যে বয়সে মানুষের জীবনে যৌবন পুরোপুরি আত্মপ্রকাশ করে না, সেই বয়সেই যক্ষ্মার মতো দূরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে সুকান্ত ভট্টাচার্যকে এই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিতে হয়েছিল চিরদিনের জন্য। মাত্র একুশ বছরে অতিসংক্ষিপ্ত আয়ুর সীমা নিয়েই তিনি জীবনে সার্থকের পথ খুঁজে নিতে পেরেছিলেন। এই সার্থকের সন্ধান তাঁর জীবনে এসেছিল অবিমিশ্র সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ মানদণ্ডের বিচারে। নিজের একান্ত দাবী নিয়ে সুকান্ত কোনোদিন সরব হননি। ব্যক্তিগত দাবী তার কোনোদিনই ছিল না। সমষ্টিকেন্দ্রিক এই দাবীকে যূথবদ্ধ একটি নাগরিক চেহারা দিতে চেয়েছিলেন তিনি। যূথবদ্ধ সমষ্টি চেতনার সোনালী আলোয় সমস্ত বিশ্বসংসার একদিন আলোকিত হয়ে উঠবে—এটাই ছিল সুকান্তের একমাত্র চাওয়া-পাওয়ার জগৎ। নিছক স্বপ্ন তাড়িতের মতোই নতুন এক পৃথিবীর আগমন প্রত্যাশা চেতনার কোষে কোষে অনুভব করেছিলেন তিনি। নতুন পৃথিবী গড়ার এই স্বপ্নে একটা সুস্থ সুন্দর সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার কথাও বলেছেন সুকান্ত তাঁর অজস্র কাব্যগ্রন্থের কবিতায়। এমন একটি সমাজ গড়ার স্বপ্ন সুকান্ত দেখেছিলেন, যেখানে আর্থিক ক্ষমতাই সামাজিক জীবনের মুখ্য নিয়ন্ত্রক শক্তি হবে না। সাম্প্রদায়িক বিভেদের সাথে সাথে ধনতান্ত্রিক বৈষম্য দূর করার একটা ইঙ্গিতও তাঁর কবিতায় তাই পাওয়া যায়। পৃথিবী ও সমাজের ধনতান্ত্রিক চিহ্নগুলি অবলেশের সঙ্গে সঙ্গে নিপীড়িত মানুষের পরিত্রাতারূপে আবির্ভূত হবে সাম্যচিন্তার নীতি বা সাম্যবাদ—এমন বিশ্বাসই আমৃত্যু বহন করেছেন সুকান্ত।

নতুন পৃথিবী ও সাম্যবাদী সমাজ গড়ার যে স্বপ্ন সুকান্ত তার অপরিণত বয়স থেকেই দেখেছেন, সেই স্বপ্নটি প্রথম থেকেই একটি রাজনৈতিক স্তবকে পলিটিক্যাল ইমেজ আশ্রিত। এই ধারণার উচ্চারণভঙ্গিতেও তিনি মুক্ত ও স্বাধীন। কবিতা লেখার প্রাথমিক পর্যায়েই তিনি কমিউনিজমের প্রবল চাপে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আসলে ১৯৪০ থেকে ১৯৪৭ এই আটবছরের কবিজীবনে সুকান্ত এমন কোনো জাতীয় বা বিশ্বরাজনীতি গত বিশাল অভিঘাতের দ্বারা আলোড়িত হননি, যার দ্বারা কমিউনিজমের প্রতি নিবিষ্ট ইমেজটি তার নষ্ট হয়ে যাবে। ব্যক্তিজীবন ও সৃষ্টিজীবন—উভয়ক্ষেত্রেই এজাতীয় মতবাদ তাঁর কবিসত্তাকে একটি নির্দিষ্ট বন্ধনে বেঁধে রেখেছিল।

সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার মূল বিষয় হল মানুষ ও তার শ্রেণিজর্জরিত সমাজ। এই সমাজের কথাই তিনি নানারকম প্রকরণের অনুষঙ্গে চিত্রকল্পের প্রেক্ষিতে বলে গেছেন। তাঁর এই প্রকাশের ধরণটি কখনও হয়তো খুবই প্রত্যক্ষ, আবার কখনও ভীষণভাবেই পরোক্ষ। যেসব শ্রেণিহীন সর্বহারা মানুষদের তিনি কবিতায় চিত্রায়িত করতে চেয়েছেন, তারা কেউই প্রচলিত সমাজের প্রতিনিধি নন, আবার সমাজটিও সার্বিকভাবে কোনো একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিবিভাজনের নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য প্রচণ্ড প্রতিশোধস্পৃহায় পর্যবসিত। অবশ্য এই প্রতিশোধ সমাজের তথাকথিত অভিজাত শ্রেণির বিরুদ্ধেই। যারা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষদের শোষণ করেই নিজেদের আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করে চলেছে। প্রসঙ্গ ও প্রকরণের ঠিক এই পথটিই ‘ছাড়পত্র’ (১৯৪৭) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘বোধন’ কবিতাটির কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়।

‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থের ৩০ সংখ্যক কবিতা ‘বোধন’ কবিতাটির শুরুতেই কবি এক মহামানবের আগমন প্রত্যাশায় দিন গুনেছেন। তাঁর আগমনকে সম্ভব করে তুলতে চেয়েছেন কবি মারী ও মন্বন্তর ক্লিষ্ট গ্রামনগরের মৃত্যুময় প্রান্তরে। দিগন্তজোড়া আকাশের প্রান্তে, স্বপ্নে স্বপ্নে সবুজ হয়ে যাওয়া মাটিতে, মৃত্যু কেন এবং কীভাবে বাসা বেঁধেছে এই প্রশ্নটির উত্তর পেতে হলে, আমাদের চোখ ফেরাতে হবে কবিতাটির শরীর জুড়ে পড়ে থাকা সমাজ সত্য ও কালগত সত্যের দিকে। ‘বোধন’ কবিতাটি তাই সেই মহামানবের আকাঙ্ক্ষিত আবির্ভাব লগ্নকেই সূচিত করে। একই সঙ্গে কবিতার সূচনাতেই মহামানবের বোধন ঘটবার কারণটিও কবি নির্দেশিত করে দেন,

“হে মহামানব, একবার এসো ফিরে

শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে

এখানে মৃত্যু হানা দেয় বারবার;

লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার,

এই যে আকাশ দিগন্ত মাঠ স্বপ্নে সবুজ মাটি

নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাটি।”

পাঠকের কৌতুহল হয়তো এখনও সরাসরি মেটে না। কারণ খুব সহজ ভাবেই মনে আসে এ কোন্ সময়, যখন দিগন্তজোড়া আকাশ, স্বপ্নে স্বপ্নে সবুজ মাঠ মৃত্যুর নীরব উপত্যকা হয়ে যায়? কবিতাটির প্রেক্ষিত জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে আরও একটি সময় চেতনা। কবি সরাসরি উল্লেখ করেছেন, তেরোশো সালের কথা।

“তেরোশো সালের মধ্যবর্তী মালিক, মজুতদার

মানুষ ছিল কি ? জবাব মেলে না তার।”

আসলে ১৩৫০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে বাঙালির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত জুড়ে এসেছিল প্রবল বিপর্যয়—পঞ্চাশের মহামন্বন্তর। মৃত্যুর ছায়া তখন গ্রাম ও নগরের প্রতিটি পথে পথে। কবিতার প্রতিটি ছত্রেই তাই লুকিয়ে আছে ঘরভাঙা মানুষের কান্না। শুধুমাত্র ‘বোধন’ কবিতাতেই নয়, ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই এ জাতীয় পংক্তি ছায়া বিস্তার করেছে।

“আমার সোনার দেশে অবশেষে মন্বন্তর নামে,

জমে ভিড় ভ্ৰষ্টনীড় নগরে ও গ্রামে,

দুর্ভিক্ষের জীবন্ত মিছিল,

প্রত্যেক নিরন্ন প্রাণে বয়ে আনে অনিবার্য মিল।”

