সুলতানি আমলে ইক্‌তা ব্যবস্থা:

দিল্লি-সুলতানির সূচনাকালে আর্থিক বা প্রশাসনিক সংগঠন ছিল না। এই সময় প্রধানত উপঢৌকন বা লুটপাট দ্বারা সুলতান অর্থসংগ্রহ করতেন। রাজ্যবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির পরিবর্তন আসে। ক্রমে সুলতানরা কৃষকের উদ্‌বৃত্ত উৎপাদনের একাংশ কর হিসেবে দাবি করতে শুরু করেন। ভূমিরাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি হিসেবে ‘ইক্‌তা’ ব্যবস্থার প্রচলন হয়।

আক্ষরিক অর্থে ‘ইক্‌তা’বলতে বোঝায় ‘এক অংশ’। কিন্তু আসলে এটি ছিল এক ধরনের ভূমিদান –ও ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত ব্যবস্থা,—যা একজন শাসক ও বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে সম্পাদিত হত। ড. নিজামী লিখেছেন : “ইসলামের উত্থানের সূচনাকাল থেকেই রাষ্ট্রীয় সেবার পুরস্কার হিসেবে ইক্‌তা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ও চাহিদা অনুসারে এই ব্যবস্থার পর্যায়গত রূপান্তর ঘটেছে” (“It (Iquta) existed since the early days of Islam as a form of reward for service to the state and passed through various phases of development…to meet different situations and problems of political life. “)। মামেলুক সুলতানদের আমলে ভারতে এই ধরনের ভূমি বন্দোবস্ত ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। ভারতে প্রচলিত রাজপুতদের সামন্ততান্ত্রিক রীতি ও অধিকার থেকে ইক্‌তা ব্যবস্থা স্বতন্ত্র ছিল। এমনকি মুঘলদের জায়গিরদারি ব্যবস্থাও পুরোপুরি সমবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ছিল না। কে. এম. আশরাফ-এর মতে, সম্ভবত খলিফা মুক্তদির এই প্রথার উদ্ভাবক ছিলেন। প্রায়-স্বাধীন প্রদেশপালদের কাছ থেকে নিয়মিত রাজস্ব আদায়ের অন্যতম পন্থা হিসেবে তিনি এই ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন। ইক্‌তার প্রাপক তার সেনাবাহিনী ও প্রশাসনিক ব্যয় মেটানোর পর উদ্‌বৃত্ত অর্থের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বাগদাদে প্রেরণ করত। ড. নিজামী (KA. Nizami)-র মতে, ইসলামের উত্থানের আদি পর্ব থেকেই রাষ্ট্রীয় সেবার বিনিময়ে পুরস্কার হিসেবে ইক্‌তা প্রদানের ব্যবস্থা চালু ছিল। এবং পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এবং রাজনৈতিক প্রয়োজন অনুসারে ইক্‌তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটানো হয়।

ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রকৃতির অনুদানের ওপর ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে খলিফার প্রাথমিক অধিকার স্বীকৃত ছিল। এইভাবে কৃষকদের উৎপাদনের উদ্‌বৃত্ত অংশের একাংশ রাষ্ট্রের প্রাপ্য বলে বিবেচিত হত। তাই ইসলামীয় সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের উৎপাদনের উদ্‌বৃত্তের অংশ সংগ্রহ করা এবং তা শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টন করার পন্থা-পদ্ধতি উদ্ভাবনের প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই ধরনের একটি পদ্ধতি হল ‘ইক্‌তা’। সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক কাঠামোকে কোনোভাবে দায়বদ্ধ না করে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ ও তা বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়। একজন শাসকের অধীনে দু-ধরনের জমি থাকত, যথা—(১) সুলতানের খাস জমি বা রাজকীয় জমি। একে বলা হত ‘খালিসা’। এই জমির রাজস্ব সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে আদায় করতেন সরকারি কর্মী আমিল প্রমুখ। এই অর্থ সম্পূর্ণটা রাজকোষে জমা পড়ত। (২) দ্বিতীয় ধরনের জমি সুলতান নির্দিষ্ট শর্তে ও কাজের বিনিময়ে তাঁর সৈনাধ্যক্ষ, সৈনিক বা অভিজাতদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। এই জমিকে বলা হত ‘ইক্‌তা’ এবং ‘ইক্তা’র প্রাপককে বলা হত ‘মুক্‌তি’ এবং সাধারণভাবে ‘ইক্তাদার’। কখনো কখনো এঁরা ‘ওয়ালি’ বা ‘উলিয়াৎ’ নামে অভিহিত হতেন। মাওয়ারদি দু-ধরনের ইক্তার কথা উল্লেখ করেছেন—’ইক্‌তা-ই-তমলিক্‌’ এবং ‘ইক্‌তা-ই-ইক্তিঘলাল’। ‘ইক্‌তা-ই-তমলিক্‌’ ছিল ভূমিব্যবস্থা ও প্রশাসনের অঙ্গ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় ইক্তাটি ছিল সরকারি অনুদান এবং প্রায় গুরুত্বহীন। সুলতানি আমলে ভারতবর্ষে প্রথমোক্ত ব্যবস্থাটিও বিকাশলাভ করেছিল। ভারতে প্রবর্তিত হওয়ার আগে ইক্‌তা ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলির আভাস পাওয়া যায় নিজাম-উল-মুলক্‌ তুসীর লেখা ‘সিয়াসত্‍ত্নামা’ গ্রন্থে। ইক্‌তার প্রাপক মুতি নিয়মিত রাজস্ব আদায় ছাড়া প্রজাদের ওপর অন্য কোনো অধিকার বা দাবি আরোপ করতে পারতেন না। নির্ধারিত রাজস্ব প্রদান করার পর প্রজা তার পরিবার-পরিজন ও সম্পত্তি সম্পদ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অধিকারী হতেন। জমি ও কৃষকদের ওপর মুকৃতি’র কোনো স্থায়ী অধিকার ছিল না। মুক্তি জানতেন যে, দেশ ও প্রজাকুলের ওপর একমাত্র সুলতানের অধিকার আইনত স্বীকৃত ; মুক্তি ছিলেন সুলতান নিযুক্ত ‘অছি’ (Trustee) মাত্র। এখানে নিজাম-উল্‌-মুল্ক ইক্‌তা প্রথার গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে ইক্‌তাদার বা মুক্তির কিছু কর্তব্যের উল্লেখ করেছেন। যেমন— মুক্তি সুলতানের ইচ্ছানুসারে ইক্‌তা থেকে আদায়ীকৃত রাজস্বের একাংশ ভোগ করতে পারতেন। বিনিময়ে তিনি একটি সেনাবাহিনী পোষণ করতেন; এবং সুলতানের প্রয়োজনে এই বাহিনী দ্বারা তাঁকে সাহায্য করতেন। অর্থাৎ মুক্তি ছিলেন একাধারে রাজস্ব-সংগ্রাহক, সেনাবাহিনী-পোষক ও পরিচালক। ড. ইরফান হাবিবের ভাষায়: “The Muqti was thus tax collector, and army paymaster (also commander), rolled into one.”

