প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ সংগ্রহের ভূমিকায় শ্রদ্ধেয় অতুলচন্দ্র গুপ্ত মশাই বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের আনুপূর্বিক আলোচনা প্রসঙ্গে একটি অর্থপূর্ণ উক্তি করেছিলেন…“রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ মহাকবির হাতের প্রবন্ধ—সর্বত্র পড়েছে মহাকবির মনের ছাপ, সর্বত্র মহাকবির বাকবৈভব। বিচারে যুক্তির মধ্যে হঠাৎ এল উপমা …প্রতিপক্ষের মনে হল এ অন্যায়।” শুধু প্রতিপক্ষ কেন, এই মনোভাব দ্বারা চালিত হয়েই কিনা জানি না, অতিশয় স্বপক্ষীয় এবং একনিষ্ঠ একজন রবীন্দ্র-ভক্ত বিশেষজ্ঞও রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সম্বন্ধে মন্তব্য করে বসেছেন, “যুক্তি শৃঙ্খলা বলিতে যাহা বুঝি, মনন ক্রিয়ার পারম্পর্য বলিতে যাহা বুঝি তাঁহার প্রকাশের মধ্যে হয়তো সর্বত্র তাহা নাই। যে সরস উপমা সাদৃশ্য তাঁহার রচনার একটা বিশেষ ভঙ্গি, তাহা সর্বত্র সত্যও নয়, অকাট্য যুক্তি দিয়া হয়তো সব সময় তাহার প্রতিষ্ঠাও করা যায় না।” [নীহার রঞ্জন রায়, ‘রবীন্দ্র সাহিত্যের ভূমিকা’ ॥ ফলে, এমনও হতে পারে যে, কোনো কোনো পাঠক সম্ভবত এই অতিমান্য বিশেষজ্ঞের এতাদৃশ মন্তব্যের আলোকেই আলোচ্য প্রবন্ধের রবীন্দ্রনাথ-কৃত উপস্থিত উক্তিটিও ‘বিচার করতে প্রবুদ্ধ হবেন। কেননা, এতক্ষণ তো রবীন্দ্রনাথ আমাদের এই কথাই বুঝিয়ে আসছিলেন যে, সাহিত্যের বিষয় হচ্ছে মানব হৃদয় ও মানব চরিত্র; তার উপকরণ সংগীত ও ছবি এবং তার জন্য রচনাকৌশল নামক ; ব্যাপারটাও একটা অতিশয় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। তারপরই হঠাৎ আবার এ কী ঘোষণা—‘সাহিত্য ব্যক্তি বিশেষরও নহে, রচয়িতারও নহে, তাহা দৈববাণী। দৈববাণী আবার কোথা থেকে এল ? অতএব এই উক্তি নিঃসন্দেহেই নীহাররঞ্জন কথিত কবির সেই ধরনেরই এক উক্তি, যা পারম্পর্যহীন, যুক্তি দিয়ে যাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না, এমনকি তা হয়তো সর্বতোভাবে সত্যও নয়। এটা নিছকই রবীন্দ্রনাথের সেই সরস ভঙ্গিরই একটা নিদর্শন, তাঁর মহাকবি-সুলভ বাকবৈভব।
আমরা কিন্তু ব্যাখ্যাটা এভাবে মেনে নিতে একেবারেই প্রস্তুত নেই। পরস্তু, আমরা মনে করি, রবীন্দ্রনাথের এই কথাটি শুধু সাহিত্য সৃষ্টিই নয়, যাবতীয় ললিত-কলা সৃষ্টিরই একেবারে গোড়ায়, আদ্যতম কথা। কারণ এই বাক্যটির মধ্য দিয়ে তিনি যে রহস্যময় বস্তু বা phenomenonটির প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন, সেটি সাহিত্যও নয়, সাহিত্যের বিষয় বা উপকরণও নয়—সেটি হচ্ছে যে-মন এই সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হয় সেই