কেবল সাহিত্য বা অন্যান্য ললিতকলাই নয়, যে-মানব মন পৃথিবীর তাবৎ সাহিত্য ও কলাকৃতির স্রষ্টা সেই মনই যে প্রকৃতির আর্শি নয়, সেই তত্ত্বটি রবীন্দ্রনাথ আমাদের অবধান-গোচর করেছেন ‘সাহিত্য’ পুস্তকের একেবারে প্রথম বাক্যটি থেকে। সেখানেই তিনি বলে রেখেছেন “বাহিরের জগৎ আমাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করিয়া আরেকটা জগৎ হইয়া উঠিতেছে।” এবং অব্যবহতি পরেই আবার বলেছেন, “তাহাতে কেবল বাহিরের রং আকৃতি ধ্বনি প্রভৃতি আছে তাহা নহে, তাহার সঙ্গে আমাদের ভালো লাগা মন্দ লাগা, আমাদের ভয় বিস্ময়, আমাদের সুখ দুঃখ জড়িত—তাহা আমাদের হৃদয়বৃত্তির রসে নানাভাবে আভাসিত হইয়া উঠিতেছে ৷ এই হৃদয়বৃত্তির রসে জারিয়া তুলিয়া আমরা বাহিরের জগৎকে বিশেষ রূপে আপনার করিয়া লই।”
অর্থাৎ আমাদের বোধোদয়ের জন্মমুহূর্ত থেকেই কিছুটা জন্মলব্ধ প্রবৃত্তি ও প্রবণতা এবং বাকিটা আমাদের আপন আপন অভিজ্ঞতার দ্বারা আমরা প্রত্যেকেই আমাদের মনের মধ্যে আরেকটা করে পৃথিবী গড়ে তুলছি। আর যেহেতু এই পৃথিবীটা আমাদের নিজেদেরই মনগড়া পৃথিবী, সেই হেতু এ পৃথিবীর কোনো কিছুরই বস্তুদেহ নেই। ধূলিকণা থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এখানকার সমস্ত কিছুরই অর্থ আছে, বিম্ব আছে, কিন্তু ধরা-ছোঁয়ার মতো কোনো আকার নেই। এ পৃথিবীর সমস্ত কিছুই আমাদের এক-একটি মনসিজ ধারণা বা আইডিয়া।
এই হচ্ছে মানবমনের একটি সহজাত স্বকীয় ধর্ম ও তার ক্রিয়া-কলাপ। এরই সঙ্গে মনের আরও একটি যমজ ধর্মও আছে, সেটি ওই প্রথমোক্ত ধর্মটিরই সঙ্গে পাশাপাশি পা মিলিয়ে চলে। মনের এই দ্বিতীয় স্বরূপের পরিচয়ও রবীন্দ্রনাথ ইতিমধ্যে নানান দৃষ্টান্ত সহকারে আমাদের অবগত করিয়েছেন। সে ধর্মটি হচ্ছে মনের অনিবার্য প্রকাশ-উন্মুখতা। প্রাণেরই আত্মজ বলে মনেরও একটা অবশ্যম্ভাবী প্রবৃত্তি হল, প্রাণেরই মতো শুধু নিজেরই অস্তিত্বের মধ্যে সীমিত না থেকে সেও অপরের মনের মধ্যে পুনর্জাত হয়ে কৃতার্থ হতে চায়। চায় নিজের গড়া এক-একটা আইডিয়াকে অপর মনেরও গোচরীভূত করতে। কিন্তু আইডিয়ার তো কোনো অবয়ব নেই, সেটাকে অপরের প্রত্যক্ষ উপলব্ধির উপর স্থাপন করা যাবে কী করে? অতএব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য একটা আধার চাই, একটা সাঁকো—যেটাকে অবলম্বন করে অপরের মনে পৌঁছানো যায়। এই সাঁকো বা আধারগুলির নানান প্রকরণ—পট, পাহাড়ের গা, গুহাগাত্র, পাথরের চাদর, ধাতুর চাদর, মৃত্তিকাপিণ্ড, পাথরের চাঁই এবং ভাষা। এই ভাষারও আবার কতকগুলি ধ্বনি (sound) ব্যতীত অপর কোনা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অবয়ব নেই। সুতরাং নিরবয়বকে বোধ্য করতে ভাষার আধারে আবার আমদানি করতে হয় অর্থের ছবি আর সংগীতের বেগ।
