীয় উপদ্বীপের ছোটো-বড়ো অসংখ্য উপকূল বন্দর ছিল এই বাণিজ্যের উৎসকেন্দ্র। এই বন্দরসমূহকে অবস্থানগত ভাবে পাঁচটি বর্গে (Group) ভাগ করা যায়, যেমন—কোঙ্কন, তুলুনাদ, মালাবার, করমণ্ডল (মাবার) এবং তেলেঙ্গানা বর্গ। এদের মধ্যে কোঙ্কন বর্গ মহারাষ্ট্রের অন্তর্গত। আমাদের আলোচনা পরবর্তী চারটি বর্গ সম্পর্কে।
তুলুনাদ বর্গের বিস্তৃতি উত্তরে গোয়া থেকে দক্ষিণে মাউন্ট দেল্লি পর্যন্ত। এই বর্গের কয়েকটি ব্যক্ত বন্দর হল মিরজান, হোন্নাভার, ভাটকল, বসরুর, ম্যাঙ্গালোর ইত্যাদি। পর্যটক বারবোসা গোয়া বন্দরের নাগরিক বৈশিষ্ট্য ও বাণিজ্যিক ব্যস্ততার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁর আগমনকালে গোয়া বন্দরে মুর বণিকদের সংখ্যাধিক্য ছিল, যাদের অনেকেই ছিল বহিরাগত। শহরটি ছিল উঁচু প্রাচীর-বেষ্টিত এবং সুদৃশ্য গৃহ, দুর্গ শোভিত। শহরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছিল বিস্তীর্ণ উর্বর ভূমি, মিষ্ট ফলের বাগিচা ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের কূপ। বিজয়নগর রাজ্যের আমদানি দ্রব্যের মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল উন্নতমানের ঘোড়া। ঘোড়া আমদানির প্রধান কেন্দ্র ছিল এই গোয়া বন্দর। ওরমুজ থেকে ঘোড়া বোঝাই জাহাজগুলি গোয়া বন্দরে ভিড়ত। বিজয়নগর ও দাক্ষিণাত্যের বণিকরা এদের কিনে নিতেন। বিনিময়ে ওরমুজের জাহাজগুলি গোয়া থেকে প্রচুর পরিমাণ চাউল, চিনি, লোহা, আদা, গোলমরিচ, মশলা ও ঔষধি বোঝাই করে ফিরে যেত। মক্কা ও এডেন থেকেও গোয়াতে জাহাজ আসত। চাউল, মালাবার, দাভোল থেকে ছোটো ছোটো নৌকা এখান থেকে পণ্য সংগ্রহ করে নিয়ে যেত।
গোয়া বন্দর তুলুনাদ বর্গের শুরুর মুখে অবস্থিত হলেও, এই বর্গের প্রথম বন্দর ছিল মিরজান। একই নামের নদীর তীরে মিরজান বন্দর-শহরটি গড়ে উঠেছিল। মালাবারের ‘জাম্বুকোস’ (zambuquos) নামক জাহাজগুলি এখানে নারকেল, নারকেল তেল এবং তালমিছরি ইত্যাদি পৌঁছে দিত। এর বদলে কালো মোটা দানার চাল নিয়ে ফিরে যেত। হোন্নাভার ও মালাবারের মধ্যে কালো চাল, নারকেল, নারকেল তেল, তালমিছরি এবং তাড়ি (palm-wine) ইত্যাদি বাণিজ্য চলত। ভাটকল ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর শহর। পর্যটক বার্থেমা (Verthema) লিখেছেন, “ভাটকল ভারতের একটি মহতীনগর…..প্রাচীর বেষ্টিত, সুদৃশ্য এবং সমুদ্র থেকে মাত্র এক মাইলের মধ্যে অবস্থিত ” (“Bathacale was a very noble city of India……walled and very beautiful and almost a mile distant from the sea. “)।
