সার্বভৌমিকতার সর্বাত্মক ধারণার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া: আইনগত বা একত্ববাদী ধারণা অনুসারে সার্বভৌমিকতা হল রাষ্ট্রের অসীম, অবাধ, চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতা। বদ্যা, হস, বেন্থাম ও অস্টিন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে রাষ্ট্রের এই ক্ষমতা আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সর্বক্ষেত্রে অপ্রতিহত। সার্বভৌমত্বের এই সাবেকী ধারণা অনুসারে রাষ্ট্রের ভিতরে আইনগত বিচারে সার্বভৌমত্বের উপর আর কোন কর্তৃত্ব থাকতে পারে না। কারণ উচ্চতর কোন ক্ষমতার দ্বারা সার্বভৌমত্বকে সীমাবদ্ধ করার অর্থ হল তার মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে বিনষ্ট করা। সার্বভৌমিকতার এই সর্বাত্মক ধারণার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে সীমাবদ্ধ সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
মূল প্রতিপাদ্য বিষয়: সীমাবদ্ধ সার্বভৌমিকতায় বিশ্বাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে রাষ্ট্রের এই ক্ষমতা আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণাধীন। ব্রাইস-এর মতে সর্বক্ষেত্রে বাধাবন্ধনহীন অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন সার্বভৌমকে বাস্তবে পাওয়া যায় না। ব্রাইসের মতানুসারে সম্পূর্ণভাবে অবাধ ক্ষমতার অধিকারী কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব বাস্তবে অসম্ভব। তাঁর মতানুসারে সরকার জনসাধারণের ভয় ও শ্রদ্ধা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অনুমোদনের দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। ব্লন্টসলী বলেছেন যে, বাহ্যিক দিক থেকে অন্যান্য রাষ্ট্রের অধিকারের দ্বারা এবং আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নিজস্ব প্রকৃতি ও ব্যক্তিসমূহের অধিকারের দ্বারা রাষ্ট্র সীমাবদ্ধ। তাঁর কথায়: “It is limited externally by the right of other states and internally by its own nature and the rights of its individual members.” বুন্টসলির মতানুসারে সীমাহীন স্বাধীনতা বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। রাষ্ট্রকেও সর্বশক্তিমান বলা যায় না। গেটেলও প্রায় অনুরূপ কথাই বলেছেন। গেটেল (R. G. Gettell) বলেছেন: The internationalist would shakle the Leviathan with chains while the Pluralist would perform the necessary operations in the interior.” আধুনিককালের বহুত্ববাদীরাও সার্বভৌমিকতার সীমাবদ্ধতার তত্ত্বে বিশ্বাসী। ল্যাস্কি-র মতানুসারে রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে একটি মৌলিক বিষয় হল কর্তৃত্বের সীমাবদ্ধতা। তিনি বলেছেন: “The conception that authority not merely is but ought to be limited is fundamental to political philosophy” এ বিষয়ে লেসলি স্টীফেন-এর মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “The state is limited both from within and without.” এই তত্ত্বে বিশ্বাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ।
(১) নাগরিক অধিকার ও ধর্মীয় অনুশাসনের দ্বারা সীমাবদ্ধ: আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জনসাধারণের অধিকারের দ্বারা সার্বভৌমিকতা সীমাবদ্ধ। গার্ণার-এর মতে, “Many writers recognises the existence of certain moral limitations on the power of the sovereign, arising from the natural and inherent rights of man.” নাগরিকদের অধিকারের সীমাকে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ লঙ্ঘন করতে পারে না। কিন্তু এই যুক্তি সর্বাংশে সত্য নয়। সার্বভৌম রাষ্ট্রই অধিকার সৃষ্টি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। নাগরিক অধিকারের সীমা রাষ্ট্রই আইনের দ্বারা স্থির করে দেয়। আবার আইনগত দিক থেকে বিচার করলে রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকারের দাবীকে পরিবর্তন বা ব্যাহত করতে পারে। অনেকের মতে প্রজাসাধারণের ধর্মীয় ও নৈতিক অনুশাসনকে মান্য করে রাষ্ট্রকে চলতে হয়। সাধারণত রাষ্ট্র ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিক মূল্যবোধকে উপেক্ষা করতে পারে না। অনেকের মতে শ্বাশ্বত নৈতিক বোধ সার্বভৌম ক্ষমতার ঊর্ধ্বে বিরাজমান। অর্থাৎ নৈতিক বিশ্বাস বা ধর্মীয় অনুশাসনের দ্বারা সার্বভৌম ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। তাই প্রবল পরাক্রান্ত শাসক ফ্রান্সের চতুর্দশ লুইও প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মকে জনগণের উপর জোর করে চাপিয়ে দেননি।
আইনগত বিচারে এই নিয়ন্ত্রণ যথার্থ নয় । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এবং আইনগত বিচারে এগুলিও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের উপর কোন রকম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। সার্বভৌমিকতার ধারণা মূলত আইনগত। উল্লিখিত নিয়ন্ত্রণগুলি আইনগত দিক থেকে সার্বভৌম ক্ষমতার উপর নিয়ন্ত্রণ হিসাবে গণ্য হয় না। গার্ণার মন্তব্য করেছেন: “An examination limitations, however, will of the show that legally they are not restrictions on sovereignty at all.”