এ সমস্ত কথা রবীন্দ্রনাথ এতাবৎ আমাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন আর্টিস্টের সৃষ্ট আধারে ভূমিষ্ঠ হতে গিয়ে প্রাকৃত বস্তুনিচয়কে দু-দুটো জন্মান্তর ও রূপান্তরের স্তর পার হয়ে আসতে হয়। প্রথমবার তার জন্মান্তরিত রূপান্তর ঘটে আর্টিস্টের মনে, দ্বিতীয়বার ঘটে আর্টিস্টের ব্যবহৃত মাধ্যমে। অতএব সাহিত্যই কি, অথবা অন্যবিধ কলাকর্মই কি—কোনোটাই যে প্রকৃতির আর্শি হতে পারে না, ফলিত বৈজ্ঞানিক নিয়মেই সেটা হওয়া সম্ভবই নয়, ইতিমধ্যে সেসব কথা তো আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছে সংশয়াতীত ভাবেই বুজে নিতে পেরেছি। তবে আবার কথাটা পুনরায় নতুন করে পাড়বার কী প্রয়োজন হল?
এছাড়াও, আরও একটি প্রশ্ন আছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘যাহাদের চক্ষে ধুলা দেওয়া শক্ত’ এমন কোনো দুর্মুখই হয়তো প্রশ্নটা করে বসবেন—এতক্ষণ তো কবি আমাদের কাছে ঘোষণা করে আসছিলেন, সাহিত্যের বিষয়টা কোনোরূপ প্রমাণ করার ব্যাপার নয়, তার কাজ শুধুমাত্র সাহিত্যিকের ভাবনাটিকে পাঠকের মনে চারিয়ে দেওয়া, সঞ্চারিত করা। তাহলে তিনি আবার এখন এমন কথা কেন বলছেন যে ‘আমি যাহা একান্তভাবে অনুভব করিতেছি…তাহা সর্বসাধারণের হৃদয়ের মধ্যে প্রমাণিত করিয়া আমি বিশেষভাবে সান্ত্বনা ও সুখ পাই।’ অর্থাৎ কেবল ফলিত বিজ্ঞানের বিষয়ই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে সাহিত্যের বিষয়টাকেও প্রমাণিত করতে হয়। এটাই বা কী ব্যাপার? এটা কি বক্তব্যের স্ববিরোধ?
‘সাহিত্য-গ্রন্থের ভাষ্যকারেরা কিন্তু কেউই এই উদ্যত প্রশ্ন দুটির সম্মুখীন হন নি। অথচ একটু অভিনিবেশ সহকারে নজর করলেই দেখা যাবে, বস্তুতপক্ষে এই প্রশ্ন দুটিকে সামনে রেখেই রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত প্রসঙ্গটির আলোচনায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এবং সে নজরের জন্য যে খুব একটা সুতীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি বা অণুবীক্ষণের প্রয়োজন তাও নয়। এ আলোচনায় যে দৃষ্টান্তগুলি রবীন্দ্রনাথ আমাদের অবধানের জন্য রেখেছেন—যেমন, পুত্রশোকাতুরা প্রাকৃত মা, আমাদের প্রত্যেকেরই পরমাত্মীয় যে-মানুষজন, অতিশয় অন্তরঙ্গ হয়েও যাদের আমরা পুরোপুরি চিনতে পারি না ; অথবা উকিল, ডাক্তার কী দোকানদার নামে যে ছায়াদেহ মানুষগুলির সংস্পর্শে আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অহরহ এসে থাকি—সেই দৃষ্টান্তগুলির দিকে চোখ তুলে চেয়ে দেখলেই আমাদের না বোঝার কথা নয় যে, রবীন্দ্রনাথের এবারকার আলোচনার প্রসঙ্গটি হচ্ছে হৃদয়াবেগ সঞ্জাত কোনো নীরূপ আইডিয়া-বিষয়ক নয়। তাঁর এবারকার আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে সাহিত্যের অপর যে বিভাগটি—যার প্রধান উপজীব্য হল মানব চরিত্র— তারই বিষয়।
বলাবাহুল্য, সাহিত্যের এই বিভাগটিই বৃহত্তর। নাটক, ছোটোগল্প, উপন্যাস, কাহিনি কাব্য—এ সমস্ত মাধ্যমই এই বিভাগের অন্তর্গত। আর এই সমস্ত মাধ্যমগুলিরই মূল ভিত্তি হল একটি করে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে পরিপূর্ণ এবং আদি-মধ্য-অন্তত ও কার্যকারণের সম্বন্ধতায় গ্রথিত একটি প্রতীতি-সম্পূর্ণ কাহিনি। এই কাহিনি বা প্লটের আধারেই সাহিত্যকার তাঁর নিজস্ব রুচি, আদর্শ ও জীবনবোধ অনুসারে মানব চরিত্রের বিভিন্ন বিকশিত রূপকে বিগ্রহায়িত করে থাকেন। এই কারণেই সাহিত্যের এই বিভাগটির ক্ষেত্রে—তা সে পাঠকের পরিপূর্ণ উপভোগের দিক থেকে হোক, কী সাহিত্যিকের সৃজনকর্মের দিক থেকেই হোক—উভয়ের সামনেই উপরোক্ত প্রশ্ন দুটি তর্জনি তুলে দাঁড়ায়—এইসব কাহিনি এবং এদের চরিত্রগুলি কি প্রামাণ্য, বিশ্বাস্য? এগুলির রূপায়ণ কি প্রাকৃত ঘটনা ও মানুষের যথাযথ অনুসরণ করেছে? বা তার করার জন্য কি সাহিত্যিকের কোনো বাধ্যবাধকতা আছে?
কাব্যের ক্ষেত্রে অর্থাৎ যেখানকার পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে একজনের একটা হৃদয়াবেগ তানিত আইডিয়াকে পাঠকের মনে সঞ্চারিত করে দেওয়া, তখন এ প্রশ্ন আসে না। পাঠক যখন শোনে কোথাও একজন মানুষ অপার বিস্ময় আর এক পরম আবিষ্কারের অগাধ আনন্দে উচ্চারণ করছেন—
“এ কি কৌতুক নিত্য নূতন
ওগো কৌতুকময়ী
আমি যাহা কিছু বলিবারে চাহি
বলিতে দিতেছ কই,
অন্তর মাঝে বসি অহরহ
মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
মিশায়ে আপন সুর।
তখন পাঠক স্বতঃসিদ্ধ ভাবেই ধরে নেয়, এই উপলব্ধি প্রকৃতিতে কোথাও ঠিক এই চেহারায় ছিল না—এই রূপান্বিত উপলব্ধির জন্মভূমি হচ্ছে কবি নামক একজন মানুষের অনন্য হৃদয়ভূমি। এবং এ প্রশ্নও তার মনে জাগে না ‘যে কবির এই উপলব্ধি যথার্থ বা প্রামাণ্য কিনা। কারণ সে জানে, কবির এই অনন্য উপলব্ধির অমরাবতীতে পৌঁছানোর একমাত্র ছাড়পত্র হল নিজের উপলব্ধিকে জাগ্রত করে কবির সহৃদয় হওয়া।
