পত্রিকা ও প্রকাশকাল সম্পর্কে ‘সুচেতনা’ কবিতাটি একটু দ্বিধায় পড়তে হয় কেননা কবিতাটি ঠিক কোন্ পত্রিকায় বেরিয়েছিল তার উল্লেখ নেই। আগেও কোনো পত্রিকায় বেরিয়েছিল কিনা সে বিষয়েও নিশ্চিত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি (মূলত তাঁর কাব্য সমগ্র ঘেটে)। ‘সুচেতনা’র মূল কাব্য গ্রন্থ হল ‘বনলতা সেন’। এই ‘বনলতা সেন’ কাব্য গ্রন্থটি যখন পৌষ ১৩৪৯ এ কবিতা ভবন (২০২ রাসবিহারী এভিনিউ কলকাতা) থেকে প্রকাশিত হয় (প্রথম) তখন এর অন্তর্ভুক্ত কবিতা ছিল মোট বারোটি তার মধ্যে ‘‘সুচেতনা’ কবিতাটি ছিল না। কিন্তু বইটির যখন দ্বিতীয় সংস্কারণ (প্রথম সিগনেট সংস্করণ) বের হয় তখন আঠাশ সংখ্যক কবিতা ছিল ‘সুচেতনা’

সুচেতনা নামটি শোনা মাত্রই আমাদের হয়তো মর্মভেদী প্রেমময়ী আকাঙ্ক্ষার এক নারীর কথা মনে হতে পারে সঙ্গে এও মনে হতে পারে এ নিতান্তই প্রেমের কবিতা। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনানন্দের ‘সুচেতনা’ কবিতা পাঠ করা নিতান্তই আহাম্মকের কাজ করা হবে, সব চাইতে বড়ো কথা জীবনানন্দকে বা জীবনানন্দের কবিতাকে এক দৃষ্টিতে দেখেই মূল্যায়ন করতে যাওয়া ঠিক হবে না। সুচেতনা কবিতার মধ্যে একই সঙ্গে দ্বিস্তরিক চিন্তা ও ভাবনা প্রবাহিত। একদিকে বোধিসত্তাল অন্যদিকে সারাবিশ্বময় যে রাষ্ট্রনৈতিক সংকট ও সমস্যা হ’ল তার সারাৎসার মর্মবাণী—আরও বলে রাখা ভালো জীবনানন্দ নায়িকার নাম দিয়ে অনেক কবিতাই লিখেছেন কিন্তু সেই নায়িকারা তাদের ব্যক্তি নামে সার্থকতার চেয়ে ব্যঞ্জনাগত নামের সার্থকতায় ছুটেছে অর্থাৎ নায়িকা সংরক্ষিত না হয়ে মৌল সমস্যার দিকে এগিয়ে গেছে তাদের দীর্ঘবশা হাতে করে।

জীবনানন্দ তাঁর ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধ ‘উত্তররৈবকি বাংলা কাব্য’ প্রবন্ধে জানিয়েছেন—‘কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার কবিতার অস্থির ভেতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।” তাই সুচেতনা কবিতা পর্বে–পরিচ্ছন্নকাল জ্ঞানের বিশেষ দরকার হয়ে পড়ে। প্রথমেই জীবনানন্দের কবিতায় একটি দ্বিস্তরিক চিন্তা ও চেতনা থাকে তার প্রমাণ ‘সুচেতনা’ কবিতাটির প্রথম স্তবক লক্ষ করলেই পরিষ্কার— 

সুচেতনা তুমি এক দূরতর দ্বীপ 

বিকেলের নক্ষত্রের কাছে ; 

সেইখানে দারুচিনি বনানীর ফাঁকে

নির্জনতা আছে।

এই পৃথিবীর রণরক্ত সফলতা সত্য, তবুও শেষসত্য নয় 

কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে

তবু তোমার কাছে আমার হৃদয়।

কবিতায় শুধু এই অংশটি পাঠ করলে পাঠকের মনে হতে পারে (ক্ষণিকের হলেও) এ এক মর্মভুদ প্রেমের অভিব্যক্তি কিন্তু তা নয়। সুচেতনা অর্থে আমরা যাকে প্রেয়সী রূপে কল্পনা করতে চাইছি সে কোনো নাম বাচক বিশেষ্যপদ নয় সে হ’ল বিশেষণ। সুচেতনার অর্থ শুভচেতনা।

