তুলনামূলক পদ্ধতি : যে সমালোচনা পদ্ধতিতে দুই ভিন্ন লেখকের একই বিষয়বস্তু অবলম্বনে লেখার, কিংবা রচনা পদ্ধতির তুলনামূলক আলোচনা করা হয়ে থাকে তাকে তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতি বলা হয়। এই পদ্ধতিতে মোটামুটি দুটি লেখার সময়কাল, ধর্ম, প্রকৃতি সুর ও উচ্চারণভঙ্গি একই ধরনের হলে এ বিচার কিছুটা সম্ভব, নইলে সে আলোচনা সাহিত্য বিচারের নামে স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর হয়ে ওঠে। তাই রবীন্দ্রনাথ তুলনামূলক পদ্ধতির সম্পর্কে বলেছিলেন এই বিশ্বসাহিত্য বিশ্বমানবকেই অন্বেষণ করে। (বিশ্ব সাহিত্য)। এই তুলনামূলক সমালোচনা এদেশের সাহিত্যের সঙ্গে অন্য দেশের সাহিত্য প্রসঙ্গ এসে পড়ে। ধারণা ভিত্তিক, ঐতিহাসিক ভিত্তিক, সামাজিক ভিত্তিক, সাহিত্য শাখা ভিত্তিক, রূপ-ভিত্তিক—এর যে-কোনো পদ্ধতিতেই তুলনামূলক সমালোচনা সম্ভব। তবে এটি শুধু কাব্যের সঙ্গে কাব্যের নয় কাব্যের সঙ্গে চিত্রকলার, কাব্যের সঙ্গে সংগীতের তুলনা হতে পারে।
বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে এর প্রথম সফল প্রয়োগ ঘটেছিল। তাঁর উত্তরচরিত প্রবন্ধে পাশ্চাত্য সাহিত্যবিচারের পন্থা অনুসরণ করেছিলেন। তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতির ধারায় জয়দেবের সঙ্গে বিদ্যাপতির, কালিদাসের কুমারসম্ভবের সঙ্গে কবি মিলটনের প্যারাডইস লস্ট-এর কালিদাসের নায়িকা শকুন্তলার সঙ্গে শেক্সপিয়রের দুই নায়িকা মিরান্দা ও দেসদিমোনার সাদৃশ্য নিয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন তিনি।
‘বিবিধ প্রবেধ’র প্রবন্ধগুলির মধ্যে ‘শকুন্তলা, মিরান্দা, এবং দেসদিমোনা’, প্রবন্ধে কালিদাস ও শেক্সপিয়র ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। শকুন্তলাই তার মূল লক্ষ্য। দুটি খন্ড আছে এই প্রবন্ধে, শকুন্তলা ও মিরান্দা, শকুন্তলা ও দেসদিমোনা। সুতরাং শেকসপিয়রের একটি কমেডি, একটি ট্র্যাজেডি এবং শকুন্তলা বঙ্কিমের আলোচ্য ছিল। বঙ্কিমের হয়তো ধারণা ছিল শকুন্তলার জীবনে স্বামী পরিত্যক্ত অংশে তার ট্র্যাজেডি ও স্বামী মিলনে কমেডি। অথবা জীবন বলতে বুঝেছেন তিনি যে-কোনো একটি বৈশিষ্ট্যকে নিয়ে গড়া জীবন পরিধি। তার পূর্ণ আলোচনা করেননি। দুই বিপরীত নায়িকাকে নিয়ে শকুন্তলার পূর্ণতা আনতে চেয়েছেন। এখানেই তাঁর আলোচনার সার্থকতা।
অন্যান্য প্রবন্ধেও আলোচনা প্রসঙ্গে শেকসপিয়র ও কালিদাসের সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে কেবল তাদের প্রসঙ্গ উত্থাপনে।