ভারতে সুলতানি শাসনের প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের সাথে ‘ইক্‌তা’ ব্যবস্থা গভীরভাবে জড়িত। ভারতে তুর্কি-আগ্রাসনের প্রাথমিক পর্বে অভিযানকারীদের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের দিকটি ছিল খুবই দুর্বল। ব্যক্তিগত দক্ষতা ও গোষ্ঠীগত উদ্যোগের ওপরে ভিত্তি করেই তারা এই বিদেশভূমিতে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছিল। আক্রমণকারীদের তুলনায় আক্রান্তদের সংখ্যা ছিল বহুগুণ বেশি। অথচ ভারতের কেন্দ্রীয় শক্তির অনুপস্থিতি, সাধারণ ভারতবাসীর যুদ্ধবিমুখতা, কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ জীবনধারার প্রতি আস্থা ইত্যাদি একাধিক কারণে আক্রান্তরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও অভিযানকারীদের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়তে বাধ্য হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে মহম্মদ ঘুরির উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনানায়কদের অনেকেই নিছক নেতৃপ্রতিভা (Leadership) প্রদর্শন করে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তুর্কি-আধিপত্য কায়েম করতে সক্ষম হন। কিন্তু তখনও বিশাল ভারত ভূখণ্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তুর্কি-আধিপত্যের বাইরে ছিল। তুর্কি-অভিভাষণের এই প্রাথমিক পরিস্থিতিতে সুলতানের সামনে দুটি বিষয় জরুরি অনুভূত হয়েছিল। এগুলি হল—(১) সদ্য-অধিকৃত অঞ্চলগুলির ওপর কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা এবং অনধিকৃত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ওপর সুলতানি নিয়ন্ত্রণের প্রসার ঘটানো এবং (২) ভাগ্যান্বেষী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী তুর্কি সেনানায়কদের প্রশাসনিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রেখে তাদের সর্বোচ্চ সেবা আদায় করে নেওয়া। তুর্কি সেনানায়কদের ‘ইক্‌তা’ বিতরণ করে সুলতান এই দুটি জরুরি প্রয়োজন মেটাবার ব্যবস্থা করেন। ড. মেহতা (J. L. Mehta) লিখেছেন : “The Iqta’ was a half conquered and poorly administered territory over which the ‘assignee’ was expected to establish a firm hold, and introduce civil administration there as he though fit or feasible.”