কবিতাটি ‘বনলতা সেন’ কাব্য গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে দ্বিতীয় সংস্করণে সুচিন্তিত ভাবেই কবিতাটিকে এই কাব্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাহলে বলা যেতে পারে এই কাব্যের মৌল চিন্তা ভাবনার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই এর অন্তর্ভুক্ত। ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতা ‘বনলতা সেন’ সেখানে কবির সকাতর স্বীকারোক্তি ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’। অন্যদিকে নীড়ের প্রত্যাশা। সেই নীড় প্রত্যাশাময় নায়কই সুচেতনা কবিতায় বলেছেন— 

আজিকে অনেক রূঢ় রৌদ্রে ঘুরে প্রাণ 

পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো 

ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু 

দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত 

ভাইবোন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে ;

জীবনানন্দের নায়ক যদি নিজেকে কর্তা না ভেবে নিজেকে নিমিত্ত মাত্র ভাবতে পারত তবে হয়তো সান্ত্বনা মিলত। কিন্তু এখানে তিনি কর্তা। সুতরাং নিজের অচেতনে নিজের পরম একান্ত প্রিয় ইচ্ছাগুলোকে (ভাইবোন বন্ধু) হত্যা করতে অগ্রসর হয়ে আজকের মানুষ অবশেষে একসময় লক্ষ করেছে ভালোবাসাতে গিয়ে ভালোবাসাকে হত্যা করেছেন। অস্তিবাদী দার্শনিকেরা এই অবস্থাকেই বলেছেন স্বাধীনতার সীমা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতা। ইচ্ছার স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা। কিন্তু আজকের মানুষের সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা এই স্বাধীনতার বিলোপে। ফলে তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন অজস্র খণ্ড খণ্ড মৃত্যুতে গড়ে ওঠে কিন্তু টুকরো টুকরো মৃত্যুতে গড়ে ওঠে এই জীবনে দেহ ধারণ কি বেঁচে থাকা? জীবনানন্দ একে বেঁচে থাকা বলেননি—

‘না এলেই ভালো হ’ত অনুভব করে

এসেযে গভীর তরা লাভ হ’ল সে সব বুঝেছি।

এ এক ধরনের তাচ্ছিল্য-জীবনের প্রতি। যেমন করে তাচ্ছিল্য দেখিয়েছেন কলকাতার প্রতি ‘কল্লোলিনী’ শব্দটি ব্যবহার করে। তবে এই টুকরো মৃত্যুটা থাকত না জীবনানন্দের কাছে—

‘আজকের জীবনের এই টুকরো মৃত্যু আর থাকত না, 

থাকত না আর আজকের জীবনের

টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার; 

আমি যদি বনহংস হতাম 

বনহংসী হতে যদি তুমি

দ্বিধায়, সংশয়ে জর্জরিত বোধে, কবি অনুভব করেছেন চিন্তা চেতনা যুক্ত প্রাণী মানুষের পৃথিবী থেকে এই বোধের মুক্তি নেই যা চোখ, বুক ও মাথার চারপাশে। তাই মানুষ নয় ‘বনহংস’ ও ‘বনহংসী’ হতে হবে যেখানে চেতনা থাকলেও চিন্তা থাকবে না। কবিতার দ্বিতীয় স্তবকের শেষের দুই লাইন হল—

পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুস্থ এখন ; 

মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।

রূঢ় রৌদ্র পরিভ্রমণে ফলস্বরূপ চিন্তা-চেতনা-বোধিসত্তায় কবির গভীরতর অসুখের কথা মনে হয়েছে। এখন তার প্রশ্ন জাগে এর পূর্বে কি কোনো অসুখ ছিল না, ছিল—তবে ‘গভীর’ শব্দটি দু’বার ব্যবহার করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে অসুখ কেমন। তবে মানুষে মানুষে বিশ্বাস রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনৈতিক পরিকাঠামো সবই পার্থিব উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাওয়া উচিত, সবকিছু যদি সঠিক ভাবে চলে তবে অসুখ কেন হবে? যখন শরীরের কোনো একটি অংশ বিকল হয় তখনই অসুখ শুরু হয় সেই অংশটি সারিয়ে না তুললে ধীরে ধীরে অসুখ বাড়তেই থাকে। সামাজিক পরিকাঠামো নিয়ন্ত্রিত হয় রাষ্ট্রধারা। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হয় তার প্রতিভার মতামত এবং বিশেষ সম্মিলিত সুচিস্তার মতামতের দ্বারা। কিন্তু অক্ষমের গান—বিশ্বের মিলিত চিন্তাই যখন বিফল হয়ে মেতে ওঠে ধুন্ধুমার দাঙ্গামায় তখন অসুখ গভীর হয়ে ওঠে। তাই কবি একত্র উচ্চারণ করেছেন—

আমার চোখের সামনে আনিয়োনা সৈন্যদের মশালের রং

দামামা থামায়ে ফেলো-পেঁচার পাখার মতো

অন্ধকারে ডুবে যাক

রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ্।

কিন্তু জীবনানন্দ তবুও নিজের অভিমত দিয়েছেন—‘মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীর কাছে। রিলকে তার ‘Ninth Elegy’তে ক্ষণস্থায়িত্ব থেকেই প্রশ্নচ্ছলে উত্তর খুঁজেছিলেন—’Can it ever be cancelled’ জীবনানন্দও বলেছেন ‘….তবুও ঋণী’ অর্থাৎ অপূর্ণতা সত্ত্বেও এই জগৎ বর্জনীয় নয় এবং বর্জনীয় নয় এইজন্য যে, যা মানুষের জীবনের বর্জ্য পদার্থের সমতুল চিন্তা, তাকে সময় দিতে হয় কেননা বর্জ্য পদার্থ পচে একসময় সার পদার্থ তৈরি হয়।

Thomas Hardy তাঁর ‘In Time of the Breaking of Nations’ কবিতায় বলেছেন যুদ্ধ থাকবে, মৃত্যু থাকবে, প্রেম থাকবে, কর্মও থাকবে, কোনো কিছুর জন্যই কোনো কিছু আটকে যাবে না। সমস্ত কিছুই সঞ্চারমান, একটির জন্য আর একটি বন্ধ হবে না। একে অন্যের পরিপূর্বক তবে নাও হতে পারে, সুতরাং চলমানতাই শেষ কথা। তাই তৃতীয় স্তবকে কবি যখনই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বলেন—’কেবল জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে/দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয় ;/ সেই শস্য অগণন মানুষের শব/ শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়/ সমস্তই খেটে খাওয়া Proletarian-রা রক্ত ঘামের বিনিময়ে উৎপন্ন করে এবং বাণিজ্যিক লেনদেনের হার বৃদ্ধি করে কিন্তু তারাই শেষ পর্যন্ত সর্বস্বান্ত, ক্লান্ত অনাহূত হতাশের দল। চিন দেশের জ্ঞানী পুরুষ কনফুসিয়াসের মতো ব্যক্তিত্ব যেমন নীরব থাকেন তেমনি আমাদের বুদ্ধিজীবী প্রগতিশীলদেরও এই শোষণ উৎপীড়নের যন্ত্রণা দেখে মূক হয়ে নীরবতা পালন করতে দেখি। কিন্তু পৃথিবী চলমান সূর্য উঠবেই Continuation-ই শেষ কথা তাই—–‘তবু চারিদিকে রক্ত ক্লান্ত কাজের আহ্বান’ ‘তবু’ মুক্তি সম্ভব হবে সুচেতনাকে সাথী করে।

এই পথে আলো জ্বেলে—এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি’ হবে অর্থাৎ এই পৃথিবীর সন্ধান একমাত্র কাজের পথ, কিন্তু জীবনানন্দ লক্ষ করেছেন কাজের মধ্যে দিয়ে হলেও সে সুদূরপ্রসারী এক প্রকল্প, হঠাৎই হয়ে উঠবে না। বৃহত্তর রোগ ধরা পড়ার পরই সেটা সারিয়ে তোলা সম্ভব নয় এবং হঠাৎ-ই সারিয়ে তুললে তা পুনরায় ভঙ্গুর হয়। সুতরাং জীবনানন্দ সচেতনভাবে বলেছেন—

“সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ

এ বাতাস কি পরম সূর্য করোজ্জ্বল 

প্রায় ততদূর ভালো মানব সমাজ

আমাদের মতো ক্লান্ত কান্তিহীন নাবিকের হাতে

গড়ে দেবো, আজ নয় ঢের দূর অন্তিম প্রভাবে।”

এখানেই ‘সুচেতনা’ কবিতাটির স্বরূপ ও মর্মার্থ। ‘ভালো মানব সমাজ’ গড়ার জন্যই সুচেতনার আহ্বান কবি করেছেন কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্ত অথচ ক্লান্তিহীন অর্থাৎ দায়বদ্ধ মনীষীদের দ্বারাই আসবে সুসভ্যতার আলোক। একদিকে নয়, ঢের দিন পরে। কেননা সমাজে যা রাষ্ট্রে শুধুমাত্র ধ্বংসকারীরাই বিরাজ করেন না, একই সঙ্গে দুটি শ্রেণিই বিরাজ করে। একদল অবিবেচক যারা শুধু ধ্বংসের সিদ্ধান্ত অবিচল, অনড় আর একদল প্রগতিবান যারা ধীরে ধীরে নতুন করে আবার সমাজকে গড়ে তোলেন ধ্বংস করতে সময় লাগে খুবই কম কিন্তু গড়তে ? গড়ন দীর্ঘস্থায়ী। সুতরাং ক্লান্ত অথচ ক্লান্তিহীন এই বিরোধভাস প্রচেষ্টাকে বুঝিয়েছেন যা নাবিকের ধৈর্যের সন্ধান দেয় যিনি অনন্ত পথ চলার ইঙ্গিতবাহী—

‘হৃদয়ে চলার গতি গান আলো রয়েছে, অকূলে 

মানুষের পটভূমি হয়তো বা শাশ্বত যাত্রীর”

এই যাত্রার হিসেবে লাভ লোকসানের খাতায় অস্তিমে থাকে রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শের পৃথিবীকে দেখা। সমুজ্জ্বলভাবে শিশিরের শরীর ছুঁয়ে মানুষের ভালোবাসার যে স্বাদ ও সাধ বেঁচে থাকায় সেখানে অনেক ব্যথা, অপ্রাপ্তি যা হবার ও হবার নয় সব হিসেব রাখে না, সম্ভব নয়। ইতিহাস তা ঢের প্রমাণ করেছে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাধ্য দিয়ে প্রগতির চক্র বিন্দু বিন্দু করে মধু সঞ্চয় করে নিজেকে ক্রম মুক্ত করে চলেছে কারণ আজ ইতিহাসের পৃথিবী অনুভব করেছে, অন্ধকার সত্য কিন্তু তা শেষ সত্য হয়, ক্রমিক অনিবার্য এবং অনন্তরূপে চিরসত্যের সিদ্ধান্ত রাত্রি যতই গাঢ় হবে ভোর ততই স্পষ্ট হয়ে আসবে দ্রুততার সঙ্গে। রাত্রি মানে সূচিত দিনের আগাম পূর্বাভাস কবি সব পরিত্যাগ করে এই cycling টাকে স্বীকার করেছেন। তাই ‘সুচেতনা’ কবিতার শেষ লাইনটিতে তিনি বলেছেন—

‘শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়’

লক্ষ্য সূর্য না থাকলে অন্ধকার অতিক্রম সম্ভব নয়। নাবিকের যাত্রায় দেখা যায়—‘হে নাবিক, হে নাবিক, কোথায় তোমার যাত্রা সূর্যকে লক্ষ্য করে শুধু। তেমনি এখন যেকটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলতে হবে প্রিয়মানতা নয়। সুচেতনা কবিতার সেই পরিচ্ছন্ন কাল জ্ঞান সমাজকে সম্যক ইতিহাস চেতনায় উপলব্ধির জন্য সূর্যোদয়ের প্রতীক ব্যবহার করেছেন।