প্রশ্নঃ সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের ইতিবাচক দিকসমূহ আলােচনা কর।

অথবা, সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের সুবিধা আলােচনা কর।

অথবা, সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের গুণাবলি আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ প্রত্যেক রাষ্ট্রের নিজস্ব সংবিধান থাকে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সরকারের রূপ সংবিধানের দ্বারাই নির্ধারিত হয়। সরকার ও জনগণের মধ্যে কি সম্পর্ক থাকবে তাও সংবিধান কর্তৃক নির্ধারিত হয়। সংবিধান হলাে রাষ্ট্রের সেসব বিধিবদ্ধ নিয়ম ও নীতিমালা, যা দ্বারা রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়। একটি রাষ্ট্রে সংবিধান সরকারের সৃষ্টি নয়, বরং সরকারই সংবিধানের সৃষ্টি। Aristotle বলেছেন, “Constitution is the way of life, the state has chosen for itself.” যাহােক, বিভিন্ন রাষ্ট্রে সংবিধান বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। অর্থাৎ সংবিধানের প্রকারভেদ রয়েছে। এর মধ্যে সুপরিবর্তনীয় সংবিধান অন্যতম।

সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের গুণাবলি বা ইতিবাচক দিক (Merits of flexible-constitution): সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের কতকগুলাে গুণ বা সুবিধা রয়েছে। লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বলেছেন, “The (flexible. constitution) can be stretched or bent so as to meet emergencies without breaking their framework and when the emergency has passed, they slip back into their old form like a tree whose outer branches have been pulled aside to let a vehicle pass.” নিম্নে সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের গুণাবলিসমূহ আলােচনা করা হলাে-

১. গতিশীলতাঃ সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের প্রধান গুণাবলি হলাে- এটা গতিশীল এবং পরিবর্তিত পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার সাথে খাপখাওয়ায়ে চলতে পারে। এটি সামাজিক পরিবর্তন ও জনগণের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য বিধানে চলতে সক্ষম। সুপরিবর্তনীয় শাসনতন্ত্র রক্ষণশীলতার ত্রুটি থেকে মুক্ত।

২. সহজে আইন প্রণয়ন ও জরুরি অবস্থায় উপযােগীঃ সংবিধান সুপরিবর্তনীয় হলে সহজে তা সংশােধন করে জরুরি অবস্থার মােকাবিলা করা সম্ভব। দেশের আর্থসামাজিক বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোন সংকট দেখা দিলে দ্রুত এবং দঢ়তার সাথে তার মােকাবিলা করতে হয়। এ রকম অবস্থায় সুপরিবর্তনীয় সংবিধান বিশেষভাবে উপযােগী। কারণ সহজেই সংবিধান সংশােধন করে অবস্থার উপযােগী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এ প্রসঙ্গে লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বলেছেন, “মৌলিক কাঠামাের পরিবর্তন না করেও সুপরিবর্তনীয় শাসনতন্ত্রকে জরুরি অবস্থায় প্রয়ােজনমতাে রদবদল করা যায়।” তাছাড়া আইন প্রণয়নের জন্য জঠিলতা পরিহার করা মঙ্গলজনক। সুপরিবর্তনীয় সংবিধান এর জন্য সহায়ক।

৩. মানবাধিকার সংরক্ষণঃ সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের আরেকটি গুণ হচ্ছে এর দ্বারা মানবাধিকার সংরক্ষিত হয়। সমাজে অবস্থানরত বিভিন্ন গােষ্ঠীর ন্যায্য দাবি মিটাতে সরকার সহজেই এরূপ সংবিধান করে তাদের অধিকার সংরক্ষণে উদ্যোগী হতে পারে। কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ই চায় না যে, তাদের মৌলিক অধিকার সংখ্যাগুরুর দ্বারা খর্বিত হােক। এরূপ পরিস্থিতিতে সুপরিবর্তনীয় সংবিধান একমাত্র কাম্য।

৪. পরিবর্তনশীলতাঃ শাসনতন্ত্র রাষ্ট্রের জীবন বিধান, তাই স্থবির (Static) হতে পারে না, হবে পরিবর্তনশীল। অহরহ সমাজের পরিবর্তন ঘটছে এবং তার সাথে সাথে ঘটছে জনসাধারণের মনমানসিকতার পরিবর্তন। এ সংবিধান কোন প্রকার পরিবর্তনের পথে অন্তরায় হয় না। বিচারপতি কুলি (Cooley) বলেছেন, “জনগণের সরকারের জন্য যেসব শাসন রচিত হয়েছে তার মধ্যে ভালাে হলাে সেটাই যেটি জাতীয় জীবনের স্বাভাবিক পরিবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। এজন্য সংবিধান হবে গতিশীল বা নমনীয় প্রকৃতির।”