বারবোসা ভাটকল শহরের বর্ণনা প্রসঙ্গে এটিকে জনবহুল, সুদৃশ্য বাগিচা, উর্বর কৃষিক্ষেত্র এবং বিশুদ্ধ জল সমৃদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন। মুর (Moor) ও জেন্টিল (Gentiles) বণিকদের বসতি গড়ে উঠে এই শহরে। এখান থেকে ওরমুজে রপ্তানি হত প্রধানত সাদা চাল গুঁড়ো চিনি ও লোহা। আরব ও পারস্যের মুর বণিকদের কাছে হরীতকীর বিশেষ চাহিদা ছিল। মুরদের মক্কাগামী জাহাজে নানা ধরনের মশলা নিয়ে যাওয়া হত। মালাবারের বণিকরা এখান থেকে লোহা ও চিনি কিনতেন। ওরমুজের জাহাজগুলি প্রতিবছর ভাটকল বন্দরে নিয়ে আসত প্রচুর সংখ্যক ঘোড়া ও মুক্তা। মালাবারের বণিকেরা এখানে আনত তালমিছরি, নারকেল, নারকেল তেল, তাড়ি, প্রচুর পরিমাণে গোমরিচ এবং ঔষধ। বারবোসা ভাটকলে আমদানি পণ্য হিসেবে এ ছাড়াও মুদ্রা ও রান্নার সরঞ্জাম তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় তামা ও পারদ, সিন্দুর, প্রবাল, ফটকিরি, হাতির দাঁত ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন।
‘হোন্নাভার’ (Honnavar) শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘একটি সোনার গ্রাম’ (a golden village)। পর্যটক পিয়েত্রো ডেলা ভেল (Pietro Della Valle) ১৬২৯ খ্রিস্টাব্দে এই বন্দরের বর্ণনা প্রসঙ্গে লেখেন যে, সমুদ্রতীরবর্তী এই ছোট্ট এলাকাটিকে উত্তর-দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত দুটি নদী যেন দুই বাহু দিয়ে ঘিরে রেখেছে। নদী দুটি দুর্গের কাছে এসে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। হোন্নাভার শহরের পাশে প্রবাহিত শরাবতী (সরস্বতী) নদীতে ২০০ থেকে ৩০০ টনের জাহাজ ভিড়তে পারে। জনৈক ওলন্দাজ লেখকের বিবরণী থেকে জানা যায় যে, এই ব্যস্ত বন্দরটি ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে পোর্তুগিজ বণিকদের অসহযোগিতার ফলে যথেষ্ট গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিল।
সমুদ্র উপকূলবর্তী আর একটি ব্যস্ত বন্দর শহর ছিল বাসরুর (Basrur)। প্রাচীন কুণ্ডাপুর নদীর খাতের ধারে অবস্থিত এই বন্দর থেকে আরব ও মিশরের সাথে বাণিজ্য চলত। ওলন্দাজরা এই নদী খাতের এক মাইলের মধ্যে একটি কুঠি ও দুর্গ নির্মাণ করে এখান থেকে চাল ক্রয়-বিক্রয় করত। পোর্তুগীজরা এখান থেকে গোয়ার জন্য চাল নিয়ে যেত। ছয় থেকে আটটি পোর্তুগীজ বাণিজ্যপোত এখান থেকে মাস্কটে চাল নিয়ে যেত এবং সেখান থেকে আমদানি করত ঘোড়া, খেজুর, মুক্তা ইত্যাদি আরবদেশীয় পণ্য। বাসরুর শহরটি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। পিয়েত্রো ডেলা ভেল উচ্চ-বাসরুর শহরের বৃক্ষশোভিত প্রশস্ত রাজপথের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বারকুর ও বাসরুর থেকে মালাবার, ওরমুজ, এডেন, জায়ের প্রভৃতি স্থানে খোসা ছাড়ানো সরু চাল রপ্তানি হত। আমদানি হত নারকেল, নারকেল তেল, তামা, গুড় ইত্যাদি।
