‘সাহিত্যের বিচারক’ প্রবন্ধ অবলম্বনে সমালোচনা ও সমালোচকের আদর্শ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য উপস্থাপিত করো।
‘সাহিত্যের বিচারক’ প্রবন্ধ অবলম্বনে সাহিত্য সমালোচনার উদ্দেশ্য ও রীতি পদ্ধতি সম্পর্কে নিজ বক্তব্য উপস্থাপিত করো।

সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে এক একজন স্রষ্টার পরিচয় পাওয়া যায় যাঁর প্রতিভা যুগাতিশায়ী। তিনি শুধু নিজে সৃষ্টি করেন না, তাঁর যুগে তিনি সৃষ্টির ধারাকেও নিয়ন্ত্রিত করে থাকেন। সাহিত্যের আদর্শের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ শোভা থাকে এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর প্রীতিও অনেক বেশি। তাঁর প্রতিভার গুণে সকলে সাহিত্যের আদর্শকে অনুসরণ করে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিভা ছিল এমন যুগাতিশায়ী। তাই তিনি সব্যসাচীর ন্যায় একদিকে সৃষ্টি, অন্যদিকে সাহিত্যের আদর্শ থেকে বিচ্যুত যশঃপ্রার্থী অনু অধ্যবসায় কুণ্ঠ লেখকদের কঠোর সমালোচনা করে নিবৃত্ত করেছেন। তাঁর প্রতিভার গুণে তিনি শুধু তাঁর যুগের নয় সকল যুগের যেন প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁর পরে টি. এস. এলিয়টস, কোলরীজ সর্বকালের বিচারকের আসন গ্রহণ করেছেন। সমালোচক বলেছেন : “The criticism of today may be said to be in direct descent from Coleridge.” স্বাধীন সৃষ্টির ক্ষেত্রেও যেমন সাধারণ স্রষ্টার পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি সমালোচনার ক্ষেত্রেও পাওয়া যায়।

মৌলিক রচনার ক্ষেত্রে এক একজন মানব হৃদয়ে চিরকালীন সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। উদাহরণ হিসাবে মহাকবি কালিদাস ও ইংরাজ কবি ও নাট্যকার শেকসপিয়র। তাঁদের প্রতিভা নিঃসন্দেহে সর্বকালের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি রাখে। সমালোচনার ক্ষেত্রেও তেমনি অ্যারিস্টটল, তাঁদের পরীক্ষা ও বিচারের ক্ষমতা ছিল অতন্ত প্রখর, প্রত্যেক সমালোচকের মধ্যেই একজন সমালোচক বাস করেন, এই সমালোচক সৃষ্টি প্রবাহের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন, সৃষ্টি যাতে ভাবে বিগ্রহ রচনা করতে পারে, কোনো ভাবানুহতা, অপক্ষপাত প্রাচুর্য কিংবা শৈথিল্য এসে তাকে বিক্ষিপ্ত ও ব্যাহত করতে না পারে, সেদিকে সমালোচক সচেতন থাকেন। সৃষ্টি ও সমালোচনা যেন হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যায়। এখানে একাগ্রচিত্তে জীবনের উপাদানগুলি মন্থন ও নির্বাচন করে রচনার কাজে মনোনিবেশ করতে হয়, সৃষ্টির মধ্যে জীবন সুসম্পন্ন রূপে, প্রতীক মূল্য হয়ে অসাধারণ মহিমায় দেখা দেবে।

স্রষ্টার মধ্যে যে সমালোচক বাস করেন, তিনি স্রষ্টার সত্তার থেকে অভিন্ন বলে মৌলিক রচনার দিকে সমগ্র দৃষ্টি রাখেন। উপরন্তু স্রষ্টা সমালোচক তাঁর নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে যতখানি সচেতন, অপরের সৃষ্টি সম্পর্কে নাও থাকতে পারেন। তিনি হয়তো প্রসঙ্গক্রমে সাহিত্য সৃষ্টির আদর্শ ও রীতি ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু অপর একজন কবি কোনো নতুন ধারা গ্রহণ করলেন, তাঁর সৃষ্টির উৎকর্ষ নিরূপণ করতে হলে পূর্বের ব্যাখ্যা ও আদর্শ যথাযথ সাহায্য নাও করতে পারে। সুতরাং এক্ষেত্রে সমালোচকের প্রয়োজন সাহিত্য রুচি ও বিচারবোধ। এমন সমালোচকই পাঠক মনের প্রতিনিধি। তাঁর ব্যাখ্যা ও বিচার সাহিত্য স্রষ্টার রচনাকে পাঠকমনে সহজেই পৌঁছে দেয়, সাহিত্যের লেখক জীবনকে নতুন করে ব্যাখ্যা করেন, পুনর্বিনস্ত ও ঐক্যবদ্ধ করেন, তাই তিনিই জীবন শিল্পী।

