সুলতানি আমলের (১২০০-১৫০০ খ্রিঃ) অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য:
তুর্কি-আফগান শাসনকালে ভারতের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মতভেদ লক্ষণীয়। মুসলমান শাসকরা ভারতের প্রচলিত অর্থনৈতিক জীবনধারাকে পূর্ববৎ অনুসরণ করেছিলেন, নাকি তাঁরা ভারতের অর্থনীতিকে মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন—এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিকেরা কিছু ভিন্ন মত পোষণ করেন। ঐতিহাসিক কোশাম্বী (D. D. Kosambi) তাঁর ‘অ্যান ইনট্রোডাকশন টু দি স্টাডি অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, ইসলামী আক্রমণকারীরা’ একটা পরিবর্তন এনেছিল, তবে ভারতে বর্তমান ‘সামন্ততন্ত্রে’র উপাদানগুলিকে অধিকতর সক্রিয় করার বেশি নতুন কিছু ছিল না। ঐতিহাসিকদের একটি গোষ্ঠী মনে করেন যে, সুলতানি শাসন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের ধারায় একটি ছেদ এনেছিল। এবং সেই পরিবর্তন ভারতীয় সমাজের অর্থনৈতিক স্বার্থকে এগিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে এদেশের বস্তুগত ও মানবিক সম্পদ ও সম্ভাবনাকে উন্মোচন ও ধ্বংসের পথে এগিয়ে দিয়েছিল। অধ্যাপক লালনজী গোপালের মতে, মুসলমানদের আগমনের ফলেই ভারতে দারিদ্র্যের সূত্রপাত হয়। অধ্যাপক কে. এস. লাল (K. S. Lal) এই মত সমর্থন করে মন্তব্য করেছেন যে, মুসলমানরা ভারতের জনসংখ্যা এক-তৃতীয়াংশের বেশি হ্রাস করেছিলেন।
সুলতানি আমলের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের স্বতন্ত্র মূল্যায়ন করেছেন অধ্যাপক মহম্মদ হাবিব। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘সুলতান মামুদ অফ গজনি’ গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেন যে, সুলতানি শাসন এবং পূর্ববর্তী শাসনের মধ্যে গুণগত পরিবর্তন ছিল স্পষ্ট। সুলতানি শাসন যে নতুন সামাজিক শক্তির জন্ম দেয়, তা পূর্ববর্তী অর্থনৈতিক সংকটের থেকে উন্নততর ছিল। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রন্থের পরিমার্জিত সংস্করণে অধ্যাপক হাবিব তাঁর বক্তব্যকে যুক্তিসহ বিশ্লেষণ করেন। তাঁর মতে, সুলতানি আমলে নগরের বিস্তার ঘটে এবং কৃষি-সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হয়। তিনি নগর ও গ্রামীণ ক্ষেত্রে দুটি মৌলিক পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। প্রথমত, মুসলিম শাসকেরা শিল্পপণ্যের উৎপাদনে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। শিল্পীর জাতপাত নিয়ে তাঁদের কোনোরূপ ছুৎমার্গ ছিল না। কিন্তু প্রাক্-সুলতানি যুগে শিল্পী-কারিগরদের জাতপাতের বিধিনিষেধ আন্তঃবৃত্তিজীবী সচলতার (inter professional mobility) বাধা সৃষ্টি করত। এখন সেই বাধা দূর হয়। দ্বিতীয়ত, সুলতানরা গ্রাম থেকে অধিকতর রাজস্ব সংগ্রহ করতে আগ্রহী ছিলেন। তাই আলাউদ্দিন খলজি কৃষকের উদ্বৃত্ত উৎপাদন আত্মসাৎকারী ও শোষক মধ্যস্বত্বভোগীদের অপসারিত করেন। অধ্যাপক হাবিবের মতে, এই দুটি পরিবর্তন এতটাই মৌলিক যে, এদের যথাক্রমে ‘নগর-বিপ্লব’ ও ‘গ্রামীণ-বিপ্লব’ আখ্যা দেওয়া যায়। অবশ্য অধ্যাপক হাবিব স্বীকার করেন যে, দিল্লির নতুন শাসকগোষ্ঠী বিশুদ্ধ জনহিতকারী চেতনা থেকে এই উন্নয়নের কাজ করেননি। বস্তুত, তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল ‘ব্যক্তিগত উন্নতির ইচ্ছা।’
এই দুটি পরস্পর-বিরোধী মূল্যায়নের একটা সমাধান সূত্র পাওয়া যায় ড. ইরফান হাবিবের বিশ্লেষণে। সুলতানি শাসনব্যবস্থা ছিল গতানুগতিক ও সমাজতান্ত্রিকতার প্রসারমাত্র—এই মতের প্রবক্তাদের সম্পর্কে তাঁর অভিমত হল যে, এঁদের মন্তব্যের ভিত্তি হল হেনরী এলিয়ট (H. Elliot ) – এর সেই বিশ্লেষণ যেখানে তিনি মুসলমান যোদ্ধাদের নিছক ‘হত্যা ও গণহত্যার’ (‘Murders and Massacres’) খলনায়ক বলে অভিহিত করেছেন। স্বভাবতই এঁদের ব্যাখ্যা সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট। অন্যদিকে, অধ্যাপক মহম্মদ হাবিবের মন্তব্য সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া মিশ্র। সুলতানি শাসন যে পূর্ববর্তী শাসনধারার অন্ধ অনুসরণ ছিল না, এ বিষয়ে ড. হাবিব একমত। তবে অধ্যাপক মহম্মদ হাবিবের বক্তব্যগুলি সবক্ষেত্রে যথেষ্ট যুক্তি ও তথ্য দ্বারা সমর্থিত হয়নি। তা ছাড়া, সুলতানি আমলের পরিবর্তনগুলিকে আধুনিক অর্থে ‘সামাজিক বিপ্লব’ বলা কিছুটা অতিরঞ্জক। তিনি লিখেছিলেন, “What the Sultanate brought about was not a social revolution in any modern sense but creation of a new system of agrarian exploitation, with a parasitical urban growth based upon it. “‘ তাঁর মতে, সুলতানি শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। বিশাল উদ্বৃত্ত পুঞ্জীভূত হয়েছিল শাসকশ্রেণির হাতে। জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা নয়, শাসকের মর্জিই ছিল সমস্ত প্রক্রিয়ার চালিকাশক্তি। সাধারণ কৃষকদের আর্থসামাজিক স্বাধীনতার অস্বীকৃতি তাদের কার্যত ‘প্রায়-দাসত্বে’র পর্যায়ে থাকতে বাধ্য করেছিল। অন্যদিকে, শহর ও বাণিজ্যের প্রসার এবং বিপুল পরিমাণে শিল্পপণ্যের উৎপাদন এই নতুন শাসনব্যবস্থাকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছিল।
Leave a comment