ব্যক্তিগত আনন্দ চরিতার্থ করবার জন্য কখনো কবি-সাহিত্যিকরা কলম ধরেন না। পাখিরা নিজের উল্লাসেই গান করে কিনা, তা নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভবপর নয়, কিন্তু লেখক যে পাঠক-সমাজের জন্যই সাহিত্য রচনা করেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অবশ্য এর জন্য রচনাকে কৃত্রিম বলবার কোনো হেতু নেই, কারণ পরের জন্য হৃদয়ে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ-অনুভূতির সৃষ্টি হয় না, এমন কথা বলা চলে না। ‘নীরব কবিত্ব’ এবং ‘আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস’ বস্তুতঃ অর্থহীন উক্তি, কারণ সাহিত্যের ধর্মই হলো প্রকাশ। কার মনের মধ্যে কী আছে তা প্রকাশ না করলে কারো পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়, কাজেই যে ভাবোচ্ছ্বাস আপনার মনেই লুক্কায়িত রয়েছে, তার সার্থকতা কোথায়? প্রকৃতিজগৎ কিংবা জীবজগৎ—সর্বত্রই দেখা যায়, প্রত্যেকেই আপনাকে যত বেশি সম্ভব ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছে। জীবজন্তু তাদের সন্তানের মধ্যে দিয়ে আপনাকে প্রকাশ করছে, গাছপালা তাদের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে বংশবিস্তার করে যাচ্ছে। ওদের চেষ্টা চলছে দেশ ও কাল জুড়ে। মানুষও এইভাবে নিজের মনোভাব প্রকাশ করবার জন্য, নিজেকে ছড়িয়ে দেবার জন্য যুগ যুগ ধরে কত উপায়ে লিপি তৈরি করে যাচ্ছে। মানুষ জানে, তার বাড়িঘর, আত্মীয়-স্বজন এমন কি দেহটিও কাল-কবলিত হবে, কিন্তু যাতে তার মনের ভাবনাটা বেঁচে থাকে, তারি জন্য এত চেষ্টা, এত যত্ন। গোবি মরুভূমির বালুকাস্তূপের মধ্যে প্রাপ্ত জীর্ণ পুঁথিতে আমরা মানব-অন্তরের প্রকাশের চিরন্তন বেদনারই পরিচয় পাচ্ছি। সম্রাট অশোক আপনার কথাগুলি অপরের শ্রুতিগোচর করানোর জন্য, তাদের চিরস্থায়িত্ব দান করবার জন্য পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে রেখেছিলেন। দীর্ঘকাল সে লিপির পাঠোদ্ধার হয়নি, তা যেন এতকাল বোবার মতো শুধু ইশারায় মানব-হৃদয়কে আহ্বান করছে। এখন পাঠোদ্ধারের পর তার মনোভাব আমাদের নিকট ব্যক্ত হয়েছে। অশোকের লেখা অবশ্য সাহিত্য নয়, কিন্তু মানব-হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা এতে প্রতিফলিত হয়েছে। আমাদের যাবতীয় শিল্প, সাহিত্য, ভাস্কর্য – সমস্ত নির্মিতির মধ্যেই মানুষের হৃদয় অপর হৃদয়ের মধ্যে অমরতা চাইছে।
স্বল্পকালীন প্রয়োজন এবং চিরকালীন অমরতার মধ্যে যেমন পার্থক্য রয়েছে, তেমন পার্থক্য রয়েছে উভয়ের প্রকাশধর্মিতার মধ্যেও। আমাদের নিত্য প্রয়োজনের জন্য ধান, গম, যব প্রভৃতির বীজ বপন করি, যার স্থায়িত্ব বর্ষাকাল, কিন্তু অরণ্য প্রতিষ্ঠার জন্য বপন করি বনস্পতির বীজ। অপ্রয়োজনীয় হলেও সাহিত্যের মধ্য দিয়ে মানুষ শাশ্বত জীবন লাভেরই স্বপ্ন দেখে; আর সারবান সাহিত্যে প্রয়োজন মেটে কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। জ্ঞানের কথা একবার শুনলেই তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, কারণ জানা কথা বারবার শোনার প্রয়োজন হয় না। আবার