‘ঘুর’ রাজ্য কর্তৃক উত্তর ভারত অভিযানের পর ঘুরির অনুগামী সেনাপতিগণ দখলিকৃত অঞ্চলে স্ব-স্ব অধিকার কায়েম করেন এবং ‘মুক্তি’ নামে অভিহিত হন। লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড দ্বারা নির্দিষ্ট অঞ্চলে কর্তৃত্ব করলেও ওইসব স্থান ‘ইক্তা’ নামেই পরিচিত হয়। দিল্লি-সুলতানির প্রতিষ্ঠার পর ধীরে ধীরে এই সকল স্বঘোষিত ইক্তাদারের ভুখণ্ড প্রকৃত অর্থে ইক্‌তা’র বৈশিষ্ট্য লাভ করতে থাকে। সুলতান ইলতুৎমিস ইক্তা-ব্যবস্থাকে ভারতে বৈধ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। তিনি তুর্কি-অভিজাতগণ কর্তৃক বিজিত বা নিয়ন্ত্রিত এলাকগুলিকে সুলতানি অধীনস্থ বৈধ শাসনতান্ত্রিক ‘একক’ রূপে স্বীকার করে নেন। ইক্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থা-সম্পন্ন নববিজিত ভূখণ্ডের ওপর দিল্লি-সুলতানির কর্তৃত্ব রক্ষা, স্থানীয় হিন্দু সামন্তদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ এবং রাজস্ব সংগ্রহ করা সহজসাধ্য হয়। ড. নিজামীর ভাষায় : “The early Turkish Sultans of Delhi, particularly Iltutmish, used this institution as an instrument for liquidating the feudal order of Indian society and linking up the far-flung parts of the empire to one centre.”

ইলতুৎমিসের আমলে ভারতে খালিসা জমি সংরক্ষণের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায়। দিল্লির পার্শ্ববর্তী অঞ্চল এবং দোয়াবের কিছু অংশ খালিসা হিসেবে রাখা হত। ইলতুৎমিস এই অঞ্চলের রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব তুর্কি-সেনাদের হাতে বণ্টন করে দেন। এই ব্যবস্থাকে ভরতে ইকতা প্রথার আদি-পর্ব হিসেবে ধরা যায়। বণ্টিত অংশের রাজস্ব ওই সকল সেনাদের বেতন হিসেবে বিবেচিত হত। ইকতা-প্রাপকের কাছ থেকে সংগৃহীত রাজস্বের অংশ তখন দাবি করা হত না। সম্ভবত গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমলে উদ্‌বৃত্ত রাজস্বের ওপর সুলতানের দাবি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

ইলতুৎমিস মূলত তুর্কি সেনাপতিদের মধ্যে ইকতা বিলি করেন এবং ইক্তা-ব্যবস্থাকে প্রাদেশিক শাসনের ভিত্তি হিসেবে গড়ে তোলেন। তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল নববিজিত অঞ্চলের ওপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা এবং ভারতীয় সামন্ততান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিচ্ছিন্ন করা। এজন্য তিনি তুর্কি সমরনায়কদের মধ্যে নববিজিত স্থানগুলিকে ইক্তা হিসেবে বিলি করে দেন। কিন্তু ইক্তা-ব্যবস্থার মধ্যে সামন্ততন্ত্রের উপাদান লুকিয়েছিল। তাই বিচক্ষণ ইলতুৎমিস ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ রোধ করার উদ্দেশ্যে মুক্তিদের বিভিন্ন ইক্‌তায় বদলি করার নীতি নেন। এক্ষেত্রে তাঁর দ্বিবিধ লক্ষ্য ছিল—(১) সুলতানি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় তুর্কি-সৈনিকদের অবদানের পুরস্কার প্রদান এবং (২) দেশের প্রধানতম উর্বর অঞ্চলে সুলতানির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাজে তাঁদের নিয়োজিত রাখা। এইসব ছোটো ছোটো ইক্তাদারের কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল না। তবে ইক্তা’র নির্দিষ্ট রাজস্বভোগের বিনিময়ে এঁরা সুলতানকে সামরিক সাহায্য দিতেন। ইলতুৎমিসের তীক্ষ্ণ নজরদারির ফলে এই সকল ইক্‌তাদার সুলতানির সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে বাধ্য ছিলেন। কিন্তু ইলতুৎমিসের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে এবং গিয়াসউদ্দিন বলবন কর্তৃক সিংহাসনে আরোহণের মধ্যবর্তীকালে ইক্তা-ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত বিপজ্জনক দিকটি প্রকট হতে থাকে। মুতিরা কেন্দ্রীয় সরকারকে অগ্রাহ্য করতে শুরু করেন। ফলে সুলতানি সাম্রাজ্যের সংহতি ও শক্তিবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত ইক্তা-ব্যবস্থা সুলতানির দুর্বলতা ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বলবন সুলতানি গ্রহণ করে ইকতা ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন ঘটান। প্রথমেই তিনি দোয়াবের ইকতাগুলির বিলি-বন্দোবস্তের শর্তাদি তদন্ত করে সিদ্ধান্ত নেন যে, (১) নির্দিষ্ট সামরিক সেবার বিনিময়ে এই ইক্‌তা সৈনিকদের বৃত্তি হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। (২) বর্তমানে ইক্তা-প্রাপকদের অনেকেই মৃত কিংবা এত বৃদ্ধ যে, সামরিক সেবাপ্রদানে অক্ষম। (৩) সেইহেতু প্রাপ্ত ইকতার ওপর প্রাপকের কিংবা তাদের বংশধরের আইনগত কোনো অধিকার নেই। বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের পর বলবন বৃদ্ধ বা অক্ষম ব্যক্তিদের ২০/৩০ টাকা পেনশন প্রদানের এবং সক্ষম ব্যক্তিদের নগদ মজুরির ভিত্তিতে সমস্ত ইকতা কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক কারণেই ইকতা ভোগদখলকারীদের ক্ষুব্ধ ও ভীত করে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত দিল্লির কতোয়াল মালিক ফকরউদ্দিনের মধ্যস্থতায় দোয়াবের ইক্তাগুলি পূর্ববৎ বজায় থাকে। তবে বারাণীর বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারেননি ড. হবিবউল্লাহ। তাঁর মতে, কতোয়ালের অনুরোধের ফলে শুধুমাত্র বৃদ্ধ সৈনিকদের ইকতাগুলি সুলতান বজায় রেখেছিলেন।