পক্ষান্তরে, এই কবি নামক ব্যক্তিটিই যখন কাহিনিকারের বেশে অবতীর্ণ হয়ে কোনো এক উলাপুর গ্রামের এক নবনিযুক্ত পোস্টমাস্টার আর রতন নাম্নী একটি পিতৃমাতৃহীনা বালিকাকে পাঠকের সামনে হাজির করে তাদের উভয়ের মধ্যে ক্রমান্বয়ে গড়ে ওঠা এক রমণীয় হৃদ্যতার সম্পর্ককে উদ্ঘাটিত করেন আবার সহসা ছিন্নও করে দেন সেই সম্পর্কটাকে। অথবা, যখন পাঠকের মনশ্চক্ষুর সুমুখে টেনে নিয়ে আসেন ভূপতি, চারু আর অমল নামে তিনটি নর-নারীকে—যাদের বাহ্যিক ও মানসিক সম্পর্কের পারস্পরিক ঘাত প্রতিঘাতে, তাদের অবচেতনবাসী হৃদয়বৃত্তির আগ্নেয়স্পর্শে, তাদের চিন্তা ও আচরণের কার্যকারণগত পরম্পরার গতিপথ ধরে, এই তিনজন নরনারীকে ঘিরে মাথা তুলে দাঁড়ায় ভঙ্গুর দাম্পত্যজীবন নামক এক উদ্গীরোন্মুখ আগ্নেয়গিরি, যার বহ্নিলীলাটা বাইরে থেকে একেবারেই দেখা যায় না, কিন্তু বোঝা যায় পাহাড়টা ভিতরে-ভিতরে একেবারে খাক হয়ে গিয়েছে—এরূপ ক্ষেত্রে কিন্তু পাঠকের মনে প্রায়শই উপরোক্ত প্রশ্ন দুটি উদ্যত হয়ে ওঠে। সাহিত্যিকের আঁকা এমন সব চরিত্র, তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের এমনতর পরিণতি প্রকৃতিতে কি সম্ভব ? আমরাও তো আমাদের প্রতিদিনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় এমন কত গ্রাম্য পোস্টমাস্টার দেখেছি, দেখেছি ভূপতি-চারু অমলের মতো কত দাম্পত্য ত্রিভুজ—কিন্তু কই, আমরা তো তাদের এমন করে কখনো দেখতে পাইনি।
আর তখনই আবার সাহিত্যিককে সাহিত্য ও আর্টের সেই প্রায়-অবিসম্বাদিত স্বরূপটাকেই পুনর্ঘোষণা করে বলতে হয়, দেখতে পাও না, কারণ সাহিত্য ব্যাপারটা ঠিক প্রকৃতির প্রতিবিম্ব নয়। বলতে হয়, বহিঃসম্পর্কে মানুষকে তোমরা অতিশয় খণ্ডিত দৃষ্টিতেই দেখে থাকো। বাইরের মানুষের কথা ছেড়ে দাও তাদের তো তোমরা চেনো শুধু এক একটা নামের লেবেল হিসাবে। তোমরা তোমাদের অন্তরঙ্গতম আত্মীয়টিকেই বা কতটুকু চেনো? কতটুকু তোমার দেখার অবকাশ বা অবসর? তোমার দৈনন্দিন জীবনের প্রতি মুহূর্তে কত ঘটনা, জীবনের কত ছবি, কত সংঘাতক্ষুব্ধ নাটকীয় মুহূর্ত তোমার সচেতন ও অবচেতন অভিজ্ঞতার ঘাড়ে হুড়মুড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এদের মধ্যে কাকে ছেড়ে কাকে তুমি ধরবে, কার দিকে চোখ তুলে চাইবে? কী বুঝবে এদের মধ্যে কার গহন অন্তরপ্রদেশে মনোবৃত্তির কোন বিচিত্রলীলা প্রতিক্ষণে আবর্তিত হচ্ছে? এসব তো প্রকৃতির আয়নায় ধরা পড়ে না।