৫. বিপ্লব বা উত্তেজনা হ্রাসঃ জনসাধারণের মধ্যে শাসনব্যবস্থার কোন পরিবর্তনের ব্যাপারে দাবির সৃষ্টি হলে তা উত্তেজনা বা সংঘর্ষে পরিণত হওয়ার পূর্বেই প্রয়ােজন মাফিক শাসনতন্ত্র সংশােধন করে জনগণের উত্তেজনা প্রশমনের ব্যবস্থা করা যায়। সুপরিবর্তনীয় শাসনতন্ত্রের ক্ষেত্রেই এ সুবিধা পাওয়া যায়। কাজেই সুপরিবর্তনীয় সংবিধান বিপ্লবকে এড়াতে সাহায্য করে।

৬. প্রথা নির্ভরঃ প্রথা নির্ভর দেশের জন্য সুপরিবর্তনীয়ই সবচেয়ে বেশি উপযােগী। এজন্য আমরা ব্রিটেনে সুপরিবর্তনীয় শাসনতন্ত্র দেখতে পাই। বিভিন্ন প্রকার প্রথা ও প্রচলিত রীতিনীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে এ সংবিধানকে চলতে হয়। অতএব তা দুস্পরিবর্তনীয় হতে পারে না।

৭. নতুন রাষ্ট্রের জন্য আবশ্যকঃ নতুন রাষ্ট্রের জন্য এটা খুব বেশি সহায়ক হয়। নতুন কোন স্থায়ী পরিকল্পনার মাধ্যমে নীতিসমূহ নির্ধারণ করার আবশ্যকতা দেখা দেয়। এজন্য এসব রাষ্ট্রে নমনীয় প্রকৃতির শাসনতন্ত্র প্রয়ােজন।

৮. স্বয়ংসম্পূর্ণঃ সুপরিবর্তনীয় সংবিধান হচ্ছে মূলত সংস্করণমূলক সংবিধান। তাই প্রয়ােজন মাফিক যে কোন খুঁটিনাটি বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। ফলে এরূপ সংবিধান শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়।

৯. প্রগতির সহায়কঃ এরূপ সংবিধান প্রগতিবাদী সমাজের পক্ষে বিশেষভাবে কল্যাণকর। কারণ এটা নতুন নতুন ভাবধারা গ্রহণ করে সমাজকে প্রগতির পথে চালিত করে। দ্রুত ও সহজ পরিবর্তনশীলতার জন্য এ সংবিধানের অধীনে প্রয়ােজনীয় উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা হাতে নেয়া যায়।

১০. ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টিঃ শত প্রকার সতর্কাবস্থা অবলম্বন করা হােক না কেন, কোন দেশই নিখুঁতরূপে সংবিধান রচনা করতে পারে না। কিছু না কিছু দোষত্রুটি এর মধ্যে থেকেই যাবে। ভবিষ্যৎ সকল বিষয়ের প্রতি দূরদৃষ্টি রাখাও সম্ভব হয় না। সেজন্য সংবিধানের সংশােধন ও পরিবর্তনের বিধান থাকা আবশ্যক। তাই সুপরিবর্তনীয় সংবিধান অধিক সহায়ক।

১১. সহজ সংশােধনীঃ সহজে পরিবর্তনীয়তার কারণে অনেক সময় শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক কলহ বিবাদের অবসান ঘটান সম্ভব হয়। সেজন্য বিপ্লবের পথ রােধ হয়। তাই বলা হয় যে, “Flexible constitution bends but does not break.”

১২. লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) এর মতেঃ লর্ড ব্রাইস বলেন, “বৃক্ষের শাখাপ্রশাখা রাস্তার দিকে সম্প্রসারিত হলে যেমন সেগুলােকে অপসারিত করে যানবাহন চলাচলের পথ করা সম্ভব, তেমনি সুপরিবর্তনীয় সংবিধানকে সাময়িকভাবে সময়ােপযােগী করে নেয়া সম্ভব।”

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, একটি দেশের সংবিধান হবে সময়ের চাহিদা পূরণকারী। আর সে চাহিদা পূরণে দরকার সুপরিবর্তনীয় সংবিধান, যে সংবিধান যে কোন পরিস্থিতি মােকাবিলায় সহজে পরিবর্তন করা যায়।