‘ছাড়পত্র’ কার্যগ্রন্থের অন্তর্গত সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘বোধন’ কবিতাটির প্রেক্ষাপটে রয়েছে বাংলার ১৩৫০ বঙ্গাব্দের তথা ১৯৪৩-এর মহামন্বন্তর। ‘বোধন’ কবিতার নামকরণের সার্থকতা বিচার করতে গেলে। মন্বন্তরের এই প্রেক্ষিতটি স্মরণে রাখা প্রয়োজন।

১৯৪২-এর এপ্রিল মাসে বার্মা অধিকার করে নিল জাপান। বার্মা থেকে বাংলায় ধানের আমদানি এর ফলে ব্যাহত হল। চাহিদা অনুপাতে জোগান কমে যাওয়ায় বাংলায় কিছুটা খাদ্যসমস্যা তৈরি হল। এছাড়া বন্যা ও খরার কারণেও কিছুটা খাদ্যসংকট দেখা দিল। কিন্তু এই সামরিক ও প্রাকৃতিক কারণই ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের প্রধানতম কারণ ছিল না। আধুনিককালের ঐতিহাসিকেরা নিশ্চিতভাবেই দেখিয়েছেন, পঞ্চাশের মন্বন্তর ছিল প্রধানত মানুষেরই সৃষ্ট।

একদিকে মুনাফাসন্ধানী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বাংলার কৃষি অর্থনীতিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় থেকেই প্রায় পঙ্গু করে ফেলেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্থিক ঘাটতি পূরণের জন্য ঔপনিবেশিক শোষণ আরো তীব্র হল এবং তার প্রধান আঘাত নামল কৃষি অর্থনীতির ওপর। কৃষকেরা সর্বস্বান্ত হল। তাদের হাল-বলদ, ভিটে-জমি, মহাজন-জোতদারদের দখলে চলে গেল ঋণের দায়ে।

এছাড়া যুদ্ধে সৈনিকদের সরবরাহের জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত করতে শুরু করে স্বয়ং সরকার। ফলে সাধারণ মানুষের খাবারে টান পড়ল।

তৃতীয়ত যুদ্ধের অস্থিরতার সময় সরকারি প্রশাসনে একধরনের শৈথিল্য দেখা দিল। ফলে জোতদার-মহাজন ও অবৈধ কারবারিরা এসময় অতিসক্রিয় হয়ে উঠল। তারা গ্রাম থেকে সমস্ত ধানচাল শহরের গোপন গুদামে মজুত করে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করল। চালের দাম হয়ে উঠল আকাশছোঁয়া। গ্রামের কৃষক অন্নাভাবে মৃতপ্রায় হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে শেষ পর্যন্ত শহরের বাজারে স্টেশনে ফুটপাথে এসে ভিড় করল। আঁস্তাকুড়ে কুকুর ও ক্ষুধার্থ মানুষের কাড়াকাড়ি সে সময়ের এক বাস্তব চিত্র। কঙ্কালসার মানুষ অনাহারে, অপুষ্টিতে এবং রোগগ্রস্ত হয়ে লাখে লাখে মারা পড়ল শহরের পথে-ঘাটে। বিশ শতকের পঞ্চম দশকের কাব্যে কথাসাহিত্যে নাটকে চিত্রশিল্পে এই মহাদুর্ভিক্ষের ভয়ংকর চিত্র আঁকা হয়েছে।

সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘বোধন’ কবিতাতেও গ্রাম বাংলার কৃষিজীবী মানুষের এই দুর্গতির ছবি এবং তাদের দুঃসহ নিরন্ন জীবনের অসহায়তা বর্ণিত। ‘ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমে ওঠা অন্ধকার নির্জন বিষণ্ণতার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে কবিতার সূচনাংশেই। গ্রাম বাংলার শ্যামল মাটি, আদিগন্ত বিস্তৃত শস্যক্ষেত্র এবং আকাশে বাতাসে তখন শুধু ধূসর মৃত্যুর নীরব পদসঞ্চরণ—এই যে আকাশ, দিগন্ত, মাঠ, স্বপ্নে সবুজ মাটি নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি।”