ম্যাঙ্গালোর বন্দর কানাড়া অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল বলে আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন মন্তব্য করেছেন। ম্যাঙ্গালোর থেকে এডেন ও মালাবারে কালো চাল ও গোলমরিচ রপ্তানি হত। কুম্বলা (Kumbla) থেকে মালদ্বীপ ও মালাবার যেত কালো চাল। মালদ্বীপ থেকে আমদানি করা হত নারকেল ছোবড়ার দড়ি। কালো চাল সস্তা হওয়ায় মালাবারের লোকেরা তা সহজে ক্রয় করতে পারত।
মালাবার বর্গের বিস্তৃতি ছিল উত্তরে মাউন্ট দেল্লি থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারিকা। মালাবার বর্গের উল্লেখযোগ্য বন্দরগুলি হল কোচিন, কান্নানোর, কালিকট, কায়নকোলম, কুইলন প্রভৃতি। এই বর্গের বন্দরগুলিতে তুলুনাদ বর্গের তুলনায় বেশি বাণিজ্য চলত। এই বর্গের প্রধান বন্দর কোচিনের সাথে আফ্রিকা, ইউরোপ, আরবদেশ, পারস্য, সিংহল ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছয়টি অঞ্চলের বাণিজ্য-সম্পর্ক ছিল। পূর্ব-আফ্রিকার সোফালা, মোজাম্বিক, মোম্বাসা প্রভৃতি বন্দরগুলিতে এখান থেকে রপ্তানি হত বস্ত্রাদি, মশলা ও ভেষজ দ্রব্য। আফ্রিকা থেকে আমদানি পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল সোনা, হাতির দাঁত, আবলুস কাঠ এবং ক্রীতদাস। ইউরোপের সাথে দক্ষিণ ভারতের বাণিজ্য পরোক্ষভাবে চলত লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগরের মাধ্যমে। লিসবন থেকে জাহাজগুলি কোচিন বা গোয়া বন্দর পৌঁছাত। এরা নিয়ে আসত রূপা ইত্যাদি ধাতু ও অন্যান্য বিলাস সামগ্রী। ফেরার পথে জাহাজগুলি নিয়ে যেত গোলমরিচ, সুস্বাদু মশলা, ভেষজ দ্রব্য ইত্যাদি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। এখানকার যে সকল শহরে ভারতীয় পণ্যের কদর ছিল, তাদের অন্যতম হল মালাক্কা, জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিও ইত্যাদি। মালাক্কা থেকে ভারতে আমদানি হত পোর্সিলিন, কর্পূর, সুগন্ধি ইত্যাদি। জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিও থেকে আসত সোনা, গোলমরিচ। মলুক্কা, বান্দা ইত্যাদি বন্দর থেকে আসত লবঙ্গ, জায়ফল ইত্যাদি। ভারত থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রপ্তানি পণের মধ্যে ছিল বস্ত্রাদি, মশলা ও বিভিন্ন ধরনের ভেষজ। পারস্যের প্রধান সমুদ্র বন্দর ছিল ওরমুজ। মালাবার উপকূল বন্দরগুলি থেকে এখানে রপ্তানি করা হত সুতির জামাকাপড়, চিনি, গোমরিচ ও অন্যান্য মশলা। অন্যদিকে মালাবারে আমদানি করা হত রৌপ্য মুদ্রা, ঘোড়া, রেশমবস্ত্র ইত্যাদি। আরবদেশের অন্যতম প্রধান ছিল এডেন, মোচা ও জেদ্দা। লোহিত সাগরের তীরবর্তী এই বন্দরগুলিতে ভারত থেকে রপ্তানি করা হত নানারকম মশলা, সুতিবস্ত্র ও ভেষজ দ্রব্য। আরবীয় বন্দরগুলি থেকে ভারতীয় পণ্য