বলবন ইকতার ওপর কেন্দ্রের কর্তৃত্ব সুদৃঢ় ও নিশ্চিত করার জন্য কিছু ব্যবস্থা নেন। বড়ো ইকতার মুক্তিদের প্রধান কর্তব্য ছিল ইকতার ব্যয়-সংকুলানের পর উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় রাজকোষে জমা দেওয়া। কিন্তু সাধারণত মুকৃতি এমনভাবে ইক্তার আয়ব্যয়ের হিসেব প্রস্তুত করতেন যে, কখনোই অর্থ উদ্‌বৃত্ত হত না। বলবন ইক্তার হিসেবে রক্ষা ও কেন্দ্রের প্রাপ্য যথাযথ আদায়ের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেন। খোয়াজা নামক একশ্রেণির হিসেব পরীক্ষক নিয়োগ করে ইকতার প্রকৃত আয়, প্রকৃত ব্যয় এবং উদ্‌বৃত্ত অর্থের সঠিক হিসেব রক্ষার ব্যবস্থা করেন।

সুলতান আলাউদ্দিন খলজির আমলে ইক্তা-প্রশাসনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো হয়। আলাউদ্দিনের সাম্রাজ্যবাদী নীতির ফলে সুলতানি সাম্রাজ্যের পরিধি অনেক বেড়েছিল। দূরবর্তী অঞ্চলগুলিকে ইকতায় পরিণত করে আলাউদ্দিন স্থানীয় প্রশাসন ও রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থাকে সুনিশ্চিত করেন। দিল্লির নিকটবর্তী অঞ্চলগুলিকে তিনি ‘খালিসা’ জমিতে পরিণত করেন। সুলতানি অশ্বারোহী বাহিনীর (হাম) সদস্যদের বেতন বাবদ ‘ইক্তা’ প্রদানের পরিবর্তে নগদ অর্থে বেতনদানের ব্যবস্থা করেন। ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা বলবৎ ছিল। সেনাপতিদের ক্ষেত্রে তিনি ইক্তা’ বরাদ্দ করার নীতি চালু রাখেন। তবে ইকতার প্রশাসনে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব তিনি আরও সুদৃঢ় করেন। স্থির হয় যে, দেওয়ান-ই উজিরৎ প্রতি ইক্তার রাজস্বের পরিমাণ স্থির করে দেবেন। এই রাজস্বের একটি নির্দিষ্ট অংশ মাকৃতি বা ওয়ালির অধীনস্থ সৈনিকের (হাম) বেতন (ময়াজিব) বাবদ ব্যয় করা হবে। এই অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে হিসেবে ইকতার একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলও স্থির করে দেন দেওয়ান। বাকি অংশ থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব মুক্তির ব্যক্তিগত খরচ ও প্রশাসনিক খরচের জন্য নির্দিষ্ট থাকে। সেনাবাহিনীর ব্যয় এবং মুক্তির ও ইক্তার ব্যয়-সংকুলানের পর উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় রাজকোষে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। উদ্‌বৃত্ত অর্থ জমা না দিলে কিংবা মিথ্যাচার দ্বারা কেন্দ্রকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করলে কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু মুক্তিরা তাদের আয়ব্যয়ের হিসেবে কারচুপি করে সুলতানকে তথা কেন্দ্রীয় কোষাগারকে ফাঁকি দিতে চেষ্টা চালাতেন। অবশ্য অধীনস্থদের কাছ থেকে নিজের প্রাপ্য পাই পয়সা আদায় করার কাজে মুক্তি কোনোরকম ফাঁকি সহ্য করতেন না। দূরদর্শী আলাউদ্দিন মুক্তিদের এই প্রবণতা সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। তাই তিনি মুক্তিদের অসাধুতা ও ফাঁকি বন্ধ করার ব্যাপারে কঠোর মনোভাব পোষণ করতেন। প্রতিটি ইক্তার বার্ষিক আয়ব্যয় পরীক্ষার ওপর তিনি জোর দেন এবং সামান্যতম ফাঁকি বা বিচ্যুতি ধরা পড়লে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতেন। বারাণী লিখেছেন: আলাউদ্দিনের জনৈক মন্ত্রী শরাফ কোই কঠোর হাতে ইক্‌তার প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রীয় কোষাগারে আয়বৃদ্ধিতে সফল হয়েছিলেন। তিনি গ্রামের পাটোয়ারী (হিসাবরক্ষক)-দের খাতা পরীক্ষা করে ইকতার প্রকৃত আয় সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহ করতেন এবং মিথ্যাচারের ক্ষেত্রে অমানুষিক শাস্তি দিতেন। সমকালীন লেখক শাম্স-ই-সিরাজ-আফিফ্ লিখেছেন যে, শরাফ কোই-এর কঠোরতার ফলে রাজস্ব আদায়ে গতি এসেছিল ঠিকই; কিন্তু মুক্তিদের ওপর এই অস্বাভাবিক কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল। এবং পরিণামে সুলতানি সাম্রাজ্যের ভিত্তি শিথিল হয়েছিল।

মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের আমলে ইক্তা-ব্যবস্থায় আরও কিছু পরিবর্তন ঘটানো হয়। বারাণী, ইসামী, ইবন বতুতা প্রমুখের রচনা থেকে জানা যায় যে, মহম্মদ তুঘলক রাজস্ব সংগ্রহ এবং সৈন্য রক্ষণাবেক্ষণ কাজ দুটিকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেন। রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব নিলামের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে ইজারা হিসেবে দেওয়া হয়। এইভাবে নিজাম মঈন কয়েক লক্ষ টাকা প্রদানের শর্তে ‘কারা’ নামক ইক্‌তার দায়িত্ব পান। জনৈক নসরৎ খাঁ এক কোটি তঙ্কা প্রদানের শর্তে বিদারা অঞ্চলের ইজারা পান। ইসামীর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, আলি শাহ খলজি নামক জনৈক ব্যক্তি ‘গোবর’ নামক স্থান দখল করে সরকারি কোষাগারে নির্দিষ্ট রাজস্ব প্রদানের শর্তে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ভোগ করতেন। কিন্তু গুলবর্গার ইজারাদার শরণ নামক জনৈক হিন্দু ‘গোবর’ অঞ্চলের জন্য আরও দেড়গুণ বেশি রাজস্ব দিতে আগ্রহী হলে সুলতান শরণের হাতে ‘গোবরের’ ইজারা তুলে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ এই সময় অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে ইক্‌তার ওপর ইজারাদারী ব্যবস্থা (contract system) প্রবর্তন করা হয় এবং ইক্তার মৌল বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটে। কারণ রাজস্ব আদায়কারী ইজারাদারদের কোনোভাবেই সেনা পোষণ বা সেনাবাহিনীর ভরণপোষণের দায় বহন করতে হত না। ইবন বতুতার বিবরণী থেকেও জানা যায় যে, একই ইকতায় কীভাবে দুটি পৃথক শাসনদায়িত্ব পাশাপাশি অবস্থান করত। আমরোহা বাজারের ইজারাদার শর্তানুযায়ী সুলতানকে তাঁর প্রাপ্য নিয়মিত মিটিয়ে দিতেন। তথাপি স্থানীয় আমিরের সৈন্যরা তাঁকে অর্থপ্রদানের জন্য অন্যায়ভাবে চাপ সৃষ্টি করত। এজন্য ওই ইজারাদার সুলতানের কাছে অভিযোগও পেশ করেন। সম্ভবত, সেনাপোষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত আমির শক্তি প্রয়োগ করে ইজারাদারের কাছ থেকে কিছু অর্থ আদায় করে নিতে চেষ্টা করেছিলেন। এরূপ দৃষ্টান্ত মধ্যযুগে আরও খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। তবে এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, মহম্মদ-বিন-তুঘলক ইক্‌তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কিছুটা মৌলিক পরিবর্তন এনেছিলেন।

মহম্মদ-বিন্-তুঘলক সাধারণ সেনাদের নগদ বেতনদানের ব্যবস্থা করেন। তবে সর্বনিম্নে “সিপাহশালার থেকে ঊর্ধ্বে ‘খান’ পদমর্যাদার সৈনাধ্যক্ষগণ কেবল তাঁদের বেতনবাবদ একখণ্ড ইকতা ভোগ করতেন। এঁদের নগদে বেতন দেওয়া হত না। অবশ্য এঁদের যা বেতন ছিল, তার থেকে কম। আয়সম্পন্ন ইকতা এঁদের বরাদ্দ করা হত। কারণ সুলতান জানতেন যে, এঁরা সর্বদাই উৎপাদকের ওপর জুলুম করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করতে অভ্যস্ত। সম্ভবত, অভিজাতদের হাত থেকে ইক্‌তা প্রশাসনের দায়িত্ব সরিয়ে নেওয়ার জন্য পুরোনো অভিজাতবর্গ মহম্মদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। দাক্ষিণাত্যে ‘সদাহ-আমিরদের’ (আমিরান-ই-সদাহ) বিদ্রোহ ছিল এই ব্যবস্থার অন্যতম প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

