শিক্ষায় সুযােগের সমতাবিধানের প্রকৃত অর্থ ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক সঙ্গতি, স্ত্রী-পুরুষ অথবা অঞ্চল নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের নিজস্ব প্রবণতা ও দক্ষতা অনুসারে আত্মবিকাশের অধিকারী হওয়া। শিক্ষায় সুযােগের সমতাবিধান মূলত নির্ভর করে সুযােগের সম্প্রসারণের উপর। শিক্ষায় সুযােগের সমতাবিধানের তিনটি মৌলিক সূত্র বিদ্যমান। যথা—
- সংখ্যাগত সম্প্রসারণ,
- সামাজিক সম্প্রসারণ ও
- গুণগত সম্প্রসারণ।
(১) সংখ্যাগত সম্প্রসারণ : সংখ্যাগত বিচারে প্রাথমিক শিক্ষার সম্প্রসারণ হল শিশুর শিক্ষায় সুযােগ সৃষ্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি। কিন্তু স্বাধীনতার পর এক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে সামান্য। এক্ষেত্রে রাজ্যে-রাজ্যে, জেলায়-জেলায় ব্যবধান প্রকট হয়ে উঠেছে।
(২) সামাজিক সম্প্রসারণ: সামাজিক দিক থেকেও শিক্ষায় সুযােগের ব্যবধান খুব প্রকট। তপশিলি জাতি-উপজাতিরা এখনও সাধারণ শ্রেণি থেকে অনেক পিছিয়ে। নারীরাও সমাজের বেশিরভাগ স্তরে পুরুষদের থেকে শিক্ষায় পিছিয়ে। তবে সরকার এই অসাম্য দূর করার চেষ্টা করে চলেছে যথাসাধ্য।
(৩) গুণগত সম্প্রসারণ: সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা যে মানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযােগ পাচ্ছে সেই তুলনায় সাধারণ দরিদ্র শ্রেণি, তপশিলি জাতি-উপজাতিদের জন্য যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলির মান অনেক নীচু। বিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্রই এই বৈষম্য দেখতে পাওয়া যায়। সরকার সর্বস্তরের শিক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে পারছে না বরং এখন শিক্ষায় বেসরকারিকরণ নীতিই বেশি করে অনুসরণ করা হচ্ছে।
শিক্ষায় সুযােগের সমতাবিধানের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা একান্ত প্রয়ােজন —
(১) শিক্ষার জাতীয়করণ: শিক্ষায় সমতাবিধানের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়ােজন শিক্ষার জাতীয়করণ করা। কোনাে বেসরকারি উদ্যোগকে শিক্ষাক্ষেত্রে কাজ করতে দেওয়া চলবে না। একটি সংস্থার মাধ্যমেই শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হবে এবং সেটি হবে রাষ্ট্রীয় সংস্থা। রাষ্ট্রই পারে শিক্ষায় সুযােগের প্রকৃত সমতাবিধান করতে।
(২) সর্বসাধারণের জন্য স্কুল: শিক্ষায় সুযােগের সমতাবিধানের পরবর্তী পদক্ষেপ হল সর্বসাধারণের জন্য স্কুল’ বা ‘সকলের জন্য এক স্কুল’ (Common School)-এর ব্যবস্থা করা। এই ধরনের স্কুলের বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
- সব স্কুল সবার জন্য খােলা থাকবে।
- অভিভাবকদের সম্পদ বা অর্থের উপর শিক্ষা নির্ভর করবে না, নির্ভর করবে শিশুর মেধা ও প্রতিভার উপর।
- কোনাে বেতন নেওয়া হবে না।
- শিক্ষার মান সব স্কুলেই সমান হবে।
(৩) অঞ্চলভেদে শিক্ষালাভের সুযােগের বৈষম্য দূরীকরণ: শিক্ষায় সমসুযােগ সৃষ্টির জন্য কার্যকরী তৃতীয় পদক্ষেপ হল অঞ্চলভেদে শিক্ষালাভের সুযােগের বৈষম্য দূর করতে হবে, ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে রাজ্যভেদে এমনকি জেলাভেদেও শিক্ষায় সুযােগের যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়, রাজ্যগুলির শিক্ষাখাতে ব্যয়ের মধ্যে বৈষম্য দেখা যায়, এই বৈষম্য দূর করতে হবে। রাজ্যস্তরে জেলাগুলিতে শিক্ষার উন্নতির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় স্তরে ভারত সরকারের দায়িত্ব থাকবে বিভিন্ন রাজ্যগুলিতে যাতে সমানভাবে শিক্ষবিস্তার হয়, সেদিকে নজর দেওয়া। অনগ্রসর রাজ্যগুলিকে শিক্ষাখাতে বিশেষ সাহায্য দিতে হবে।
(৪) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মানের অসমতা দূরীকরণ: গ্রাম ও শহরাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার মান সমান রাখতে হবে। শিশুদের মেধার উপর ভিত্তি করে বিদ্যালয়গুলিতে প্রবেশাধিকার থাকবে, অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে নয়। ভারতবর্ষের গ্রামগুলিতে যথেষ্ট সংখ্যায় বিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে, যাতে গ্রামের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার সুযােগ থেকে বঞ্চিত না হয়।
(৫) নারীশিক্ষার বিস্তার: সমাজের সর্বক্ষেত্রে মেয়েদের শিক্ষার দিকে নজর দিতে হবে। মানবসম্পদের পূর্ণ ও যথাযােগ্য বিকাশের জন্য, সামাজিক ন্যায় স্থাপন, গৃহপরিবেশের উন্নতি ও পরিবার পরিকল্পনার জন্য নারীশিক্ষার একান্ত প্রয়ােজন।
(৬) বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে বুক ব্যাংক (Book Bank) স্থাপন, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ঋণবৃত্তির (Loan Scholarship) ব্যবস্থা গ্রহণ, নবাগত শিক্ষার্থীদের উৎসাহদানের জন্য উপহার প্রদান, অসচ্ছল অথচ মেধাবী প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের বিশেষ বই প্রদানের ব্যবস্থা করা, মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি।
শিক্ষায় সমসুযােগ প্রদানের ক্ষেত্রে কোঠারি কমিশন (১৯৬৪-৬৬ খ্রি.) ও কমন স্কুল প্রতিষ্ঠার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল। তা ছাড়া সমাজের সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের সর্বপ্রকার শিক্ষাক্ষেত্রে অবাধ প্রবেশদানের উপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছিল।
Leave a comment