কিন্তু সাহিত্যিকের, আর্টিস্টের মনের আয়নায় এ সমস্ত কিছুই ধরা পড়ে। ধরা পড়ে তাদের সুগভীর জীবনবোধের পটে, মানুষ সম্পর্কে প্রগাঢ় সমবেদনায় আতুর তাদের অতিশয় স্পর্শকাতর চিত্তে। এই অনন্য জীবনবোধ, এই কল্পনাপ্রখর সমবেদনা বা empathy-ই আর্টিস্ট ও সাহিত্যিকের দৃষ্টিকে যোগচক্ষুর সমকক্ষ ত্রিকালদর্শী করে তোলে। আর এই দৃষ্টির সঙ্গে যখন তাদের সহজাত সৃজনশক্তি ও রচনা-কৌশলের একীকরণ ঘটে, তখনই সাহিত্যের ভূমণ্ডলে ভূমিষ্ঠ হয় এক-একটি অনন্য মানুষ, আর হৃদয় ও জীবন সম্পর্কিত এক-একটি অনন্য মানব-পরিস্থিতি—যাদের নিয়ে সাহিত্যিক আদি মধ্য ও অন্তের সুসম্বন্ধ ও সুমিত বিন্যাসে এক-একটি হৃদয়গ্রাহী উদ্দীপক কাহিনি গড়ে তোলেন।
বলা বাহুল্য, লেখকের সৃষ্ট এই চরিত্র আর মানবপরিস্থিতিগুলির মতো তাঁর রচিত কাহিনিটাও প্রকৃতির আর্শি হতে পারে না। পারে না এই জন্যই—সাহিত্যিক তাঁর যে কাহিনিটি রচনা করেন, তার মৌল উপাদান তো তাঁর সেই মনসিজ চরিত্র আর মানব পরিস্থিতিগুলিই। এগুলিকেই সাহিত্যিক একটি আদি মধ্য ও অন্তের নাটকীয় পারম্পর্যে আকারিত করে তাঁর কাহিনিটিকে বয়ন করেন। সমাজ সম্বন্ধে বা জীবন সম্বন্ধে তাঁর যে নিজস্ব বক্তব্যটি সেটিকেও তিনি মূর্ত করেন তাঁর এই নিজের ‘মন-গড়া’ চরিত্র ও পরিস্থিতি-সৃষ্ট কাহিনিটিরই শরীরে। কাজেই, যেখানে দেখা যাচ্ছে, পরিকল্পনার অঙ্কুরটি থেকে মূর্তায়নের শেষ ধাপটি পর্যন্ত সবধানেই রয়েছে আরেকটি তৃতীয় পক্ষ, যার নাম লেখক—তারই নিজস্ব ধারণা, পছন্দ এবং নির্মিতি—যেখানে সে বস্তুর প্রকৃতির প্রতিকৃতি হওয়ার তো কোনোদিক থেকেই কোনও সাধ্য নেই। আপাতদৃষ্টে যতই সে কাহিনি বাস্তবানুগ হোক।
কোনোরূপ বিভ্রান্তি সৃষ্টির আগেই, গোড়া থেকেই বুঝে রাখা আবশ্যক, ‘মনগড়া’ বলতে এখানে কিন্তু কোনো সৃষ্টিছাড়া বা বাস্তববর্জিত ব্যাপারের কথা বলা হচ্ছে না। ‘মনগড়া’ বলতে এ প্রসঙ্গে এই কথাটাই বলবার চেষ্টা হয়েছে যে, লেখক নামক একজন মানুষের মানসপটে অথবা তাঁর স্মৃতিপটে এসে ভিড় করে দাঁড়িয়ে গেছে অনেক দেখা, শোনা, ও জানা বাস্তবঘটিত মানুষ ও তাদের বাস্তবঘটিত আচরণ, এমনকি, সেই ভিড়ের মধ্যে হয়তো অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছে অপর কোনা পূর্বসূরী-রচিত অনেক মানুষও। এই উপাদানের ভিড় থেকেই অনেক ঝাড়াই-বাছাই করে কারুর খানিকটা নিয়ে, কারুর পুরোটই নিয়ে, কারুর আবার ঠিক উলটোটা নিয়ে—লেখক তাঁর নিজের মনের মতো অথবা পছন্দমতো সম্পূর্ণ পৃথক একটি মূর্তি নিজের হাতে গড়েছেন। এই ব্যাপারটাকেই বলা হয়েছে ‘মনগড়া’। খাঁটি সাহিত্য-সৃষ্টির কর্মকাণ্ডটি ঠিক এই ভাবেই সাধিত হয়। আর হয় বলেই, খাঁটি আর্টিস্টের রচনা স্বকালের হয়েও চিরকালের, একটি বিশেষ স্থানের হয়েও সর্ব বিশ্বের। আলোচ্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের মর্মার্থও তাই। অর্থাৎ আদ্যন্ত পুরো ব্যাপারটাই যেখানে মনসিজ, সেখানে সেটা প্রকৃতির আর্শী বা প্রতিকৃতি কী করে হবে?
