মধ্যযুগের ভারতে কৃষিজ উৎপাদন ও প্রযুক্তি:
ভারতবর্ষ মূলত কৃষিনির্ভর দেশ। স্বভাবতই ভারতের কর্মক্ষম অধিকাংশ সাধারণ মানুষ কৃষিকার্যের সাথেই যুক্ত। এমনকি প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারতের শিল্পী-কারিগরদের অধিকাংশই কৃষিকার্যের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং অবসর সময়ে শিল্পকার্যে লিপ্ত হতেন। আবার এদেশের কৃষিজ উৎপন্নের মূল ভিত্তি ছিল খাদ্যশস্যের উৎপাদন। সুদূর অতীত থেকেই ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড হল তার কৃষিজ উৎপাদন। কৃষি-উৎপাদনের কাজে জড়িত মানুষই ভারতীয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। গ্রাম সমাজকে কেন্দ্র করেই তাদের কর্মকাণ্ড প্রবহমান। নগরায়ণের সূচনা, বিকাশ এবং অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রেও গ্রামগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য। পর্যটক ইবন বতুতা চৌদ্দ শতকের চল্লিশের দশকে উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে যেমন, উচ্চ-গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চল, বাংলাদেশ, মালব, গুজরাট প্রভৃতিতে বড়ো বাজারবিশিষ্ট বৃহৎ নগরীর অবস্থান লক্ষ্য করেছেন। দেশের অর্থনীতিতে এই সকল বাজারের অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তথাপি গ্রামগুলি তাদের চিরায়ত অর্থনৈতিক ঐতিহ্য ও ধারা ধরে রাখতে সক্ষম ছিল এবং উৎপাদন ও ভোগের বিচারে গ্রাম-সমাজ ছিল স্বনির্ভর।
মোরল্যান্ড (W. H. Moreland) তাঁর ‘অ্যাগ্লারিয়ান সিস্টেম অব মুসলেম ইন্ডিয়া’ শীর্ষক গ্রন্থে (১৯২৯ খ্রিঃ) মন্তব্য করেছেন যে, প্রাচীন সাহিত্যে মধ্যযুগের ভারতে ‘সংগঠিত গ্রাম-সমাজের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। অধ্যাপক অনিলচন্দ্র ব্যানার্জীর মতে, মোরল্যান্ড বোঝাতে চেয়েছেন যে, সেকালে গ্রাম-সমাজ প্রশাসনের কাছে কোনোরূপ সমস্যা সৃষ্টিকারী একক ছিল না। অর্থাৎ রাষ্ট্র একক বা গোষ্ঠীগতভাবে কৃষক সমাজের ওপর খবরদারি করত না। ইউ. এন. ঘোষাল সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁর মতে, সুলতানি আমলের প্রায়-সামন্ততান্ত্রিক এবং কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থায় প্রাচীন স্বনির্ভর ও স্বশাসিত গ্রাম-সমাজ প্রায় ভেঙে পড়েছিল (The ancient self governing village assemblies decayed and perished under the withering influence of the quasi federal as well as centralised state adminstration of the time.)। আবার অধ্যাপক আশরাফ (K. M. Ashraf) সম্পূর্ণ বিপরীত অভিমত দিয়ে লিখেছেন যে, “গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তখন যথেষ্ট দক্ষতার সাথে আপন কর্মে লিপ্ত ছিল এবং দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের আর্থিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করত” (“The village community was a working institute in full vigour, and determined the economic outlook of the vast majority of the population of Hindustan.”)।
