প্রশ্নঃ সুযােগ ব্যয় ও উৎপাদন সম্ভাবনা রেখা সম্পর্কে আলোচনা কর। 

অথবা, Opportunity Cost এবং Production Possibility Curve কাকে বলে? 

ভূমিকাঃ দুষ্প্রাপ্যতা মানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য সামৰ্থ-এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করে। ইহাই হচ্ছে মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা। এই পাঠে আমরা দেখব কিভাবে সুযােগ ব্যয় এবং উৎপাদন সম্ভাবনা রেখা দ্বারা নির্বাচন সমস্যাটি ব্যাখ্যা করা যায়।

সুযােগ ব্যয় (Opportunity Cost): অর্থনীতিবিদরা সম্পদের দুপ্রাপ্যতা এবং নির্বাচনের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য সুযােগ ব্যয় ধারণাটি ব্যবহার করে। সম্পদের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে মানুষকে অবশ্যই নির্বাচন করতে হয়। যখন আমাদের অসীম অভাবের সবটুকু পূরণ হয় না তখনই বিকল্প কিছু নির্বাচন করতে হয়। অসীম অভাবের ক্ষেত্রে একটি পেতে গেলে আরেকটি ত্যাগ করতে হয়। এই ত্যাগকৃত সুযােগের পরিমাণই হচ্ছে সুযােগ ব্যয়।

অর্থনীতিবিদদের মতে, কোন জিনিসের সুযােগ ব্যয় সর্বোত্তম বিকল্প দ্রব্যটির উৎপাদন ত্যাগের ব্যয়। সাধারণভাবে বলা যায়, একটি দ্রব্যের অতিরিক্ত একক উৎপাদন পাওয়ার জন্য অপর একটি দ্রব্যের উৎপাদন যা অবশ্যই ত্যাগ করতে হয়। এই ত্যাগের পরিমাণ হল সুযােগ ব্যয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন শিক্ষার্থীকে তার প্রাত্যহিক পড়াশুনা শেষ করে অবসর সময়ে সাইকেল চালানাে এবং গল্পের বই পড়া- এ দুটির মধ্যে যেকোন একটিকে নির্বাচন করতে হয়। সেক্ষেত্রে যদি সে সাইকেল চালানাে নির্বাচন করে তখন সাইকেল চালানাের সুযােগ ব্যয় হচ্ছে গল্পের বই পড়া।

উৎপাদন সম্ভাবনা রেখা (Production Possibility Curve): আমরা পূর্বেই জেনেছি, মানুষের অসীম অভাবের সবটুকু সমাজ কর্তৃক পূরণ হয় না। কারণ, সমাজে সম্পদ সীমিত। সমাজে প্রাপ্তব্য সম্পদ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সীমিত পরিমাণ দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করতে পারে। ইহা উৎপাদন সম্ভাবনা রেখার মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। উৎপাদন সম্ভাবনা রেখা একটি সীমানার মাধ্যমে দ্রব্য বা সেবার বিভিন্ন সংমিশ্রণ দেখায় যা উৎপাদন করা যায়।।

অধ্যাপক আর. জি. লিপসি (R. G. Lipsey) বলেন, “উৎপাদন সম্ভাবনা রেখা হলাে এমন একটি রেখা যা প্রাপ্তব্য সম্পদের পূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন দ্রব্যের বিকল্প সমন্বয়সমূহ দেখায় যা অর্জন করা সম্ভব।” একটি সমাজ শুধুমাত্র দুটি দ্রব্য উৎপাদন করে এই অনুমিতির ভিত্তিতে উৎপাদন সম্ভাবনা রেখা ব্যাখ্যা করা হয়। অন্যান্য দ্রব্য বা সেবার উৎপাদন স্থির ধরা হয়। ধরি, কোন একটি দেশ দুটি দ্রব্য উৎপাদন করে যথা কৃষিজাত দ্রব্য (খাদ্যশস্য) এবং শিল্পজাত দ্রব্য (বস্ত্র)। এ দুটি দ্রব্য উৎপাদনে বিদ্যমান সকল সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার করা হয়। একটি কাল্পনিক সূচি ও চিত্রের মাধ্যমে উৎপাদন সম্ভাবনা রেখাটি ব্যাখ্যা করা হলাে-