(২) শাসনতান্ত্রিক আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধ: বলা হয় যে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা শাসনতন্ত্রের দ্বারা সীমাবদ্ধ। শাসনতান্ত্রিক আইন রাষ্ট্রের কাঠামো ও ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। রাষ্ট্রের কাঠামো ও সরকারের বিভাগসমূহের কার্যাবলী শাসনতন্ত্রের দ্বারা স্থিরীকৃত হয়। বিশেষতঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় শাসনতন্ত্র দেশের সর্ব্বোচ্চ আইন হিসাবে গণ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্রে আইন-বিভাগের কোন আইন বা শাসন-বিভাগের কোন সিদ্ধান্ত শাসনতন্ত্র-বিরোধী হলে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত সেই আইন ও সিদ্ধান্তকে বাতিল করে দেয়। অর্থাৎ শাসনতন্ত্র ও শাসনতান্ত্রিক আইন সার্বভৌম ক্ষমতার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে।
শাসনতান্ত্রিক আইনও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। কিন্তু এই যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতাই হল শাসনতন্ত্রের সৃষ্টি, প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের ভিত্তি। প্রয়োজনবোধে রাষ্ট্র শাসনতন্ত্রকে সংশোধন বা পরিবর্তন করতে পারে। সুতরাং শাসনতান্ত্রিক আইনকে সার্বভৌমিকতার সীমারেখা হিসাবে গণ্য করা যায় না। তা ছাড়া শাসনতান্ত্রিক আইন সরকারী ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই সরকারই শাসনতন্ত্রের অধীন, রাষ্ট্র নয়। সরকারী ক্ষমতা ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা এক নয়, আলাদা। গেটেল-এর মতানুসারে সাধারণ আইনের মত শাসনতান্ত্রিক আইনও হল রাষ্ট্রের সার্বভৌম ইচ্ছার প্রকাশ বিশেষ। সুতরাং আইনগত বিচারে শাসনতান্ত্রিক আইন সার্বভৌমিকতার উপর নিয়ন্ত্রণ হিসাবে গণ্য হতে পারে না। তবে রাষ্ট্র নিজে শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে নিজের উপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। ডাইসি এগুলিকে ‘স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণ’ বলার পক্ষপাতী।
(৩) আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধ: বাহ্যিক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন, চুক্তি ও বিশ্বজনমতের দ্বারাও রাষ্ট্রের কার্যকলাপ বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়। রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খুশীমত ক্ষমতা প্রয়োগ করলে রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক স্বার্থ ও অধিকার এবং ন্যায়-নীতি বিপর্যস্ত হবে; চরম অরাজকতার সৃষ্টি হবে। সেজন্য বাস্তবে কোন রাষ্ট্রই সার্বভৌমিকতার দত্তে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে না।
আন্তর্জাতিক আইন বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু এই যুক্তি পুরোপুরি স্বীকার করা হয় না। আইনের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা বহিঃশক্তির সর্বপ্রকার নিয়ন্ত্রণমুক্ত। আন্তর্জাতিক আইন রাষ্ট্রীয় আইনের ন্যায় বাধ্যতামূলকভাবে বলবৎযোগ্য নয়। কোন পীড়নমূলক শক্তি এর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে না বলে কোন রাষ্ট্র প্রয়োজনবোধে সহজেই একে উপেক্ষা করতে পারে। আন্তর্জাতিক আইন এমন কোন সর্বশক্তিমান সংস্থা কর্তৃক প্রণীত হয়নি, যে সংস্থা সকল রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তা ছাড়া সর্বজনস্বীকৃত এমন কোন আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ নেই যা আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করার কারণে অভিযুক্ত রাষ্ট্রকে শাস্তি দিতে পারে। আন্তর্জাতিক আইন মান্য করা বা না-করা রাষ্ট্রের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। বস্তুত আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারা রাষ্ট্র স্বেচ্ছায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর স্বেচ্ছায় আরোপিত নিয়ন্ত্রণকে প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রণ হিসাবে গণ্য করা যায় না।
তবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কোন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে না বা করতে পারে না। আন্তর্জাতিক আইনের পিছনে বিশ্ববিবেক ও বিশ্বজনমতের সক্রিয় সমর্থনকে এখন আর অবজ্ঞা করা যায় না।
(৪) বহুত্ববাদীদের যুক্তি: বহুত্ববাদীদের মতানুসারে রাষ্ট্রাভ্যন্তরে বিভিন্ন সংঘ ও প্রতিষ্ঠানের অধিকার ও স্বাধীনতার দ্বারা রাষ্ট্রের অবাধ ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। এই প্রতিষ্ঠানগুলি স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীন। এদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতাকে স্বীকার করলে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব আর অবাধ ও অপ্রতিহত থাকতে পারে না।
এই যুক্তিও যথার্থ নয়। কিন্তু এই যুক্তিও সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ অন্যান্য সংঘ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে রাষ্ট্রের স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি হলেই রাষ্ট্রই তার মীমাংসা করে। আবার এদের কার্যকলাপের মধ্যে সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব রাষ্ট্রই পালন করে।
(৫) অন্যান্য কারণ: সার্বভৌমিকতার উপর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বিভিন্ন চিন্তাবিদদের বিভিন্ন বক্তব্য পরিলক্ষিত হয়। কারও মতে অতিপ্রাকৃত ও অবিনশ্বর কোন কর্তৃত্ব সার্বভৌমিকতাকে সীমিত করে। আবার ঐশ্বরিক বিধান (Divine Law)-কে অনেকে সার্বভৌমিকতার উপর আরোপিত সীমা হিসাবে অভিহিত করার পক্ষপাতী। আবার কেউ এ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক আইন (Law of Nature), ন্যায়-নীতিবোধ, প্রচলিত প্রথা ও ঐতিহ্য, ধর্মবিশ্বাস, জনমত প্রভৃতির কথা বলে থাকেন।
কিন্তু আইনের দিক থেকে বিচার করলে উপরিউক্ত কারণগুলি সার্বভৌমিকতার উপর কোন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। আবার প্রাকৃতিক আইন, স্বাভাবিক অধিকার, ঐশ্বরিক বিধান—এ সবই হল কল্পনার রাজ্যের বিষয়, বাস্তবে অস্তিত্বহীন।
উপসংহার: পরিশেষে একথা অনস্বীকার্য যে আইনগত বিচারে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা অবাধ, অসীম এবং চরম ও চূড়ান্ত। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে কোন রাষ্ট্রই উপরি উল্লিখিত নিয়ন্ত্রণসমূহ উপেক্ষা করে না। রাষ্ট্র নিজের সুস্থ অস্তিত্ব, সুনাম, মর্যাদা প্রভৃতির স্বার্থে দায়িত্বহীন ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ থেকে বিরত থাকে। আইনগত বিচারে না হলেও, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা অসীম ও অবাধ নয়। কার্যক্ষেত্রে বহুবিধ সীমাবদ্ধতার মধ্যে রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব পালন করতে হয়। যেমন জনমতকে দীর্ঘকাল উপেক্ষা করে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগ করা যায় না। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মৌলিক নীতি হল জনমতের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধন বা জনমতের প্রতি দায়িত্বশীলতা। অনেক সময় রাষ্ট্রকে দেশবাসীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার অনুকূলে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হয় বা প্রচলিত আইনকে প্রয়োজনমত পরিবর্তন করতে হয়। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ সংরক্ষণ প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতেও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার সাবেকী তত্ত্বকে সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করা যায় না। ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন: “No sovereign has anywhere possessed unlimited power, and the attempt to exert it has always resulted in the establishment of safeguards.”
Leave a comment