এ প্রসঙ্গে অর্থাৎ কীভাবে লেখকের মানসপটে একটা কাহিনির জন্ম হয় আমাদের উপরোক্ত সেই বক্তব্যের সমর্থনে আমরা রবীন্দ্রনাথেরই অপর একটি উক্তি এখানে অতি সঙ্গতভাবেই স্মরণ করতে পারি। কারণ তাঁর ‘কাহিনি’ কাব্যগ্রন্থের মুখবন্ধে কবি ঠিক এই কথাটাই তাঁর অনন্য ভাষায় বলেছেন—
‘কত কী যে আসে কত কী যে যায়
বাহিয়া চেতনাবাহিনী!
আঁধারে আড়ালে গোপনে নিয়ত
হেথা হোথা তার পড়ে থাকে কত
ছিন্নসূত্রে বাছি শত শত
তুমি গাঁথ বসে কাহিনি।
ওগো একমনা, ওগো অগোচরা,
ওগো স্মৃতি-অবগাহিনী।
তব ঘরে কিছু ফেলা নাহি যায়
ওগো হৃদয়ের গেহিনী !
কত সুখ দুখ আসে প্রতিদিন
কত ভুলি কত হয়ে আসে ক্ষীণ—
তুমি তাই লয়ে বিরাম বিহীন
রচিছ জীবন কাহিনি
আঁধারে বসিয়া কী যে কর কাজ
ওগো স্মৃতি-অবগাহিনী।”
ভাবতে আরও আশ্চর্য লাগে, আর্ট ও প্রকৃতি এই যে আপাত-সাধম্য অথচ অনিবার্যভাবে বৈপরীত্যের পারস্পরিক সম্পর্কটি—সে বিষয়ে পরবর্তী কালের এক অতি জনপ্রিয় ইংরেজ ঔপন্যাসিক, সমারসেট মম* তাঁর নিজের অভিমতটি প্রায় রবীন্দ্রনাথের অনুরূপ ভাষাতেই ব্যক্ত করেছেন। যেমন—
“From the beginning of literature authors have had originals for their creations. It is the universal custom. ** As Turgenev said, it is only if you have a definite person in your mind that you can give vitality and idiosyncrasy to your creation.
I insist it is a creation. We know very little even of the persons we know most intimately. We do not know them enough to transfer them to the pages of a book. People are too elusive, too shadowy to be copied, and they are also too in-coherent and contradictory. The writer does not copy his originals; he takes what he wants from them, a few traits that have caught his attention, a turn of mind that has fired his imagination, and therefrom constructs his characters.” [ Summing Up, 1938]
ললিতকলা সম্পর্কেও মম সাহেবের অভিমত যেন প্রায় রবীন্দ্রনাথেরই প্রতিধ্বনি—
“The artist does not copy life, he makes an arrangement: out of it to suit his own purposes. When you look back on the art of the past you can hardly fail to notice that artists have seldom attached great value to realism. On the whole they have used nature only to make a formal decoration. **In painting and sculpture it might even be argued that a very close approximation to reality has always announced the decadence of a school.”