ছক ১.২.১ এবং চিত্র ১.২.১ অনুযায়ী দেশটির কাছে বিদ্যমান সকল সম্পদ যদি খাদ্যশস্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়, তাহলে ১১০ একক খাদ্যশস্য উৎপাদন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে বস্ত্রের উৎপাদন শূন্য হবে। ইহাকে B বিন্দু দ্বারা দেখানাে হয়েছে। আবার যদি সকল সম্পদ শুধুমাত্র বস্ত্র উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় তাহলে ১১০ একক বস্ত্র এবং ০ একক খাদ্যশস্য উৎপাদন করা যাবে। উৎপাদন সম্ভাবনা রেখার শেষ সীমানা বা প্রান্ত দ্রব্য দুটির চুড়ান্ত উৎপাদনকে নির্দেশ করে। এখানে ১১০ একক খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য ১১০ একক বস্ত্র উৎপাদন ত্যাগ করতে হয়। এক্ষেত্রে ১১০ একক খাদ্যশস্যের সুযােগ ব্যয় ১১০ একক বস্ত্র এবং একইভাবে ১১০ একক বস্ত্রের সুযােগ ব্যয় ১১০ একক খাদ্যশস্য। দেশটির সকল সম্পদ খাদ্যশস্য ও বস্ত্র উৎপাদনে ব্যবহৃত হলে উৎপাদনের বিভিন্ন সংমিশ্রণ পাওয়া যায়। চিত্রে C বিন্দুতে ৫০ একক খাদ্যশস্য ও ৯০ একক বস্ত্র এবং D বিন্দুতে ৭৫ একক খাদ্যশস্য ও ৭০ একক বস্ত্র উৎপাদিত হয় এবং E বিন্দুতে ১০০ একক খাদ্যশস্য ও ৪০ একক। বস্ত্র উৎপাদিত হয়। C থেকে D বিন্দুতে অতিরিক্ত (৭৫-৫০) =২৫ একক খাদ্যশস্য উৎপাদনে (৯০-৭০) =২০ একক বস্ত্র উৎপাদন ত্যাগ করতে হয় অর্থাৎ D বিন্দুতে, ২৫ একক খাদ্যশস্য উৎপাদনের সুযােগ ব্যয় ২০ একক বস্ত্র উৎপাদন। একইভাবে D থেকে E বিন্দুতে ২৫ একক অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদনের সুযােগ ব্যয় ৩০ একক বস্ত্র উৎপাদন। এখন A, C, D, E ও B বিন্দুগুলাে যােগ করে AB উৎপাদন সম্ভাবনা রেখা পাওয়া যায়।

অন্যদিকে, দেশটিতে বিদ্যমান সকল সম্পদ ব্যবহার করে F বিন্দুতে পৌঁছানাে সম্ভব নয়। কারণ F বিন্দু অর্থনীতিতে প্রাপ্তব্য সম্পদের সীমানার বাইরে। সুতরাং উৎপাদন সম্ভাবনা রেখার বাইরে F বিন্দু অ-অর্জনযােগ্য এলাকায় অবস্থিত । আবার, উৎপাদন সম্ভাবনা রেখার নিচে G বিন্দু অদক্ষ উৎপাদনকে নির্দেশ করে। কারণ এ বিন্দুতে অর্থনীতির সকল সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না।

সীমিত সম্পদ ও অসীম অভাবের কারণে সৃষ্ট নির্বাচন সমস্যাটি উৎপাদন সম্ভাবনা রেখার সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়। কোন দেশ বা সমাজের ক্ষেত্রে সীমিত সম্পদ দ্বারা সব অভাব বা চাওয়া পূরণ করা সম্ভব হয় না। আবার অসীম অভাবের মধ্যে সব অভাব সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ কারণে গুরুত্ব অনুযায়ী কিছু অভাবকে নির্বাচন করতে হয়। দেশ বা সমাজভেদে অভাব নির্বাচনের বিষয়টি ভিন্নতর হতে পারে। যেমন একটি দেশের কাছে অতিরিক্ত সম্পদের সংস্থান হলে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন গুরুত্ব পাবে। আবার আরেকটি দেশের ক্ষেত্রে ভােগ্য দ্রব্য উৎপাদন গুরুত্ব পেতে পারে। 

চিত্র ১.২.১ অনুযায়ী একটি দেশের সম্পূর্ণ সম্পদ ব্যবহার করলে খাদ্যশস্যের ১১০ একক উৎপাদন করতে পারে। অথবা বস্ত্রের ১১০ একক উৎপাদন করে এ দুটি দ্রব্যের অভাব পূরণ করতে পারে। কিন্তু ঐ দেশের যদি দুটি দ্রব্যের প্রয়ােজন থাকে তাহলে সীমিত সম্পদের কারণে ঐ দেশের কোন দ্রব্যটি তার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ তা নির্বাচন করতে হবে। বস্ত্রের চেয়ে খাদ্যশস্যের অভাব বা গুরুত্ব বেশি হলে চিত্রানুযায়ী ১০০ একক খাদ্যশস্য ও ৪০ একক বস্ত্র উৎপাদন করবে। অর্থাৎ সে দেশ E বিন্দু নির্বাচন করবে। বিপরীতক্রমে খাদ্যশস্যের চেয়ে বস্ত্রের অভাব বেশি হলে C বিন্দুতে ৯০ একক বস্ত্র ও ৫০ একক খাদ্যশস্য উৎপাদন করবে। অর্থাৎ দেশটিকে দুটি দ্রব্যের তুলনামূলক গুরুত্ব বিচার করতে হবে। অভাবের নির্বাচন সমস্যার সমাধান করতে হবে। এভাবে উৎপাদন সম্ভাবনা রেখার মাধ্যমে সম্পদের দুপ্রাপ্যতা ও অসীম অভাব থেকে সৃষ্ট নির্বাচন সমস্যাটি ব্যাখ্যা করা যায়।

পরিশেষঃ পরিশেষে উল্লেখ করা যায়, উৎপাদন সম্ভাবনা রেখার মাধ্যমে সম্পদের দুপ্রাপ্যতা ও অসীম অভাব থেকে সৃষ্ট নির্বাচন সমস্যাটি যথাযথভাবে সমাধান করা সম্ভব।