নোতুনতর আবিষ্কারে এই জ্ঞানও আচ্ছন্ন হয়ে যায়। জ্ঞানের কথা প্রচারিত হলেই তা সার্থকতা লাভ করে, কিন্তু হৃদয়ভাবের কখনো প্রচারের ফলে পুরাতন হয় না কিংবা কখনো এর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় না। সূর্য যে পূর্বদিকে উদিত হয়, তা একবার জানলে আর দ্বিতীয়বার জানবার প্রয়োজন হয় না, কিন্তু সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য ও আনন্দ শতবার দর্শনেও মনকে ক্লান্ত করে না, বরং নিত্য নোতুন চমক জাগায়। অতএব নিজের যে বিষয়কে মানুষ চিরকালের জন্য ধরে রাখতে চায়, তা কখনো জ্ঞানের বিষয় নয়, ভাবের বিষয়। জ্ঞানের বিষয়কে ভাষান্তরিত করলে তার উজ্জ্বলতার বৃদ্ধিও হতে পারে কিন্তু ভাবের বিষয়কে ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না।
জ্ঞানের কথাকে প্রমাণ করতে হয়, কিন্তু ভাবের কথাকে নানাবিধ ছলা-কলার সাহায্যে সৃষ্টি করে অপরের মনে সঞ্চারিত করতে হয়। এই কলাকৌশলই ভাবের দেহ। কবির সাফল্যের পরিচয় পাওয়া যায় এই দেহের মধ্যে ভাব-রূপ প্রাণ-প্রতিষ্ঠায়। দেহের আধারটিকে অবলম্বন করেই ভাব-রূপ প্রাণ আপনাকে অনুরূপভাবে প্রকাশ করে। ভাব, বিষয়, তত্ত্ব কারো ব্যক্তিগত সামগ্রী নয়; যে-কোনো ব্যক্তিই যে কোনো ভাব, বিষয় বা তত্ত্বকে অবলম্বন করে সাহিত্য রচনা করতে পারেন—ঐ আধেয় বস্তুর সার্বজনীনতা স্বীকৃত হলেও রচনাটি লেখকের নিজস্ব। তাই লেখক বেঁচে থাকেন তাঁর নিজস্ব রচনার মধ্যেই, ভাবের মধ্যে বা বিষয়ের মধ্যে নয়।
ভাবকে প্রকাশ করার কথা ভাবতে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে তার উপায়ের কথাও ভাবতে হয়। মানুষ দিঘি খুঁড়ে জল বার করে, কিন্তু জল মানুষের সৃষ্টি নয়, মানুষের কীর্তি দিঘি খোঁড়ায়। তেমনি ভাব ও ভাবপ্রকাশের উপায়ের মধ্যে শেষোক্তটিই লেখকের নিজস্ব, কারণ ভাব তো সার্বজনীন, এই ভাবকে বিশেষরূপে সর্বসাধারণের আনন্দের সামগ্রী করে তোলাকেই লেখকের কীর্তি বা সাহিত্যসৃষ্টি বলা হয়। যে ভাব সর্বজনের তাকে নিজের করে নিয়ে আবার সকলের করে তোলাই সাহিত্য, ললিতকলা কিংবা যে কোনো শিল্প-সৃষ্টি। অঙ্গার বা কার্বন আকাশে বাতাসে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। গাছপালা তাকে নিগূঢ় শক্তিবলে নিজস্ব করে নিয়ে, পরে অপরের কাজে লাগায়। তেমনি সাধারণ জিনিসকে প্রথমে নিজের করে নিয়ে, পরে বিশেষভাবে সাধারণের করে তোলাই সাহিত্যের কাজ।
এইভাবে যদি সাহিত্যকে বিচার করা যায়, তবে সাহিত্য থেকে জ্ঞানের বস্তু বাদ পড়ে যায়। কারণ জ্ঞানের বস্তু সত্যবস্তু, তা’ ব্যক্তি-নিরপেক্ষ, দেশে কালে তার রূপ সর্বত্র এক—হৃদয়ের রঙেও তার রঞ্জিত হবার সুযোগ নেই, অতএব সত্য-ভিত্তিক বিজ্ঞানের পক্ষে সাহিত্য হওয়াও সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “যে সকল জিনিস অন্যের হৃদয়ে সঞ্চারিত হইবার জন্য প্রতিভাশালী হৃদয়ের কাছে সুর রঙ্ ইঙ্গিত প্রার্থনা করে, যাহা আমাদের হৃদয়ের দ্বারা সৃষ্ট না হইয়া উঠিলে অন্য হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারে না, তাহাই সাহিত্যের সামগ্রী।”
Leave a comment