অর্থাৎ প্রকৃতির হুবহু অনুকরণের ভূতটা যদি কোথাও কখনো কোনো কারণে আর্টিস্ট বা সাহিত্যিকের ঘাড়ে চাপে, তখন বুঝতে হবে, সেখানকার সারস্বত প্রাঙ্গণে ভাসানের নৃত্যবাদ্য শুরু হবার আর খুব বেশি দেরি নেই।
মমের এই কথাগুলি রবীন্দ্রনাথের প্রকাশিত প্রবন্ধের প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পরবর্তীকালের রচনা। আর মম যে রবীন্দ্রনাথের এই লেখাগুলি কখনো পড়েছিলেন, এমন নজিরও ইতিহাসে নেই। অথচ এই দুজনের বক্তব্যের মধ্যে কী আশ্চর্য রকমের মিল। এটা আর অন্য কোনো ব্যাপার নয়। এই সাদৃশ্যের একমাত্র কারণ হচ্ছে, প্রকৃতি বনাম আর্টের এই মিল বিচ্ছেদের আদর্শই হচ্ছে আর্টের দুনিয়ার অধিকাংশ সাধকের শ্রেয়তম অনুসৃত আদর্শ। কিন্তু নির্বিশেষে সকলের জন্যই নয়। দুর্ভাগ্যবশত, এই আদর্শের একেবারে সম্পূর্ণ বিপরীত ধ্যান-ধারণার পরিপোষক একটি দলও গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সংস্কৃতি ক্ষেত্রে [ অতএব পৃথিবীর প্রায় সমুদয় ধনবাদী রাষ্ট্রেই] পূর্বোক্ত কলাকৈবল্যবাদীদেরই মতো প্রবল প্রতাপে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এদের কলাদর্শের নাম হচ্ছে naturalism বা প্রাকৃতবাদ। আর এঁদের ধর্মগুরুর নাম হচ্ছে এমিল জোলা (১৮৪০–১৯০২)।
এই প্রাকৃতবাদের মূল কথাটি হচ্ছে “Naturalisme la verite la science” —অর্থাৎ “সাহিত্যকে হতে হবে ফলিত বিজ্ঞানের মতো বর্ণে বর্ণে প্রকৃতির প্রতিলিপি । জীব-বিজ্ঞানী তাঁর গবেষণাগারে যে ভাবে জীবদেহকে কেটে ছিঁড়ে ব্যবচ্ছেদ করে প্রতিটি জীবকোষের প্রকৃতি নির্ণয় করে থাকেন, সাহিত্যিককেও হুবহু সেই ভাবে মানুষ ও তার সমাজ, বিশেষত মানুষের জৈব প্রবৃত্তিগুলিকে ব্যবচ্ছিন্ন করে একেবারে উধম উলঙ্গ করে দেখাতে হবে। সাহিত্যে কল্পনার আশ্রয় যত কম নেওয়া যায়, ততই তার সার্থকতা। সুসম্বদ্ধ প্লট সাহিত্যের পক্ষে চরম ছেলেমানুষি। প্রকৃতির এবং ঘটনার যথাযথ প্রতিবেদনই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে সাহিত্যের সর্বকাম্য সিদ্ধি।” [জর্জ মূর-Confession of a young Man]
অর্থাৎ এক কথায় প্রকৃতি এবং আর্টের মধ্যে যে স্বতঃসিদ্ধ এবং সত্যসিদ্ধ দূরত্ব ও ব্যবধানের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাহিত্য-প্রধানেরা এ পর্যন্ত যা যা বলেছেন, প্রাকৃতবাদীদের তালঠোকা দাবি এবং লক্ষ্য হচ্ছে ঠিক তার উল্টো। অতএব এ-সিদ্ধান্ত বোধ হয় খুব অসংগত হবে না যে, মূখ্যত প্রাকৃতবাদীদের এই উলটোপালটা বক্তব্যের প্রতিবাদ-উদ্দেশ্যেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই বর্তমান প্রবন্ধ রচনায় অনুপ্রেরিত হয়েছিলেন। এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে একাধিক ঐতিহাসিক নজিরও পেশ করা যায়। পেশ করা দরকারও। যেমন—