ফিরোজ শাহ তুঘলক নীতিগতভাবে অভিজাতবর্গ ও উলেমাদের পোষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাই তিনি অভিজাতদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রচুর বৃদ্ধি করেন। স্বভাবতই ইক্‌তা ব্যবস্থার ওপরেও তার প্রভাব পড়ে। মহম্মদ-বিন-তুঘলকের আমলে ‘খান’ পদমর্যাদার একজন অভিজাত বার্ষিক বেতন পেতেন ২ লক্ষ তঙ্কা। ফিরোজ তুঘলক সেই হার ৪ লক্ষ থেকে ৮ লক্ষ তঙ্কা পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। উজিরের ক্ষেত্রে এই হার ছিল এক কোটি তিরিশ লক্ষ তঙ্কা। এই বেতনের বিনিময়ে তাঁরা ‘ইক্‌তা’ এবং পরগনা বন্দোবস্ত পেতেন। দ্বিতীয়ত, ফিরোজ শাহ ইকতার আয় বার্ষিকভাবে নির্ধারণের পরিবর্তে সমগ্র আমলের জন্য (১৩৫১-১৩৮৮ খ্রিঃ) নির্দিষ্ট করে দেন। রাজত্বের চতুর্থ বছরে উজিরাৎ দপ্তর ইক্‌তার আয় ৬ কোটি ৮৫ লক্ষ তঙ্কা ধার্য করে দেয়। এই জমার অঙ্ক তাঁর আমলে অপরিবর্তিত ছিল। স্বভাবতই মুক্তিরা নিশ্চিত ছিল যে, সরকারকে দেয় রাজস্ব বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা এবং তা প্রদানের ঝক্কি তাদের সামলাতে হবে না। এই ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় পরীক্ষকের ঝামেলা থেকেও মুক্তিরা রেহাই পেয়ে যান। তৃতীয়ত, আফিফের বিবরণ থেকে অনুমান করা যায় যে, ফিরোজের আমলে একজন মুক্তির ব্যক্তিগত বেতন বাবদ প্রাপ্ত ইক্তা এবং সেনাবাহিনীর ব্যয়সঙ্কুলানের জন্য নির্দিষ্ট ইক্তা পৃথকীকরণ স্পষ্ট ছিল না। ফিরোজ শাহ’র আমলে ইক্‌তা প্রশাসনের ওপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ যে হারে শিথিল করা হয়েছিল, তাতে এই ধরনের সুক্ষ্ম বিজাজন কার্যকরী না-থাকাই ছিল স্বাভাবিক।

ফিরোজ শাহ ঈশ্বর কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে সমস্ত রাজস্ব জনগণের মধ্যে বিলিবণ্টন করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আফিফের বিবরণ অনুযায়ী ফিরোজ সমস্ত রাজস্ব, ইক্তা এবং পরগনাগুলি জনগণের মধ্যে বণ্টন করে দেন (By an inspiration from God he distributed the revenues of the empire among the people (nobility); even parganas and iqtas were distributed. –S. Afif)। ফলে খালিসা জমির পরিমাণ দারুণ হ্রাস পায়, সংকুচিত হয় কোষাগারের আয়। ফিরোজ সেনাদের নগদ অর্থে বেতন দেবার পরিবর্তে গ্রামের খাজনা আদায় করার অধিকার দেন। একে বলা হত ওয়াঝ (Wajh) বা মোয়াজব (বেতনের বিকল্প)। যারা ওয়াঝ পেত না তারা নগদ অর্থে বেতন পেত কিংবা বেতনের একাংশ নগদে পেত এবং অবশিষ্ট অংশ বরাত্ বা ইলাক মারফত আদায় করত। ইলাক হল ইক্তার যে অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হত। সেনারা বরাত্ বা ইলাকের অধিকারবলে গ্রামের খাজনা তুলে নিত। কিন্তু ইলাক আদায় করা খুব সহজ ছিল না। তাই সেনারা তাদের বরাত্ ফঁড়ে-মহাজনদের কাছে নগদ টাকায় এক-তৃতীয়াংশ দামে বিক্রি করে দিত। আফিফের মতে, এই ব্যবস্থার একাধিক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ছিল। যেমন, এর ফলে সেনারা তাদের প্রাপ্য বেতননের কম নিতে বাধ্য হত, সরকারি কোষাগার দুর্বল হত এবং একটা মধ্যবর্তী শ্রেণি ওই অর্থ আত্মসাৎ করে নিত।

ফিরোজ শাহ ইকতা-ব্যবস্থায় উত্তরাধিকার স্বীকার করে একটা মৌল পরিবর্তন ঘটান। তিনি সরকারিভাবে ইক্‌তার ওপর প্রাপকের বংশানুক্রমিক অধিকার মেনে নেন। এমনকি কোনো মুকৃতি অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে সেই ইক্‌তার ওপর তার কন্যা, জামাতা, এমনকি পুত্রকন্যার অবর্তমানে মৃতের ক্রীতদাসের উত্তরাধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়। এই ব্যবস্থার ফলে ইকতা প্রাপকের সামরিক বা প্রশাসনিক দক্ষতা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে এবং সেবার (Service) বিনিময়ে ইকতা বন্দোবস্তের মৌল বৈশিষ্ট্য অন্তর্হিত হয়। অবশ্য লোদী সুলতানদের আমলে এই বংশানুক্রমিক অধিকার অস্বীকার করার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