কবি মন, সেই poetic অথবা artistic instinct. এ সম্বন্ধে একটা কাজ চালাবার মতো ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন ঠিকই। এবং সেই ব্যাখ্যা সংক্ষেপে হচ্ছে এই যে, ভগবানের সানন্দ ও লীলাময় স্বরূপ যেমন প্রকৃতি ও মানব চরিত্রের মধ্যে বহু ও বিচিত্ররূপে অভিব্যক্ত হয়ে নিজেকে সৃষ্টিও করছে, উপভোগও করছে, মানুষও তেমনি তার সাহিত্যের মধ্যে তার নিজেরই আনন্দ স্বরূপকে বহুবিচিত্র কায়ায় রূপবদ্ধ করে তাকে আস্বাদন করছে। কিন্তু এ ব্যাখ্যাও যে তাঁর সম্পূর্ণ মনঃপুত হয় নি, তার নিদর্শন হচ্ছে তাঁর ব্যবহৃত এই ‘দৈববাণী’ শব্দটি। তবে সঙ্গে একথাও স্বীকার্য, এই সংজ্ঞাটুকু ছাড়া কবি-প্রতিভার ভিন্নতর কোনো ব্যাখ্যা বোধহয় হয়ও না। অন্তত আজও পর্যন্ত হয়নি।
এই জন্যই আমরা দেখতে পাই, ক্রৌঞ্চমিথুনের শোকে বিগলিত-হৃদয় আদি কবি বাল্মীকি তাঁর প্রথম শ্লোকটি রচনা করেই বিস্ময়বিমূঢ় চিত্তে নিজেকে যে প্রশ্নটি করেছিলেন ‘কিমিদং ব্যাহৃতং ময়া’ ? এ আমার মুখ দিয়ে কী দিব্যবাক্য উচ্চারিত হল?– সেই প্রশ্নের নিঃসংশয় জবাব আজও কবিরা পাননি। এবং সেই একই কারণে সেই দু হাজারেরও বেশি বছর আগে কবিদের সম্বন্ধে সক্রেটিস্ যে মন্তব্য করেছিলেন, “It is a divine inspiration which moves you: For the authors of those great poems which we admire, do not attain to excellence through the rules of any art, but they utter their beautiful melodies of verse in a state of inspiration and as it were possessed by a spirit not theirs.” [Shelley অনুদিত Ion থেকে]
কবিত্বের এই ব্যাখ্যাও যেমন রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘দৈববাণী’রই দু হাজার বছরের পুরোনো রকমফের, তেমনই একেবারে সাম্প্রতিককালের একজন অতিমান্য ইংরেজ সমালোচক যখন কবিত্বের স্বরূপ নির্দেশ করতে গিয়ে বলেন, “Poetry, like all arts, originates in an act of intuition or a vision…Poetry is, properly speaking, a transcendental quality-a sudden transformation whcih words assume under a particular influence-and we cannot define this quality more explicitly than we can define a state of grace.” [Herbert Read, ‘Form in Modern Poetry”]