আহার্যের অন্বেষণে প্রতিমনে আদিম আগ্রহ

রাস্তায় রাস্তায় আনে প্রতিদিন নগ্ন সমারোহ 

বুভুক্ষা বেঁধেছে বাসা পথের দুপাশে,

প্রত্যহ বিষাক্ত বায়ু ইতস্তত ব্যর্থ দীর্ঘশ্বাসে।”

বাস্তবের মাটিতে ফিরে, চারপাশের প্রাণহীন, উষ্মতাহীন দৈনন্দিন যাপন দেখে দেখে মানুষের লোকচক্ষুর অন্তরালটি অন্ধকারে ভরে উঠেছে। নীল আকাশ, দিগন্ত বিস্তারী সবুজ মাঠের স্বপ্নভরা জগৎও তার ব্যতিক্রম নয়। চল্লিশের দশকে ঘটে যাওয়া একের পর এক রাজনৈতিক সামাজিক অস্থিরতা বদলে দিয়েছিল মানুষের জীবনের ভরা কেন্দ্র। ভাঙাঘর, ফাঁকা ভিটে-মাটিতে তাই নির্জনতার কালো গ্রহর প্রতিমুহূর্তেই ঘনীভূত হয়ে চলেছে। এইসব চুপি চুপি অসহনীয় কান্নাকে বুকের ভেতরে প্রতিনিয়ত সহনীয় করে তোলার সাধনায় এরা কি জীবন পণ করে বসে আছে ? নীড়হারা মানুষের নিস্তরঙ্গ নির্লিপ্ততাকে আঘাতে জাগরিত করে তুলতে চান সুকান্ত। এইসব অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করবার প্রতিরোধহীন আশ্চর্য নীরবতাকে ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলেন তিনি।

“……তবু আজও বিস্ময় আমার

ধৃর্ত, প্রবঞ্চক যারা কেড়েছে মুখের শেষ গ্রাস

তাদের করেছ ক্ষমা, ডেকেছে নিজের সর্বনাশ।

তোমার ক্ষেতের শস্য 

চুরি করে যারা গুপ্ত কক্ষেতে জমায়

তাদেরি দু-পায়ে প্রাণ ঢেলে দিলে দুঃসহ ক্ষমায়;”

সমাজব্যবস্থার এই অসম বণ্টন নীতিকে মেনে নিতে পারেননি কবি সুকান্ত। তার বারবারই মনে হয়েছে মানুষ এত দুর্বল অসহায় কেন ? প্রতিবাদহীন অসহায়তার অন্যায় শোষণটিই আরও বেশি অন্যায়ের পথে জারিত করে দিয়েছে মানুষকে। লোভ ও পাপের দূর্গ, গম্বুজ-প্রাসাদ-মিনারের যাবতীয় উচ্চতাই আজ অসম্মান আর অস্বীকৃতিতে ভরিয়ে দিয়েছে এইসব মানুষগুলিকে। প্রতিবাদ প্রতিরোধের অভাবই মানুষকে এতখানি শক্তিশালী করে তুলেছে, আকাশস্পর্শী অন্যায়ের প্রবল চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে।

“তোমার অন্যায়ে জেনো এ অন্যায় হয়েছে প্রবল।

তুমি তো প্রহর গোনো ;

তারা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি 

তাদের ভাণ্ডার পূর্ণ ; শূন্য মাঠে কঙ্কাল করোটি

তোমাকে বিদ্রূপ করে,”

কিন্তু গ্রামের পর গ্রাম মৃত্যুর বিভীষিকায় হারিয়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে কবি মানুষকে জীবনের প্রাপ্যটি বুঝিয়ে দিতে চান। যুদ্ধ শেষের পৃথিবীর সেই ভয়ঙ্কর বাস্তবতা কবিকে আর সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোনো দূরত্বের আবরণ রক্ষা করতে দেয়নি। অনাবৃত সত্যের প্রত্যক্ষ সংসর্গে আপ্লুত হয়ে সুকান্ত জানিয়েছেন,

“সুদে ও আসলে আজকে তাই 

যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য চাই।”