যাঁদের বিচার বুদ্ধি অশ্রান্ত, সাহিত্যের নিত্য লক্ষণগুলি যাঁরা অন্তঃকরণের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন, স্বভাবে ও শিক্ষায়, তাঁরা সর্বকালীন বিচারকের পদ গ্রহণ করতে পারেন, তবে এক শ্রেণির ব্যাবসাদার সমালোচক আছেন তাঁদের বিদ্যা সম্পূর্ণ পুঁথিগত। তাঁরা সারস্বত দরবারের বাইরে বসে হাঁক-ডাক, তর্জন-গর্জন করে থাকেন, অন্তঃপুরের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় খুবই কম। সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর প্রকৃত বিচারক নয়। তাই তাঁদের মতামত বা বিচারের উপর নির্ভর করা যায় না। ‘রামায়ণ’-এর পরিচয় দান প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—“কবি কথাকে ভক্তের ভাষায় আবৃত্তি করিয়া তিনি আপন ভক্তির চরিতার্থতা সাধন করিয়াছেন, এইরূপ পূজার আবেগ মিশ্রিত ব্যাখ্যাই আমার মতে প্রকৃত সমালোচনা। এই উপায়েই এক হৃদয়ের ভক্তি আর এক হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়।

সাহিত্য স্রষ্টা নৈর্ব্যক্তিক মনের সৃষ্টি হত যদি, তবে বিশ্লেষকমূলক বিচার পদ্ধতির সার্থকতা থাকত। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু সাহিত্যের বাণী স্বয়ংবরা, এলিয়ট বলেছেন যে, ‘কবির কাব্য তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রকাশ নয়। কথাটি আংশিক সত্য, কবি তাঁর কাব্যে যে অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে, তা হয়তো তিনি নিজের জীবনে উপলব্ধি করেননি, কিন্তু এই অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা তিনি আত্মসাৎ করেছেন, স্বীকরণ করেছেন। সুতরাং সেই ক্ষেত্রে তাদের প্রকাশ তাঁর ব্যক্তিত্বের দ্বারা রঞ্জিত, একে তখন আর নৈর্ব্যক্তিক বলা চলে না। কাব্যে তদ্‌গত দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু তা বিজ্ঞানের মতো ব্যক্তি নিরপেক্ষ ও নিরাসক্ত হতে পারে না। যেখানে আমরা নিজেদের মধ্যে অপরিমিত ঐশ্বর্যকে উপলব্ধি করে থাকি। সেখানে সম্পদের প্রকাশে আপন ব্যক্তিপুরুষেরই প্রকাশ।

সাহিত্য সমালোচনার বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি শ্রদ্ধেয় কিনা তা বিচারযোগ্য। বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপাদান অংশগুলির মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘সাহিত্য সমগ্রকে’ সমগ্র দৃষ্টি দিয়েই দেখতে হবে। মানুষের জীবনের নানান প্রবৃত্তি আছে, কিন্তু প্রবৃত্তি সমূহকে ছিন্ন করে দেখলে মানুষের পরিচয় পাওয়া যাবে না। সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় অভাবনীয় যোগসাধনের দ্বারাই চরিত্রের বিকাশ ঘটে। রবীন্দ্রনাথের অভিমত সাহিত্যের বিচার। সাহিত্যের ব্যাখ্যা, সাহিত্যের বিশ্লেষণ নয়।

আবার ব্যাখ্যানমূলক সমালোচনার প্রধান ত্রুটি হল, যেখানে পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা বেশি থাকে। মানসিক সংস্কারের কারণে সমালোচক কোনো কাব্য অথবা উপন্যাসকে ব্যাখ্যা করতে পারেন। স্বদেশি প্রীতি তাঁর দেশের কোনো সৃষ্টি বা রচনাকে হয়তো যথার্থভাবে বিচার না করে শ্রেষ্ঠ আসনে বসাতে উৎসাহিত করবে। যেমন তরুণ রবীন্দ্রনাথ মহাকবি কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ নাটককে শেকসপিয়রের কালজয়ী সৃষ্টির উপরে স্থান দিয়েছিলেন। তাই বিশ্লেষণ পদ্ধতি গ্রহণ করা আবশ্যক, যাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বলা যাবে।