ভূমধ্যসাগরের পথ ধরে বা স্থলপথে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে চালান যেত। কান্নানোর বা (কান্নানুর) এর বণিকরা যথেষ্ট ধনী এবং ব্যক্তিগতভাবে জাহাজের মালিক ছিলেন বলে বারবোসা উল্লেখ করেছেন। পর্যটক বার্থেমার বিবরণ অনুসারে প্রতিবছর এই বন্দর থেকে অন্তত ২০০টি জাহাজ দেশের মধ্যে ও বিদেশে বাণিজ্যপণ্য নিয়ে চলাচল করত। বারবোসার বিবরণ মতে, ধর্মপত্তনম্-এর বণিকেরাও যথেষ্ট ধনী ও জাহাজের মালিক ছিলেন। এখান থেকে সিংহলে চাল রপ্তানি করা হত এবং আমদানি করা হত মণিমুক্তা।
মালাবার বর্গের ব্যস্ততম ও জনপ্রিয় বন্দরটি ছিল কালিকট। বারবোসা, আব্দুর রজ্জাক, নিতিন প্রমুখ বহু পর্যটক কালিকট বন্দরের প্রশংসা করেছেন। ভাস্কো-দা-গামার নেতৃত্বে পোর্তুগীজরা কালিকট বন্দরে উপস্থিত হলে (১৪৯৮ খ্রিঃ) ইউরোপের সাথে দক্ষিণ-ভারতের নির্ভরযোগ্য সমুদ্রপথ আবিষ্কৃত হয়। কালিকটের শাসক জামোরিন বণিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ফলে দেশীয় বণিকদের পাশাপাশি বিদেশি বণিক ও প্রযুক্তিবিদরা এখানে এসে বসবাস শুরু করে। বণিকদের কাছে কালিকটের আকর্ষণের আর একটি কারণ হল এর নিরাপত্তা। বিদেশিদের জন্য জামোরিন ‘দেহরক্ষী’ (নায়রে) এবং ‘হিসাবরক্ষক’ (চাতিম)-এর বন্দোবস্ত করতেন। বিদেশি বণিকেরা বন্দরে পণ্য নামিয়ে নিশ্চিন্তে যে কোনো জায়গায় চলে যেতে পারতেন। পণ্য হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত সরকার স্বতঃপ্রণোদিত ভাবেই সেগুলির তত্ত্বাবধান করত। কালিকট থেকে প্রতিবছর ১০-১৫টি জাহাজ গোলমরিচ, আদা, এলাচ, দারুচিনি, হরীতকী, তেঁতুল এবং দামি পাথর, মুক্তা, কস্তুরী, ঘৃতকুমারী, কার্পাসবস্ত্র, পোসিলিন ইত্যাদি পণ্যদ্রব্য লোহিত সাগর, এডেন, মক্কা ও জেড্ডাতে নিয়ে যেত। জেড্ডার বণিকরা আবার ওইসব পণ্য কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া, ভেনিস প্রভৃতি বন্দরে পৌঁছে দিত। কালিকটের জাহাজগুলি জেড্ডা থেকে আমদানি করত তামা, পারদ, সিন্দুর, প্রবাল, জাফরান, গোলাপজল, রঙিন ভেলভেট, সোনা, রূপা ইত্যাদি। চিন, জাভা, সিংহল, মালদ্বীপ, ইয়েমেন ইত্যাদি দেশের জাহাজ নিয়মিত কালিকট বন্দরে পৌঁছাত বলে নিকলো কন্টি, আব্দুর রজ্জাক প্রমুখ উল্লেখ করেছেন। নিকলো কন্টি কালিকট বন্দরকে ‘A noble emporium for all India” বলে প্রশংসা করেছেন। গোলমরিচ, লাক্ষা, আদা, দারুচিনি, হরীতকী ইত্যাদির প্রচুর জোগান কালিকট বন্দরের ব্যস্ততা ও সমৃদ্ধির প্রধান কারণ ছিল।