ফিরোজ শাহের বংশধরদের পক্ষে ইক্‌তার ওপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা আর সম্ভব হয়নি। দু-একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত ছাড়া এই পর্বে ইক্‌তার ওপর বংশানুক্রমিক অধিকার বজায় ছিল। ‘তারিখ-ই-মুবারক শাহির সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, সুলতান মুবারক শাহ (১৪২১-৩৪ খ্রিঃ) লাহোরে জনৈক অভিজাতকে ইক্‌তা প্রদানের (১৪২১ খ্রিঃ) সময় দু-হাজার সৈন্যগোষণের শর্ত আরোপ করেছিলেন। এক ইকতা থেকে অন্য ইক্‌তায় বদলির দৃষ্টান্তও পাওয়া যায়। অবশ্য সামগ্রিকভাবে ফিরোজের আমলের রীতি অনুসৃত হত।

লোদীবংশের শাসনকালে (১৪১১-১৫২৬ খ্রিঃ) ইক্‌তার সাধারণ বৈশিষ্ট্য একই ছিল। তবে এই সময় থেকে ইক্‌তার পরিবর্তে ‘সরকার’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। রাজ্যের খণ্ডিত অংশ ‘সরকার’ নামে অভিহিত হত। প্রতিটি সরকার কয়েকটি ‘পরগনা’র সমন্বয়ে গঠিত হত। প্রতিটি সরকারের রাজস্ব ‘জমা’ অনুমানের ভিত্তিতে স্থির করে দেওয়া হত। এই ‘জমা’ বিশিষ্ট সরকার অভিজাতদের বন্দোবস্ত দেওয়া হত এবং সেই ভিত্তিতে প্রাপকের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হত। মুখ্য গ্রহীতা তাঁর সরকার বা পরগনাকে খণ্ডিত অংশে এবং নির্দিষ্ট রাজস্ব আদায়ের শর্তে তাঁদের অধীনস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে ইজারা’ হিসেবে বণ্টন করে দিতে পারতেন। এই ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করেই মুঘলদের শাসনকালে ‘জায়গির প্রথার প্রসার ঘটেছিল।

দিল্লির সুলতানেরা মূলত দুটি ইতিবাচক লক্ষ্যপূরণের জন্য ‘ইক্তা’ ব্যবস্থা প্রচলন করেছিলেন। দূরবর্তী অঞ্চলের ওপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিজাতদের ক্ষমতার স্বাদ দিয়ে কেন্দ্রের প্রতি অনুগত রাখা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু নেতিবাচক প্রবণতা এখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। যে-কোনো ভূমিদান-ব্যবস্থার মধ্যেই সামন্ততান্ত্রিক উপাদান লুকিয়ে থাকে। ইক্তা-ব্যবস্থাও শেষ পর্যন্ত সেই পরিণতি থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। প্রাথমিকভাবে ইক্তার ওপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বলবৎ রাখার জন্য একাধিক নিয়ম ছিল। মুক্তিদের বদলি, কেন্দ্র কর্তৃক নিয়মিত হিসেব পরীক্ষা, হিসেবে গরমিল বা কর্তব্যে অবহেলার জন্য মুক্তিদের কঠোর শাস্তিবিধান ইত্যাদি ব্যবস্থা সামন্ততান্ত্রিক উপাদানকে নিষ্ক্রিয় রাখার ক্ষেত্রে কম কার্যকরী ছিল না। প্রচলিত নিয়ম অনুসারে কোনো ব্যক্তির ইক্‌তা’ বা কোনো খেতাবের ওপর শুধুমাত্র তারই অধিকার ছিল; বংশধরদের নয়। রাষ্ট্র সর্বদাই ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং সরকারি পদ বা খেতাবের মধ্যে সুস্পষ্ট প্রভেদ বজায় রাখতে চাইত। যাতে কোনোরূপ কায়েমি স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে। কিন্তু কেবল প্রতাপশালী সম্রাটদের আমলে এই নিয়মের কার্যকরী প্রয়োগ সম্ভব হত। কিন্তু দুর্বল শাসকদের আমলে অভিজাতশ্রেণি ‘ইক্‌তা’ বা খেতাবের ওপরে বংশানুক্রমিক অধিকার কায়েম করতে সক্রিয় ছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন। ইলতুৎমিসের বংশধরদের আমলে এহেন প্রবণতা প্রথম দেখা যায়। ফিরোজ তুঘলক সরকারিভাবেই এই অধিকার মেনে নিয়ে কায়েমি স্বার্থের জয় ঘোষণা করেন। এই কারণে কোশাম্বী (D. D. Kosambi) মন্তব্য করেছেন যে, “ফিরোজ তুঘলক নিম্নস্তর থেকে ওপর পর্যন্ত সামন্ততান্ত্রিক অধিকার স্বীকার করে নিয়ে নিশ্চিন্তে শাসন চালিয়েছেন” (“Ultimately Firuz Tughlaq yielded to feudalism from below, and ruled without rebellion till nearly the end of his reign.”)। এই নতুন প্রক্রিয়াতে কৃষককুল অতিরিক্ত শোষণের শিকারে পরিণত হয়েছিল। অধ্যাপক ইরফান হাবিব মনে করেন, এই ব্যবস্থায় কৃষকদের অবস্থা আধা-ভূমিদাস (Semi-Serf)-দের মতোই হয়েছিল। এই দিক থেকে প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক উপাদান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আবার কর্তৃত্বের প্রবল কেন্দ্রীকরণের ভিত্তি এই অবস্থাকে ‘প্রাচ্যদেশীয় স্বৈরতন্ত্র’ (Oriental despotism) বলা যায়।