ভবভূতির ‘উত্তর রামচরিতের’ সমালোচনা ‘উত্তরচরিত’ প্রবন্ধে। প্রথম ও দ্বিতীয় অঙ্কের কালগত ব্যবধান প্রসঙ্গে শেকসপিয়রের উইন্টার্স টেরলে’র উল্লেখ করেছেন।
‘প্রকৃত ও অতিপ্রকৃত’ প্রবন্ধে কালিদাসের ‘কুমার সম্ভবের উল্লেখ করেছেন প্রসঙ্গক্রমেই।
‘বিবিধ প্রবন্ধে’র প্রবন্ধগুলিতে বঙ্কিমের সাদৃশ্য ও বৈশাদৃশ্য দেখানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায় : প্রথমে শকুন্তলার সঙ্গে মিরান্দার সাদৃশ্য যেটা শকুন্তলা, মিরান্দা এবং দেসদিমোনা প্রবন্ধে লক্ষ্য করেছেন।
-
(i) উভয়েই ঋষি কন্যা; প্রসপেরো ও বিশ্বামিত্র উভয়েই রাজর্ষি।
-
(ii) উভয়েই ঋষিকন্যা বলে অমানুষিক সাহায্যপ্রাপ্ত। মিরান্দা এরিয়ল রক্ষিতা, শকুন্তলা অপ্সরা রক্ষিতা।
-
(iii) উভয়েই ঋষি পালিতা ও অরণ্যের মধ্যে প্রতিপালিতা।
বৈশাদৃশ্য :
(১) শকুন্তলা সরলা হলেও অশিক্ষিত নন। তাঁর শিক্ষার চিহ্ন তাঁর লজ্জা আর মিরান্দা এত সরল যে তার লজ্জাও নেই।
(২) মিরান্দা ও শকুন্তলার সংসার শূন্য ছিল। কিন্তু মিরান্দা ফার্দিনান্দকে ভালোবাসে তা তার পিতার কাছে ফার্দিনান্দের প্রতি প্রণয়াসত্তা হয়ে তার রূপের কথা বলেছেন। কিন্তু শকুন্তলা সখীদ্বয়ের কাছেও তাঁর মনের কথা বলতে লজ্জা করেছেন।
(৩) মিরান্দার প্রেমে কোনো লুকোচুরি নেই। সরাসরি ফার্দিনান্দকে তিনি বলে বসেন— I am your wife if you will marry me. কিন্তু শকুন্তলার প্রেমে লুকোচুরির ভাব ছিল।
শকুন্তলা ও দেসদিমোনার চরিত্রের সাদৃশ্য :
(i) শকুন্তলা ও দেসদিমোনা উভয়েই গুরুজনদের মতামতের অপেক্ষা না করে প্রেমিকের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
(ii) দুজনেরই আত্মসমর্পণ বীরপুরুষে আত্ম-সমর্পণ।
(iii) দুই নায়িকার ‘দুরারোহিণী’ আশালতা পরিশেষে ভগ্ন হয়েছিল। উভয়েই স্বামী কর্তৃক বিসর্জিত হয়েছিলেন।
বৈশাদৃশ্য :
(১) দেসদিমোনা স্বামীর প্রহার ও অবহেলাতেও স্বামী প্রীতিই দেখিয়েছেন কিন্তু শকুন্তলা তা করেনি।
‘উত্তর চরিত’ প্রবন্ধে কালিদাস ও ভবভূতির প্রসঙ্গ উত্থাপিত হতেই তিনি উভয়ের তুলনা করেছেন—
(i) কালিদাসের বর্ণনা শক্তি অতি প্রসিদ্ধ, কিন্তু ভবভূতির বর্ণনা শক্তি উত্তম।
(ii) মধুরে কালিদাস, উৎকটে ভবভূতি।
(iii) কালিদাসের বর্ণনা অতুল উপমা প্রয়োগে মনোহারিণী; ভবভূতির উপমা প্রয়োগ অত্যন্ত বিরল; কিন্তু বর্ণনীয় বস্তু তাঁর লেখনী মুখে স্বাভাবিক শোভার অধিক শোভা ধারণ করে।
Leave a comment