দক্ষিণ ভারতের শেষ প্রান্তে অবস্থিত কুইলন বন্দরের সাথে বহুকাল থেকেই দূরপ্রাচ্য এবং বিশেষ করে চিনের সাথে বাণিজ্যসম্পর্ক ছিল। চিনা বণিকরা পশ্চিম দেশগুলিতে বাণিজ্যপণ্য নিয়ে যাওয়ার সময় কুইলন বন্দরে কিছুটা সময় কাটাতেন। এখানকার মূল ও হিন্দু বণিকদের প্রভূত সম্পদ ও নিজস্ব বাণিজ্যপোত ছিল। কুইলনের প্রধান বাণিজ্যপণ্য ছিল গোলমরিচ। এ ছাড়াও নানা ধরনের পণ্য এখান থেকে বণিকেরা সিংহল, করমণ্ডল উপকূল, বাংলা (Bengal), মালাক্কা, পেগু, সুমাত্রা প্রভৃতি দেশে চালান দিত।
পূর্ব উপকূলে ছিল মাবার (করমণ্ডল) ও তেলেঙ্গানা বর্গের বন্দরগুলি। পূর্ব উপকূলের বন্দরগুলির সমুদ্র-বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল তুলনামূলক ভাবে কম। এখানে বন্দরের সংখ্যাও কম। করমণ্ডল বর্গের প্রধান বন্দর ছিল কায়েল, নেগাপত্তনম্, মাইলাপুর ও পুলিকট। এই বন্দরসমূহ থেকে সিংহল, ব্রহ্মদেশ, মালাক্কা, সুমাত্রা, চিন প্রভৃতি দেশের সাথে বাণিজ্য চলত। ফ্রেডারিক বারবোসা ‘কায়েল’ (Cael) বন্দরকে মণিমুক্তার বাণিজ্যের জন্য খ্যাত বলে উল্লেখ করেছেন। কায়েল-সহ করমণ্ডল বর্গের বণিকদের ‘চার্টিস’ (Chatis) বা ‘শেষ্ঠি (Setti) বলা হত। মালাবার ও বেঙ্গালা থেকে বাণিজ্য জাহাজ কায়েল বন্দরে আসত। বারবোসার বিবরণ মতে, পূর্বে উপকূলে কেবল মাইলাপুর ও পুলিকট বন্দর বিজয়নগর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মালাবারের জাহাজগুলি এখান থেকে চাল সংগ্রহ করত। চাল ব্যবসা বেশ লাভজনক ছিল। এ ছাড়া, ক্যাম্বে থেকে আসত তামা, পারদ, সিন্দুর, গোলমরিচ ইত্যাদি। মালাক্কা, চিন ও বেঙ্গালা থেকে আসত নানা ধরনের মশলা ও ভেষজ দ্রব্য। আদি-মধ্যযুগে মাইলাপুর বন্দর হিসেবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। উত্তর প্রান্তে পুলিকট এই সময় বন্দর হিসেবে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। সমুদ্রপথ ছাড়া স্থলপথেও এখানে কিছু বণিকের যাতায়াত ছিল। পুলিকট থেকে মালাক্কা, পেণ্ড, সুমাত্রা, মালাবার ও গুজরাটে ছাপা সুতিকাপড় রপ্তানি হত। ক্যাম্বে, মক্কা, মালাবার থেকে এখানে আমদানি করা হত তামা, পারদ, ভেলভেট, গোলাপজল ইত্যাদি।
তেলিঙ্গানা বর্গের প্রধান দুটি বন্দর ছিল মতুপল্লী ও মসুলিপত্তনম্। মতুপল্লীর বণিকরা প্রধানত মুক্তা, গোলাপজল, চন্দনকাঠ, চিনাকপুর, হাতির দাঁত, কর্পূর তেল, তামা, দস্তা, সিসা, সিল্ক, প্রবাল, সুগন্ধি, গোলমরিচ ইত্যাদির বাণিজ্য করত। মার্কোপোলো এই দুটি বন্দরকেই সুন্দর ও বৃহদাকার হীরের জন্য বিখ্যাত ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। মতুপল্লীর শাসকেরা বহিরাগত বণিকদের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি যত্নবান ছিলেন। ১২৪৫ খ্রিস্টাব্দে কাকতীয় গণপতিদের এবং অন্নপোতা রেড্ডী এক সরকারি সনদ (অভয়-শাসন) দ্বারা সমুদ্র বণিকদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেন এবং শোষণমূলক শুল্কগুলি বাতিল করে দেন।
Leave a comment