লোভের অস্ত্রে পৃথিবী আজ বড়ই কৃপণ হয়ে পড়েছে, কেড়ে নিচ্ছে অন্ন-বস্ত্ৰ-বেঁচে থাকার ন্যূনতম শর্তটিকে। মানুষকে বাঁচানোর প্রয়োজনেই আজ যেন ‘রক্তের ভাগিরথী’ আনতে হবে। স্বার্থান্বেষী মানুষ অশুভ আকাঙ্ক্ষায় চারপাশে মৃত্যুর ফাঁদ পেতে রেখেছে। সেই ফাঁদ ভেঙে ফেলে মানুষকে সচেতনভাবে উঠে দাঁড়াতে হবে। সংঘবদ্ধ গ্রামের কৃষক এভাবেই ছেচল্লিশে জমির অধিকার, ফসলের অধিকারকে বুঝে নিতে চেয়েছিল।

আসলে ১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষের প্রবল অভিঘাতের দায় অনেক সমালোচক গবেষকেরা দিয়েছেন বিদেশি শাসকপুষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতাকে, কিন্তু কবি সুকান্ত মনে করেন বিদেশি শক্তির মদতপুষ্ট দেশীয় জোতদার মহাজনদের নির্দেশ নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়াটাই একটা বড়ো অপরাধ। চেতনার জাগরণের মধ্য দিয়ে কবি তাই, এই সমাজব্যবস্থার নির্মম স্বরূপকে উপলব্ধি করেছেন এবং অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদের কূটকৌশলে বিদেশি রাজশক্তি এদেশের প্রান্তে প্রান্তরে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার জন্ম দিচ্ছে। এইসব মনোগত বিভেদ-বৈষম্য আসলে মানবের ঐক্যকে বিনষ্ট করবার একটা চক্রান্ত। এই দুর্বলতাকে পাশ কাটিয়ে যেতে বলেছেন কবি।

“স্বদেশপ্রেমের ব্যাঙ্গমা পাখি 

মারণমন্ত্র বলে শোনো তাকি ? 

এখনো কি তুমি আমি স্বতন্ত্র ? 

করো আবৃত্তি, হাঁকো সে মন্ত্র 

শোনরে মালিক, শোনরে মজুতদার 

তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়

হিসাব কি নিবি তার ?”

কবিতাটির শেষাংশে সমবেত জনতার পুঞ্জিভূত ক্রোধ যেন প্রতিস্পন্দিত হয়ে উঠেছে। সমসাময়িক আসন্ন সর্বনাশকে বৈপ্লবিক স্পন্দন দ্বারা অনুভব করেছিলেন বলেই প্রবল প্রতিহিংসায় স্বজন হারানো শ্মশানে দুর্বৃত্ত অপরাধীদের চিতা সাজানোর সংকল্প করেছেন কবি। বিমূঢ় আস্ফালন নয়, যুদ্ধারম্ভের প্রস্তুতির আহ্বান জানিয়েছেন কবি। আপাত অর্থে এই কাঙ্ক্ষিত যুদ্ধ হয়তো ধ্বংসের অনিবার্য ইঙ্গিত বহন করে কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতির এমন সঙ্কট দীর্ণ হাহাকারের মধ্যে বিশ্বব্যাপী শুভবোধের প্রতিষ্ঠার জন্য মৃত্যুময় এই বিপর্যয় অনিবার্য।

সমাজের বঞ্চিত উৎপীড়িত, এই মানুষগুলির সঙ্গে সত্যিকারের আত্মীয়তা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও ছিল। সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণিবিন্যাসের অবস্থানগত কারণেই তিনি এই মানুষগুলির সাথে কখনও এক হতে পারেননি। তাঁর জীবনের শেষপর্যায়ের কাব্যের ‘ঐক্যতান’ কবিতাটি এ প্রসঙ্গে স্মরণে আসে। আশী বছরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ সেই কবির জন্য কান পেতেছিলেন, অনাগত যুগের সমাজ চেতনার বলিষ্ঠ স্বপ্ন যাঁর কর্মে ও কথায় সত্য হয়ে উঠবে। সুকান্ত ভট্টাচার্য শ্রমজীবি শ্রেণির সেই সাধারণ মানুষের কবি। আর তাঁর কবিতা ‘বোধন’ ক্রমক্ষয়িষ্ণু পৃথিবীর বুকে আলোকিত সময়ের অভিজ্ঞানমন্ত্র।