অথবা, সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের বর্ণনা দাও।
ভূমিকাঃ পৃথিবীর প্রাচীন সকল সভ্যতা বৃহত্তম নদীর তীরে গড়ে ওঠেছে। আনুমানিক ৩,০০০ খ্রি: পূবাব্দে সিন্ধু নদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে ভারত উপমহাদেশের সিন্ধু সভ্যতা। প্রত্নতত্ত্ববিদ জন মার্শাল এ সভ্যতাকে পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা এবং লিওনার্ড উলি একে “যেমনি বিষ্ময়কর তেমনি অপ্রত্যাশিত” বলে অভিহিত করেছেন। এর পেছনে কারণও রয়েছে। ১৯২১-১৯২৪ সালে এ সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত ঐতিহাসিকরা ধারণা করতেন যে বৈদিক অর্থাৎ আর্যদের সময় থেকে ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস শুরু। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতা আবিস্কারের ফলে প্রমাণিত হয় এ সভ্যতা শুধু ভারত উপমহাদেশের প্রাচীন নয়, বরং মিশর, সুমেরীয়, আক্কাদীয়, ব্যাবিলনায় ও আসলাম সভ্যতার সমসাময়িক। এর বিশালতা, উন্নত নগর পরিকল্পনা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা, সমসাময়িক ভন্নত সভ্যতাম সঙ্গে যােগাযােগ, উন্নত শিল্পকলা সব মিলিয়ে এ সভ্যতাটি মানব ইতিহাসে বহু অবদান রেখে গেছে।
আবিষ্কারঃ শুরুতে এ সভ্যতা সিন্ধু নদ অঞ্চলে গড়ে ওঠেছিল বলে সভ্যতাটির নাম রাখা হয় ‘সিন্ধু সভ্যতা’। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারাের মধ্যে প্রথম হরপ্পায় খননকার্য হয়, তাই অনেকে একে ‘হরপ্পা সভ্যতা’ বলেন। যদিও এ সভ্যতা শুধু সিন্ধু নদ কিংবা হরপ্পায় সীমাবদ্ধ ছিল না। বিগত ১০/১২ দশক ধরে আরাে বহু সংখ্যক প্রত্নস্থান আবিষ্কার হওয়ায় বর্তমান ভারত ও পাকিস্তানের বিশাল এলাকা জুড়ে এ সভ্যতার বিস্তৃতির প্রমাণ পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা মনে করেন। প্রায় ২৫০টি সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে।
১৯৭৫ সালে ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ কানিংহাম হরপ্পার অপরিচিত লিপি লেখা একটি সীলের সন্ধান পান। অবশ্য এর পর দীর্ঘ বিরতির পর ১৯২১-২৪ সালে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তা রায় বাহাদুর দয়ারাম সাহানী, রাখাল দাস বন্দোপাধ্যায়, স্যার জন মার্শালের নেতৃত্বে প্রত্নতাত্ত্বিকদল সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেন। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলার মহেঞ্জোদারােতে রাখাল দাস বন্দোপাধ্যায় বৌদ্ধ স্তুপের ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাম্র-ব্রোঞ্জ যুগের নিদর্শন পান। ১৯২২-২৩ সালে অনুসন্ধান করতে গিয়ে মাটির নিচে এক বৃহৎ নগরী, ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, নালা-নর্দমা, নানান মূর্তি, দ্রব্য সীলমােহরসহ নিদর্শন পাওয়া যায়। অন্যদিকে দয়ারাম সােহানী ভারতের পাঞ্জাবের রাভি নদীর তীরে মন্টগােমারি জেলার হরপ্পা নামক স্থানে প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কার করেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মহাপরিচালক জন মার্শালের নেতৃত্বে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ আরাে বহু নিদর্শন আবিষ্কার করে। পরবর্তী সময়ে ১৯২১-৩৪ সালে সিন্ধু ও বেলুচিস্তানে ই.ম্যাকে, কালিনাথ দীক্ষিত, ড.এম হুইলার ননী গােপাল মজুমদার, এম.এস. ভাটের নেতৃত্বে বেশকিছু খনন কাজ পরিচালিত হয়।
বি.বি. লাল এবং বি.কে. থাপারের নেতৃত্বে ১৯৬১-৬৯ পর্যন্ত খনন কাজের ফলে রাজস্থানের কালিবঙ্গান আবিষ্কৃত হয়। এরপরও আবিষ্কার অব্যাহত রয়েছে। এসব আবিষ্কারের ফলে প্রাচীনকালে পাঞ্জাব থেকে বেলুচিস্তান পর্যন্ত কয়েকশ মাইলব্যাপী স্থানে যে একটি উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল তা পরিষ্কার জানা যায়। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারাে শহরের সভ্যতা যে এক তা বিভিন নিদর্শনাদি থেকে প্রমাণ হয়। অন্যত্র এ সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার হওয়ার ফলে এর বিস্তার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, পৃথিবীতে যেসকল সভ্যতা রয়েছে তার মধ্যে সিন্ধু সভ্যতা অন্যতম। বলা হয়ে থাকে প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক দৃশ্যে ভরপুর হরপ্পা ও মহেনজোদারাে ছিল সিন্ধু সভ্যতার প্রাণ। এই শহর দু’টির নগর পরিকল্পনা ছিল বিস্ময়কর। অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক এই নগর পরিকল্পনাকে আধুনিক নগর পরিকল্পনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাই বলা হয়ে থাকে, সিন্ধু সভ্যতায় যে নগর ছিল তা যেকোনাে সভ্যতার নগরব্যবস্থা থেকে উন্নত।
Leave a comment