সুলতানি আমলে গ্রামীণ মধ্যবর্তী শ্রেণির বিশেষ অর্থনৈতিক ভূমিকা ছিল। রাষ্ট্র বিভিন্ন মধ্যবর্তী গোষ্ঠী, যেমন—রাই, রাওয়াত, রানা, খুৎ, মুকদ্দম, ছোটো ইক্তাদার প্রমুখের মারফত গ্রামীণ ভূমিরাজস্ব সংগ্রহ করত। সুলতান আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব-সংস্কার এবং বাজারদর নিয়ন্ত্রণ নীতির ফলে এই সকল আধা-সামন্ত গ্রামীণ প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব সাময়িকভাবে কিছুটা শিথিল হয়েছিল। কিন্তু তাঁর পরবর্তী শাসকদের আমলে পুনরায় গ্রামীণ ভূস্বামীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ড. অনিলচন্দ্র ব্যানার্জী মনে করেন যে, সুলতানি আমলে পল্লিসমাজের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যেমন রাষ্ট্র-নির্ধারিত ছিল না, তেমনি মধ্যবর্তী শ্রেণি বা গ্রাম-সমাজ তা নির্ধারণ করত না। আসলে ঐতিহ্য বা প্রচলিত রীতিই এক্ষেত্রে নির্ধারকের ভূমিকা পালন করত। পূর্বপুরুষদের পথে থেকে তারা নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন করত, উদ্বৃত্ত নয় বা বাইরে চালানের জন্য নয়। অবশ্য গ্রামের স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে পার্শ্ববর্তী শহরের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করা হত। খাদ্যশস্যের উৎপাদন সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিল। উত্তর আফ্রিকার তাঞ্জানিয়ার অধিবাসী ইবন বতুতা খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে ভারত পর্যটন করেছিলেন। মহম্মদ-বিন-তুঘলকের রাজসভায় তিনি দীর্ঘ আট বছর অবস্থান করেন। উৎপাদন খাদ্য, ফল, ফুল ইত্যাদি এবং কৃষিজীবী গ্রামীণ মানুষের জীবনধারা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর মতে, এদেশের জমি খুব উর্বর এবং বছরে দুবার ফসল ফলানো যেত। শরৎকালে জোয়ার, ভুট্টা, কলাই, বীন ইত্যাদি সাত প্রকার শস্য এবং বসন্তকালে গম, বার্লি জাতীয় চার রকমের শস্য উৎপন্ন হত। অবশ্য ইরফান হাবিব মনে করেন, বছরে দুবার উৎপাদন হলেও, একই জমিতে দু’বার ফসল ফলানো যেত না।
কৃষি-উৎপাদনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিভিন্ন প্রকার চাল, ডাল, তৈলবীজ, আখ, তুলা ইত্যাদি। ইবন বতুতার ‘রেহালা’গ্রন্থ অনুসারে এলাহাবাদের সন্নিকটে কারা, মানিকপুরের মাটি খুব উর্বর ছিল। এই দুটি স্থানেই চাল, গম, আখ উৎপন্ন হত। ফিরোজ তুঘলকের আমলে জলসেচ ব্যবস্থার পরে সেচ সেবিত হিসার, ফিরোজাবাদ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ডাল, গম, তিল ও আখ চাষের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। চালের মধ্যে বিশেষ মিহি চাল হিসেবে ‘সিরসুতি’ চালের কদর ছিল। দিল্লিতে এই চালের চাহিদা ছিল সর্বাধিক। সাধারণভাবে রাজধানীর শস্যগোলাতে চাল সংরক্ষিত রেখে দীর্ঘদিন ধরে বাজারে জোগান দেওয়া হত। ইবন বতুতার মতে, ভারতীয় ফলগুলির মধ্যে আমের চাহিদা ছিল বেশি। গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে সুস্বাদু আমের ফলন হত। আমির খসরু লিখেছেন, যে, ঐস্লামিক দেশগুলির নিজস্ব ফল তরমুজ, খরমুজ ইত্যাদির তুলনায় আম ছিল অধিক জনপ্রিয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বাবর তাঁর ‘তুজুক-ই- বাবরি গ্রন্থে ভারতীয় ফলের মান বা স্বাদ সম্পর্কে হতাশাই প্রকাশ করেছেন। তাই কাবুল থেকে উৎকৃষ্ট মানের খরমুজের চারা এনে আগ্রার বাগানে লাগিয়েছিলেন। অন্যান্য ফলের মধ্যে ছিল নানাজাতের আঙুর, কমলালেবু, মুসম্বি, খেজুর, কলা, জাম, কাঁঠাল, বেদানা, আপেল ইত্যাদি। মহম্মদ-বিন-তুঘলক কৃষকদের আঙুর ও খেজুরের চাষ বাড়ানোর জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক দিল্লির আশেপাশে বাগিচা স্থাপন করে নানাজাতের আঙুর ফলাতেন। যোধপুরে প্রচুর উন্নতমানের বেদানা চাষ হত। ‘তারিখ-এ দাউদী’-এর বিবরণ অনুসারে সুলতান সিকদর লোদী পারস্যের বেদানার থেকেও যোধপুরের বেদানাকে অধিক সুস্বাদু ও সুগন্ধি বলে গর্ববোধ করতেন।