লোদীবংশীয় সুলতান সিকন্দর লোদী ইক্তা বা সরকারি খেতাবের ওপর বংশানুক্রমিক দাবি শিথিল করার একটা বিচ্ছিন্ন প্রয়াস করেছিলেন। বিখ্যাত আমির ‘মসনদ-এ আলা’র বংশধর জৈনউদ্দিনকে জায়গির প্রদানের সময় জারি করা সনদে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছিল যে, মসনদ-এ-আলার বংশধর হিসেবে জৈনউদ্দিনকে এই জায়গির দেওয়া হচ্ছে না। একান্তভাবেই তার ব্যক্তিগত যোগ্যতার বিবেচনায় তাকে এই বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রয়াসের কার্যকারিতা ছিল শূন্য। অধ্যাপক আশরাফ লিখেছেন : “ক্রমাগত একের পর এক দুর্বল সুলতান সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে ইক্‌তার অধিকারী নিরবচ্ছিন্নভাবে ইকতা ভোগদখলের সুযোগ পেত এবং তার ফলে ওই জায়গির প্রায় তার নিজস্ব ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে দাঁড়াত।”নীতিগতভাবে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব রক্ষার প্রয়াস সত্ত্বেও; ইক্‌তা প্রশাসনের ক্রমবিকাশের ধারায় সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতার ঝোঁক খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়।

সুলতানি আমলে ওয়াঝদারি ব্যবস্থা :

আরবি শব্দ ‘ওয়াঝ’ (Wajh)-এর অর্থ রাজস্ব। এই গ্রামীণ রাজস্ব আদায়কারী ‘ওয়াঝদার’ নামে পরিচিত হন। ওয়াঝদারি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন মূলত ফিরোজ শাহ তুঘলক। সুলতান ইলতুৎমিসের আমল থেকে ভারতে প্রচলিত ইকতা’ ব্যবস্থা ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের আমল পর্যন্ত অগ্রসর হয়। ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে ফিরোজ শাহ তুঘলক সিংহাসনে বসলে ইক্তা ব্যবস্থার প্রচলিত প্রবণতাগুলি প্রায় বিপরীতমুখী হয়। মহম্মদ-বিন্-তুঘলক যেভাবে ইক্‌তা ব্যবস্থাকে সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি সীমিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিণত করেছিলেন, এখন তা আমূল পাল্টে যায়। সুলতান ফিরোজ বিভিন্ন স্তরের রাজকর্মচারীদের জন্য নানারকম সুযোগ-সুবিধা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সম্প্রসারণ ঘটান। তিনি রাজস্ব খাতে আয় স্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট করে দেন, যাতে স্বত্বনিয়োগীরা প্রকৃত রাজস্ব আদায়ের বৃদ্ধির সুযোগ নিশ্চিত্তে ভোগ করতে পারে। আইনগতভাবে ইক্‌তার হস্তান্তর প্রথা তখনও বলবৎ ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার কোনো প্রয়োগ ছিল না।

আফিফের বিবরণ অনুযায়ী, ফিরোজ ঈশ্বর কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর রাজ্যের সমস্ত রাজস্ব অভিজাতদের মধ্যে বণ্টন করে দেন; এমনকি, পরগনা এবং ইক্‌তাগুলিও বণ্টিত হয়ে যায়। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, তাঁর আমলে খালিসার পরিমাণ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছিল। যেটুকু জমি খালিসা হিসেবে তখনও টিকেছিল, ফিরোজ সেগুলির রাজস্বও সৈনিকদের বেতনের পরিবর্তে তাদের হাতে তুলে দেন। একে বলা হত ‘ওয়াঝা’। প্রাপককে বলা হত ‘ওয়াঝদার’এবং সমগ্র প্রক্রিয়াটির নাম ছিল ‘ওয়াঝদারী ব্যবস্থা’। যাঁরা ওয়াঝ পেতেন না, তাঁদের কোষাগার থেকে নগদে বেতন দেওয়া হত। অনেক সময় ইক্‌তার উদ্বৃত্ত রাজস্বের ওপর এদের ইত্সাক’ বা ‘বরাত’ দেওয়া হত। আফিফ লিখেছেন যে, এক্ষেত্রে সৈন্যরা তাদের প্রাপ্য বেতনের অর্ধেক উক্ত ইত্‌লাক’ বা ‘বরাত’ থেকে সংগ্রহ করতে পারত। তবে এটাও আদায় করা সহজসাধ্য ছিল না। তাই সৈন্যরা তাদের ইত্সাক’ অন্যের কাছে এক-তৃতীয়াংশ মূল্যে বিক্রি করে দিতেন। এই দালালরা সৈন্যের বেতনের অর্ধেক ইক্‌তা থেকে আদায় করত। ওয়াঝদারী ব্যবস্থাকে ড. ইরফান হাবিব ইক্‌তার ‘ক্ষুদ্র সংস্করণ’ বলে অভিহিত করেছেন।