রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কবিতা ভাবে ও ভাবনায় যুদ্ধোত্তর আধুনিক জীবনের প্রতিফলন ঘটিয়েছে তার ভাষায় ও ভঙ্গিতে। বিশ শতকের প্রথম চার দশক প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল সমগ্র বিশ্বের সামাজিক আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই এক ক্রান্তিকাল। মাত্র দুটি দশকের মধ্যে দুটি বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত মানুষের রোম্যান্টিক স্বপ্নকল্পনার জগতটিকে নিঃশেষে বিধ্বস্ত করে দেয়। যুদ্ধের ফলে বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক সংকট, সেইসঙ্গে ভারতীয় ক্ষেত্রে কালোবাজারী ও নেতৃবর্গের আত্মস্বার্থ রক্ষার লোলুপতা ও ক্ষমতার নগ্ন রাজনীতি সমগ্র সামাজিক ব্যবস্থাকে এক সর্বনাশের পথে দাঁড় করিয়ে দিল। আধুনিক কবিতার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে গেল নৈরাশ্য ও হতাশা। প্রতিকারহীন সর্বনাশা চোরাবালি যেন গ্রাস করল বাংলার গ্রাম ও শহরকে। গুঁড়িয়ে গেল মূল্যবোধ, নষ্ট হল প্রেম প্রীতি ভালোবাসার মূল্য। আধুনিক কবিদের কবিতায় এই স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস বিধৃত। সমকালীন যুগসংকট ও যুগমূর্তি অঙ্কনেই আধুনিক কবিতা রবীন্দ্র কাব্যধারার দিক-বদল ঘটিয়েছে।

রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কবিরা বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রোমান্সের স্বপ্ন-স্বর্গকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে চাইলেন। তাঁরা মনে করলেন, অন্তত এই যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, ঔপনিবেশিক শোষণ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, বেকারত্ব, কালোবাজারিতে বিপর্যস্ত—নষ্ট—রোগগ্রস্ত পৃথিবীতে আজ আর কোকিলের গান বা মধুর প্রেমের স্বপ্ন দেখা অর্থহীন। সমস্ত মানবিক মূল্যবোধ এখন অপচিত। তাই এ যুগের কবিরা ‘জন্মরোম্যান্টিক’ রবীন্দ্রনাথকে প্রায় উচ্চ-ঘোষণায় প্রত্যাখ্যান করতে চাইলেন। কখনো কখনো আধুনিক কবিরা রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথেরই কাব্যপক্তি ও অনুষঙ্গ ব্যবহার করে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ’ কবিতাটিতেও রবীন্দ্রযুগের থেকে যুদ্ধোত্তর আধুনিক যুগের চূড়ান্ত নাগরিকতার সুবিশাল পার্থক্যটি তুলে ধরা হয়েছে খুব সচেতনভাবেই একটি বিশিষ্ট রবীন্দ্র-কবিতার অনুষঙ্গ ব্যবহার করে।

রবীন্দ্রনাথের ‘বন্ধু’ কবিতা মানস-কেন্দ্রে নিহিত আছে উনিশ শতকের ভাব ও ভাবনা। পল্লী বাংলা তখনও নিঃশেষে ধ্বংস হয়নি। গ্রাম বাংলার মোহময় উদার মুক্ত প্রকৃতির মায়াঞ্জন তখনও আঁকা ছিল কবির অন্তরপটে, এবং তা অসত্যও ছিল না হয়তো। কিন্তু বিশ শতকের তৃতীয় বা চতুর্থ দশকের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি তথা গ্রাম ও নগরের যুগপরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। মাত্র দুটি দশকের মধ্যে দু-দুটি মহাযুদ্ধ সমগ্র বিশ্বের আর্থ-সামাজিক ভিত্তিই কম্পিত করে দিয়েছে। পরিবর্তিত হয়ে গেছে মানুষের ন্যায়-নীতি, প্রেম-প্রীতি সম্পর্কিত ধারণা, নড়ে গেছে মূল্যবোধের সাবেক ভূমি, বদলে গেছে জীবন সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ’ কবিতায় উঠে এসেছে অন্যতর সময়, অন্যতর ভাবনা।

দুটি কবিতাতেই দেখি গ্রামের সরল প্রাণময় এক নারী বিবাহসূত্রে তার স্বামী বা প্রণয়ীর সঙ্গে এসে পড়েছে কলকাতা নগরের ইট-কাঠ-পাথরের বন্দীশালায়। নগরের যান্ত্রিকতা, প্রাণহীন মমত্বহীন জীবন, প্রকৃতি-বিচ্ছিন্নতা উভয়ক্ষেত্রেই তাদের মানস-যন্ত্রণার কারণ হয়েছে। কিন্তু কালগত প্রভেদে কবিতা দুটির মধ্যে ভাবনার ও জীবনবোধের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিতার সূচনাতেই একদিকে যেমন রবীন্দ্র-পঙ্ক্তির অংশ ব্যবহার করে কবিতার বিষয়-সূত্রটি ধরিয়ে দিয়েছেন পাঠককে, তেমনি পাশাপাশি স্বকাল-সচেতনভাবে বিশ শতকের প্রথমার্ধের কলকাতার পরিবেশটিকেও ধরেছেন অব্যর্থভাবে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ’ কবিতাটির মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে সমকালীন যুগের বঙ্গীয় নগরজীবনের আর্থ-সামাজিক চিত্র এবং তৎকালীন নাগরিক জীবনের ও পরিবেশের পরিচয়। বিশ শতকের প্রথমার্ধেও নাগরিক কলকাতায় বিগত শতকের সেইসব পুরোনো ফেরিওয়ালাদের ডাক শুনতে পাওয়া যেত। এখানে কবি ‘পুরোনো সুর ফেরিওয়ার ডাকে’—এই উচ্চারণে যুগগতক্রান্তলগ্নটিকে চিহ্নিত করেছেন। দিনের আলো নিভে আসার প্রসঙ্গে পুরোনো ফেরিওয়ালার ডাকের প্রসঙ্গ এনে কবি বোঝাতে চান যে, উনিশ শতক ফুরিয়ে যাচ্ছে নিঃশেষে ; নতুন বিশ শতক এসেছে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে এসেছে বেতার যন্ত্র তথা রেডিয়ো নামক মনোরঞ্জনের উপকরণটি। কিন্তু তখনও গ্যাসের আলোয় আলোকিত হয় নগর কলকাতার রাজপথ। কলকাতার পথে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা তখনও হয়নি।