কিন্তু এই মৃত্যুশীতলতা আর দুর্গতির বিবরণই ‘বোধন’ কবিতার শেষ কথা নয়। তৎকালীন শিল্প-সাহিত্যে দুর্ভিক্ষের নিদারুণ ছবি বিশ্বস্তভাবেই উপস্থাপিত। যেমন—বিভূতিভূষণের ‘অশনি সংকেত’, বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ফ্যান’, সমর সেনের ‘নষ্টনীড়’ কিংবা জয়নুল আবেদিন বা চিত্তপ্রসাদের ছবি। কিন্তু দুর্ভিক্ষের আগুনে দগ্ধ পীড়িত মানুষের ছবি সেখানে যত বিশ্বস্তভাবে আছে, সে অনুপাতে প্রতিরোধ প্রতিবাদ-উদ্বোধনের মন্ত্র নেই। বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটকে যদিও শেষপর্যন্ত পুনরুজ্জীবনের স্বপ্ন আছে, তবু সেখানে কল্পসৃষ্ট রোমান্স নাট্যকারকে যতটা আচ্ছন্ন করেছে, বস্তুবাদী সংগ্রামী পথ নির্ধারণ সেভাবে ক্রিয়া করেনি। এখানেই সুকান্তের ‘বোধন’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে অনন্য।

সুকান্তর ‘বোধন’ কবিতায় প্রথমাংশে এই ‘ভাঙাঘর, ফাঁকা ভিটে’, ‘মারী ও মড়ক মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যা, কিংবা ‘নীরবে মৃত্যু’-র ঘাঁটি গাড়ার কথা আছে। কিন্তু কবি এই অসহায় অবস্থার কাছে বা মৃত্যুর কাছে প্রতিরোধহীন আত্মসমর্পণকে স্বীকার করেন নি। বরং কালচৈতন্যের কাছে (‘মহামানব’) কবির প্রার্থনা—’হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।’

অর্থাৎ নিঃসহায় মৃত্যুবরণ আর দুর্গতির বদলে সুকান্ত তাঁর কবিতায় বারবার চেয়েছেন জনচৈতন্যের প্রতিরোধী শক্তি বা সংগ্রামী চেতনার উদ্বোধন। যে ধূর্ত-প্রবঞ্চক শ্রেণি লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে তাদের মৃত্যুর মূল্যে গোপন ভাণ্ডারে কোটি কোটি মুদ্রা গোনে, দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে অমানবিকভাবে মুনাফার সন্ধান করে, তাদের কোনোভাবেই ক্ষমা করতে পারেন না কবি। বরং যখন দুর্গত মানুষেরা তাদের দুর্গতির জন্য ভাগ্যকে দোষারোপ করে, তখন কবি তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চান, এই দুর্ভিক্ষের পিছনে ষড়যন্ত্রীদের মনুষ্যত্বহীন ভূমিকা। সেই দুচ্চক্রের বিরুদ্ধে ক্রোধ ও প্রতিশোধের সংঘবদ্ধ আগুনকে জ্বালিয়ে তুলতে চান কবি। বলতে চান— “স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের চিতা আমি তুলবই” বা “ফসল ফলানো মাটিতে রোপণ করব তোকে এবার।”

এই সংগ্রামী চেতনার উদ্বোধনী মন্ত্রই ‘বোধন’ কবিতার মূল বাণী। কবির এই উজ্জীবনী আহ্বানে যারা তথাপি দ্বিধাগ্রস্ত, যারা দুষ্টশক্তির প্রতিরোধে বা শাস্তিবিধানে সংশয়ী, তাদের বিরুদ্ধেও প্রতিক্রিয়াশীলতার অভিযোগ এনেছেন কবি–“তা যদি না হয়, বুঝব তুমি তো মানুষ নও। গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা নও।” আসলে সমগ্র কবিতায় ‘শুকনো পাতায় আগুন জ্বেলে, ‘আদিম হিংস্র মানবিকতার’ প্রবল শক্তিতে সংগ্রাম ও ‘প্রতিরোধের দামামা’ বাজিয়ে জনচৈতন্যের প্রবল প্রতিবাদকেই উদ্বোধিত করতে চেয়েছেন কবি। তাই ‘বোধন’ নামটি এই কবিতার সার্থকতম শিরোনাম।