পনেরো শতকের গোড়ার দিকে একটি চিনা প্রতিনিধিদলের দোভাষী হিসেবে মা-হুয়ান ভারতে এসেছিলেন। তাঁর বিবরণী মতে, ভারতে প্রচুর চাল উৎপাদন হত। ধান চাষ বছরে দুবার হত। এ ছাড়া জোয়ার, ভুট্টা, তিল, হলুদ, শসা, সরষে, পেঁয়াজ ইত্যাদি উৎপাদন করা হত। মা-হুয়ান ভারতে নারকেল, সুপারি, কলা, খেজুর, আখ, মধু ইত্যাদির প্রাচুর্য সম্পর্কে প্রশংসা করেছেন। চিনা পর্যটক ফা-হিয়েন আম উৎপাদনের ব্যাপকতা লক্ষ্য করেছেন। বারবোসা তাঁর বিবরণে বাংলার আখ চাষ ও চিনি, গুড় উৎপাদনের উল্লেখ করেছেন। মালিক মহম্মদ জায়সী’র ‘পদ্মাবৎ’ কাব্যে ভারতের বাগিচা ও ফল উৎপাদনের প্রশংসা আছে।
প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে নানাজাতের ফুলের চাষ হত। মধ্যযুগেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল। কে. এম. আশরাফ লিখেছেন “সৌন্দর্য, সৌরভ ও বৈচিত্র্যে ভারতীয় ফুল অতুলনীয়।” ধর্মাচরণ, পুজার্চনা ইত্যাদির ক্ষেত্রে ফুল পবিত্রতার প্রতীক রূপে বিবেচিত হয়। আবার যে-কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে ফুলের সৌরভ ও বর্ণময় অলংকরণ ভারতীয়দের কাছে খুবই আকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হয়। আমির খসরু ও মালিক মহম্মদ জায়সীর গ্রন্থে ভারতে ফুলের জনপ্রিয়তা ও ফুল চাষের ব্যাপকতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
ভারতের কাঠ মসৃণতা ও স্থায়িত্বের জন্য বিশেষ খ্যাত। সুলতানিযুগেও নানা ধরনের বৃক্ষরোপণ করা হত। প্রকৃতিদত্তভাবে ভারতের চন্দন ও ঘৃতকুমারী কাঠের সুগন্ধ ছিল বিশ্বখ্যাত। ঘৃতকুমারী কাঠ উৎপাদনের জন্য আসামের প্রসিদ্ধি ছিল। উপঢৌকন হিসেবেও সুগন্ধি কাঠ পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। বিষক্রিয়ার প্রতিষেধক এবং বিশেষ করে সর্পাঘাতের প্রতিষেধক হিসেবে বেশ কিছু উদ্ভিদ ভারতে জন্মাত। মশলার উৎপাদক হিসেবে ভারতের খ্যাতি এশিয়ার নানাদেশে ছড়িয়ে ছিল। লংকা, আদা, দারুচিনি, লবঙ্গ ইত্যাদির বিশেষ উৎপাদনক্ষেত্র ছিল গুজরাট।
মধ্যযুগের ভারতে কৃষি-উৎপাদনের মূল উৎস ছিল জমির প্রকৃতিদত্ত উৎপাদিকাশক্তি এবং বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত কিছু সেচব্যবস্থা। চাষের কাজে উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহারের বিশেষ বিবরণ পাওয়া যায় না। পরবর্তীকালে মুকুন্দরামের রচনায় হাল, লাঙল ইত্যাদি চিরাচরিত যন্ত্রের উল্লেখ থেকে অনুমান করা যায় যে, মধ্যযুগেও এই সকল যন্ত্র ব্যবহার করা হত। লোহার দাম অতিরিক্ত হওয়ায় কৃষকের পক্ষে তার ব্যবহার ব্যাপক ছিল না। অধিকাংশ এলাকায় কূপ থেকে জমিতে সেচ দেওয়া হত। মহম্মদ বিন-তুঘলক কূপ খনন করার জন্য কৃষকদের টাকা আগাম দিতেন বলে জানা যায়। কোনো কোনো স্থানে বাঁধ দিয়ে জল ধরে রেখেও সেচ দেওয়া হত। তবে বাংলাদেশে সেচকার্যে কূপের বিশেষ ব্যবহার ছিল না। কারণ, অসংখ্য নদনদী ও তাদের সাথে যুক্ত খাল থেকে জল ব্যবহারের প্রবণতা ছিল বেশি।
চতুর্দশ শতকে সরকারি উদ্যোগে খাল কেটে জমিতে সেচ দেবার কিছু প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। গিয়াসউদ্দিন তুঘলক (১৩২০-২৫ খ্রিঃ) প্রথম কৃষি সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে সেচখাল খননের উদ্যোগ নেন। ফিরোজ তুঘলকের আমলে (১৩৫১-৮৬ খ্রিঃ) সেচখাল ব্যবস্থা একটা কার্যকরী রূপ পায়। তাঁর আমলে কাটা দুটি খাল যমুনা নদী থেকে হিসার পর্যন্ত টানা হয়েছিল। এ দুটি ‘রজব-ওয়াহ’ এবং ‘উলুখ ঘানী’ নামে পরিচিত। আর একটির নাম ‘ফিরোজশাহি’। এটি শতদ্রু থেকে কাটা হয়। আর একটি খাল কালী নদী থেকে দিল্লির নিকট যমুনা পর্যন্ত কাটা ছিল। পূর্ব পাঞ্জাবের ঘর্ঘরা নদী থেকে ফিরোজাবাদ পর্যন্ত আরও একটি খাল তিনি খনন করেন।