কিন্তু এ তো কলকাতার বাহ্য চেহারা। আসলে ভিতরে ভিতরে কলকাতার বুকের গভীরে সঞ্চিত হয়ে গেছে পুঁজিবাদী নগরের ব্যাধি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা ধরা পড়েছে এই কবিতায়। তৎকালীন বাংলারও আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে স্পষ্টভাবে পড়েছে যুদ্ধকালীন বিপর্যয়ের ছাপ। এই নাগরিক জীবনে হৃদয়ের ভালোবাসা মূল্যহীন। তাই রবীন্দ্রনাথের মতো সুভাষের নারীটিও বলে— ‘পাষাণ-কায়া, হায় রে রাজধানী।”

এখানে জীবনধারণের জন্য আর কিছু প্রয়োজন নেই। হৃদয় বা ভালোবাসা কিংবা মমতা নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়। কেবল ‘তেজারতির মতন কিছু পুঁজি’ সঙ্গে থাকলেই এই হৃদয়হীন নগরে টিকে থাকা সম্ভব। কদর্য কুসীদজীবীর মতো কেবল দ্বিগুণ বা তারও বেশি মুনাফাই লক্ষ এই নাগরিক জীবনের। নগরের পথে পথে তাই দেখি মুনাফা-সন্ধানী পেশোয়ারী সুদব্যবসায়ীর তাড়না। এই কবিতার বধূটির জবানীতে দেখতে পাই—

“দ্বারের ফাঁকে দেখতে পাই যেন 

আসছে লাঠি উচিয়ে পেশোয়ারী।”

তাই কবিতার বধূটির কণ্ঠে মূল্যবোধহীন হৃদয়হীন মুনাফাসর্বস্ব নাগরিক জীবনযাপনের বেদনা ও অর্থহীনতা প্রকাশিত হয়েছে।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই কবিতাটিতে বিংশ শতকের তৃতীয় বা চতুর্থ দশকের নাগরিক জীবনের যে মানসিকতা প্রতিফলিত, সেখানে আত্মনাশের পরিবর্তে অস্তিত্বরক্ষার সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত। রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ’টি যেখানে আত্মহননের মধ্য দিয়ে এই যান্ত্রিকতার ও মমত্বহীনতার বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছিল, সেখানে সুভাষের ‘বধূ’টি একবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করলেও শেষপর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নেয়নি। আধুনিক যুগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অস্তিত্ব রক্ষাকেই সে প্রাধান্য দিয়েছে। তবে এই অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে নাগরিক জীবনের ক্লেদ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেনি বধূটি। যে শুধু হৃদয়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা চেয়েছিল, প্রবঞ্চিত হয়েও কঠিন জীবন-বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে সে এখন বুঝেছে, এখানে ক্রন্দনের কোনো দাম নেই। গ্রাম থেকে যে প্রণয়ীর সঙ্গে সে ভালোবাসার তাগিদে গেরুয়ার ছদ্মবেশ নিয়ে গ্রাম ছেড়েছিল, সেই প্রণয়ীও যখন ঋণভাৱে জর্জরিত হয়ে প্রেম ভুলে—অসহায় বধূটির প্রতি দায়িত্ব ভুলে উধাও হয়, তখন ক্রন্দন বৃথা জেনে বেদনা বুকে চেপে নাগরিক জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে বাঁচতে চায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নায়িকা। সন্ধ্যায় গলির মোড়ে জলের কলের থেকে জল আনার সময় কোনো পরিচিত বা অপরিচিত পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে ‘সখা’ সম্বোধনে বিশ্রস্তালাপের মধ্যে যেন ইঙ্গিত পাই তার বর্তমান জৈবিক অস্তিত্বরক্ষার কদর্য উপায়টির। কবি যেন ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিতে চান, অসুস্থ যুগের প্রকোপে, নাগরিক জীবনের পঙ্কিলতায় কেমন করে গ্রামের প্রাণময়ী এক সত্তাও হারিয়ে যায় কদর্য অন্ধকারে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বলার ভঙ্গিতে লগ্ন হয়ে থাকে এই নাগরিক অস্তিত্বের অর্থহীন গ্লানির প্রতি সংহত অথচ তীব্র ব্যঙ্গ –

“বুঝেছি কাদা হেথায় বৃথা ; তাই

কাছেই পথে জলের কলে, সখা

কলসি কাঁখে চলেছি মৃদু চালে…..”

ফলে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ’ কবিতাটিকে বলা চলে আধুনিক বিশ্বযুদ্ধোত্তর মুনাফা-সন্ধানী মমতাহীন বঙ্গ-নগরের অসহায়তা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থিক এবং মানসিক অবক্ষয়ের সাংকেতিক দলিল।