(১) ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ যখন দ্বিতীয়বারের মতো বিলেত পরিভ্রমণে গিয়েছিলেন, সে সময় অল্পকালের জন্য হলেও তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে এসেছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের কমলবনে ফাঁ দ্য সিয়েকল (Fine De Siecle শতাব্দীর অন্তিম) পন্থী মত্ত হস্তীদের তাণ্ডব। দেখে এসেছিলেন কীভাবে একদিকে একদল মানুষ ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’-এর নামে শিব গড়তে বসে একের পর একটি বানরের মূর্তি গড়ে চলেছেন, আর অন্যদিকে অপর একদল ন্যাচারালিজ্ম্-এর নামে কলা-সরস্বতীর শুভ্রাঙ্গে মাখাচ্ছেন বিকৃত জৈব প্রবৃত্তির দুর্গন্ধ কদম। কারণ, একমাত্র আস্তাকুঁড়, ভাগাড় আর নর্দমা ব্যতীত এই প্রাকৃতবাদীরা জীবনের আর কোনো ক্ষেত্রেই প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষ করতে পারেননি।
(২) সাহিত্যের শিবসুন্দর প্রাঙ্গণে এই প্রমত্ত গাজনের নৃত্য দেখে রবীন্দ্রনাথ বিচলিত বোধ করেছিলেন। অবশ্যই সেটা ইংরেজি সাহিত্যের জন্য নয়, আমাদের বঙ্গসাহিত্যেরই জন্য। কারণ রবীন্দ্রনাথ জানতেন, ধাবমান ইতিহাসের যে অমোঘ কারণে মধুসূদনের পরবর্তীকালীন বঙ্গ সাহিত্যের প্রতিটি আকার প্রকার ও আঙ্গিক এবং তার আচার আচরণের যাবতীয় পদক্ষেপগুলি প্রধানত কোনো না কোনা ইউরোপীয় সাহিত্য-মহারতীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই ঘটেছিল, এবং ঘটছিল, সম্ভবত সেই একই প্রাবণ্যের চোরাগলি দিয়ে ‘ফাঁ দ্য সিয়েকল’-এর পাঁকের স্রোতটাও বিশেষ করে, এই প্রাকৃতবাদের কাদায় গড়ানো বরাহবৃত্তিটা—অম্মদদেশীয় সৃজনী মানসিকতার মধ্যেও কালক্রমে অনুপ্রবিষ্ট হবে। এই ঋষি দৃষ্টিতে উদ্বোধিত হয়েই তিনি প্রাকৃতবাদের এই সম্ভাবিত বিকারটা সম্পর্কে বঙ্গীয় সাহিত্যিক এবং পাঠকবর্গকে আগে থাকতেই সতর্ক করে দিতে প্রযত্ন হয়েছিলেন। আর শুধু এই প্রবন্ধেই নয়, বরাবর এবং বারংবার তিনি এই অশুভ রাহুর আক্রমণের বিরুদ্ধে সরবে প্রতিবাদ করে গিয়েছেন।
(৩) মানব-সংসার ও মানব চরিত্রের বস্তুগত দিকটার যাথার্থ্য ও যথাযথতার পরিচয় দিতে গিয়ে সচরাচর আমরা ‘বাস্তব’ শব্দটাই ব্যবহার করে থাকি। রবীন্দ্রনাথও তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে আলোচনায় ও চিঠিপত্রে এই ‘বাস্তব’ শব্দের ব্যবহার অজস্রবার করেছেন। অথচ এই প্রবন্ধে কিন্তু সেই বহুপরিচিত ও বহুব্যবহৃত শব্দটি সযত্নে পরিহার করে তিনি কেবল ‘প্রকৃতি’ আর ‘প্রাকৃত’ এই শব্দদুটিই অনবরত ব্যবহার করে গিয়েছেন। এটা যে কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়, তা সতর্ক পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া অনুচিত।
Leave a comment