এ ছাড়া প্রায় দেড় শতাধিক কূপ খনন করে তিনি সেচব্যবস্থা সম্প্রসারিত করেন। ইরফান হাবিবের মতে, হিসারের চতুষ্পার্শের এলাকায় সেচব্যবস্থা এতটাই সুবিন্যস্ত ছিল যে খারিফ শস্য ছাড়া সেখানে রবি চাষও ব্যাপকভাবে শুরু করা সম্ভব হয়েছিল। সুলতানি আমলে কুপ ও খাল থেকে জল উত্তোলনের জন্য এক নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে ভারতে জল তোলার জন্য আরহট্ট নাম ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। এই ব্যবস্থায় কানায় কানায় ঘটি বেঁধে দড়ির সাহায্যে জল তোলা হত।
মুসলমানদের আগমনের পরে ‘পিন-ড্রাম গিয়ারিং’ (Pin-drum gearing) ব্যবস্থা দ্বারা একটি চাকার সাথে ধাতুর কলসী বেঁধে গোরুর সাহায্যে সেই চাকাকে ঘুরিয়ে অবিরাম জল তোলার ব্যবস্থা করা হয়। বাবর তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থে এই যন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন। তাই ধরে নেওয়া যায় যে, সুলতানি আমলেই এই গিয়ারযুক্ত উত্তোলন ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। একেই বলা হয় ‘পারসিয়ান চরকা’ (Persian wheel)। পাঞ্জাব ও হরিয়ানা অঞ্চলে পারসিয়ান চরকার সাহায্যে জল তোলার প্রথা বিশেষ জনপ্রিয় ছিল।
কৃষি সরঞ্জামের অন্যান্য বিষয়গুলি ছিল গতানুগতিক। যেমন—কাঠের লাঙল, দাঁতালো মই, জমি সমান করার পাটা, গাঁইতি, কোদাল, কাস্তে ইত্যাদি। লাঙল টানার জন্য গোরু, মহিষ ইত্যাদি পশুপালনও কৃষির অঙ্গ ছিল। মালিক মহম্মদ জায়সী তাঁর ‘পদ্মাবৎ’ কাব্যে বলেছেন যে, অযোধ্যা অঞ্চলে ‘রাহাত’ (Rahat) নামে এক ধরনের জলসেচ পদ্ধতির প্রচলন ছিল, যাকে পারসিয়ান চক্রের অনুরূপ ব্যবস্থা বলা যায়। ইবন বতুতা পূর্ব বাংলার মেঘনা নদীতে পারসিয়ান চরকা ব্যবহার হত বলে উল্লেখ করেছেন। বাবর লিখেছেন যে, ‘ঢেঁকলি’ (Dhenkli) নামক এক ধরনের পদ্ধতির বিরামহীনভাবে জমিতে জলসেচ দেওয়া হত।
কৃষি-পণ্যের মূল্য সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্যের অভাব আছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, পরিবহণের অসুবিধা, প্রশাসনিক জটিলতা কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পণ্যমূল্যের ওঠাপড়া ছিল নিত্যকার ঘটনা। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের উদাসীনতা ছিল লক্ষণীয়। তবে আলাউদ্দিন খলজি পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কিছু কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। চাল, ডাল, গম, বিভিন্ন তৈলবীজ, চিনি ইত্যাদির বাজারদর গিয়াসুদ্দিন বলবনের আমলে যা ছিল, মহম্মদ-বিন-তুঘলকের আমলে তা অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। আবার ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে দর খানিকটা নেমে যায়। আফিফ মনে করেন, সুলতান বা প্রশাসনের দক্ষতার কারণে দাম নামেনি। দাম নেমেছিল ঈশ্বরের দয়ায়। অর্থাৎ উপযুক্ত বৃষ্টিপাত ও সুফলন মূল্যহ্রাসে সহায়ক হয়েছিল। লক্ষণীয় যে, রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও ইব্রাহিম লোদীর আমলে পণ্যমূল্য অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছিল। ড. অনিল ব্যানার্জীর মতে, এর পেছনে একাধিক কারণ থাকার সম্ভাবনা ছিল। যেমন—উদ্বৃত্ত উৎপাদন, রপ্তানি হ্রাস কিংবা সাধারণ ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার শৈথিল্য।
Leave a comment