তখন সে ব্যাখ্যাকেও রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের ভিন্নতর কোনো বক্তব্য বলে মনে হয় না। বরং মনে হয় তাঁর ‘state of grace’ শব্দটির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি যেন রবীন্দ্রনাথের ‘দৈববাণী’ কথাটিরই প্রতিধ্বনি করেছেন। শুধু তা না, এই ‘সাহিত্যের তাৎপর্য প্রবন্ধটির রচনাকালের সাত বছর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ‘পঞ্চভূত’-এ যে বলেছিলেন, “যোগের সকল তথ্য জানি না; কিন্তু শুনা যায়, যোগবলে যোগীরা সৃষ্টি করিতে পারিতেন। প্রতিভার সৃষ্টিও সেইরূপ। কবিরা সহজ ক্ষমতা বলে মনটাকে নিরস্ত করিয়া দিয়া অর্ধ-অচেতন ভাবে যেন একটা আত্মার আকর্ষণে ভাব রস দৃশ্য বর্ণ ধ্বনি কেমন করিয়া সঞ্চিত করিয়া, পুঞ্জিত করিয়া, জীবনে সুগঠনে মণ্ডিত করিয়া খাড়া করিয়া তুলেন।”—তাঁর সেই বক্তব্যেরও মধ্যেও যেন রীড সাহেবের বক্তব্যের পূর্বছায়া আছে।
কবিত্বের এই অনৈসর্গিক প্রকৃতি সম্বন্ধে আমাদের সংস্কৃত আলংকারিকদের বক্তব্যও কখনও মোটামুটি এই একই গোত্রের, কখনও আরও তত্ত্ব-জটিল। যেমন, কবিত্ব কী-এ প্রশ্নের উত্তরে আচার্য বামন বলেছেন—’কবিত্বস্য বীজং কবিত্ব বীজং, জন্মান্তরাগত সংস্কার বিশেষঃ”। অভিনব গুপ্ত বলেছেন, কবিত্ব হচ্ছে ‘অপূর্ববস্তু নির্মাণ-ক্ষমা প্রজ্ঞাঃ’। আবার কেউ কেউ নাকি এমন কথাও বলেছেন কবিত্ব যে, কী, এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে ব্রহ্মাজিজ্ঞাসারই মতো নেতি নেতি।
আর আমাদের মধ্যযুগীয় মঙ্গল কাব্যের কবিরা তো এইসব ব্যাখ্যা-ট্যাখ্যার ধারই মাড়াননি। তাঁরা প্রায় সকলেই একবাক্যে ঘোষণা করেছেন, তাঁরা যা লিখেছেন যেসব আদৌ তাদের লেখা নয়। সেসবই তাঁদের আরাধ্য দেবদেবীরা তাঁদের হাতে ধরে লিখিয়েছেন। এ ঘোষণা কবিকঙ্কনের, এমনকি এ ঘোষণা ভারতচন্দ্রেরও। তিনিও বলেছিলেন অন্নপূর্ণার আদেশ ও প্রসাদেই তিনি অন্নদামঙ্গল রচনা করেছেন। অন্নদা তাঁকে ভরসা দিয়েছিলেন—যে করে সে হবে গীত,’ আনন্দে লিখিবে।
আসলে এ সম্বন্ধে শ্রদ্ধেয় প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’র আলোচনা প্রসঙ্গে যে কথা বলেছিলেন, ‘কবিত্ব-শক্তি বস্তু যে কী, তা লজিকের সাহায্যে প্রমাণ করা যায় না’, সেই কথাটাই পুনরায় স্মরণ করে মেনে নিতে হয়, কবিত্ব যে আসলে দৈববাণী-রবীন্দ্রনাথের সেই ব্যাখ্যাটাই কবিত্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরিচয়। তাই দৈববাণী বলেই কবিত্বটা যেমন কবির একলার ভোগ্য বিষয় নয়, তেমনই সেটা দেশকালের চৌহদ্দির মধ্যে আটকে রাখারও জিনিস নয়। তার প্রকাশ এবং উপভোগ—এ দুটোতেই চিরকালীন বিশ্বমানব সমানে অংশ নিয়ে চলেছে। কেননা, এখনো আমার এই বিশ্বাস যে সমস্ত মানুষের মনের সঙ্গে একটি অখণ্ড গভীর যোগ আছে ; তাহার এক জায়গায় যে-শক্তির ক্রিয়া ঘটে অন্যত্র গূঢ়ভাবে তাহা সংক্রামিত হইয়া থাকে।” [ জীবনস্মৃতি ]—এই বিশ্বাস ও বোধের মধ্যেই কবিত্বের সেই বিশ্বমানবিক দৈববাণী উচ্চারিত হয় ; হয়ে থাকে।
Leave a comment